ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশের ভূ অবস্থানগত দিকটিই আগ্রহের মূল কারণ

সামরিক সহযোগিতা দিতে চায় ভারত চীন আমেরিকা

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ১৪ মার্চ ২০১৭

সামরিক সহযোগিতা দিতে চায় ভারত চীন আমেরিকা

তৌহিদুর রহমান ॥ বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষাখাতে সহযোগিতায় বিদেশীদের আগ্রহ ধীরে ধীরে বাড়ছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত ছাড়াও চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা দিতে বিশেষ আগ্রহী। তারা বাংলাদেশকে আরও সমরাস্ত্র সরবরাহ, প্রযুক্তি হস্তান্তর, সন্ত্রাস প্রতিরোধে সহযোগিতা, যৌথ সামরিক মহড়া ইত্যাদি খাতে সহযোগিতা করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তবে বাংলাদেশ সকল দিক বিবেচনায় নিয়ে এসব দেশের কাছ থেকে প্রতিরক্ষা খাতে সহযোগিতা নেবে। ভূ-অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ বিশেষ সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। ভৌগলিকভাবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মাঝামাঝি অবস্থানে থাকার কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত, চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামরিক সহযোগিতায় বিশেষ আগ্রহী। কোন কোন ক্ষেত্রে এসব দেশের মধ্যে প্রতিযোগিতাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সে কারণে সকল দিক বিবেচনায় নিয়ে এসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে সামরিক সহযোগিতার বিষয়ে এগোতে চায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর সামনে রেখে দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়ে একটি চুক্তি অথবা সমঝোতা স্মারক সইয়ের প্রস্তুতি চলছে। ভারত দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি প্রতিরক্ষা সহযোগিতার চুক্তি করতে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তবে দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা একটি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসার জন্য ভারত থেকে যে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, এ বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই একটি ভাল পথ হতে পারে বলে মনে করছে বাংলাদেশ। এছাড়া ভারতের প্রস্তাবিত চুক্তি অনুযায়ী সেনাবাহিনীর মধ্যে সহযোগিতা, বাংলাদেশের কাছে সমরাস্ত্র বিক্রি এবং সরবরাহ অন্তর্ভুক্ত থাকবে। একই সঙ্গে হুমকি মোকাবেলায় সম্মিলিতভাবে অভিযান চালানোর বিষয়টি রয়েছে। বাংলাদেশকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয় করার জন্য ৫০ কোটি ডলার লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) ঋণ দেয়ারও প্রস্তাব দিয়েছে ভারত। ইতোমধ্যেই ভারত এই ধরনের চুক্তি ভিয়েতনাম ও মরিশাসের সঙ্গেও করেছে। সমুদ্র ও স্থলসীমা নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা জটিলতার মীমাংসা হওয়ার পর ভারত বাংলাদেশকে সামরিক সহযোগিতা দিতে আগ্রহী। এছাড়া বাংলাদেশ যাতে চীনের দিকে বেশি ঝুঁকে না যায়, সেটাও নিশ্চিত করতে চাইছে ভারত। সে কারণে দেশটি বাংলাদেশের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতায় এখন বিশেষ আগ্রহী। গত বছর ৩০ নবেম্বর ঢাকায় এসে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদারের বার্তা দিয়ে যান ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মনোহর গোপালকৃষ্ণ প্রভু পারিকর। সে সময় দুই দেশের সামরিক সহযোগিতাকে একটি কাঠামোর মধ্যে আনার প্রস্তাব দেয় ভারত। গত ৪৫ বছরের ইতিহাসে সেটাই ছিল প্রথম কোন ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর। বাংলাদেশের সঙ্গে চীনও প্রতিরক্ষা খাতে সহযোগিতা বাড়াতে আগ্রহী। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক বেজিং সফর করেন। এরপর গত বছরের মাঝামাঝিতে ঢাকা সফর করেন চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী চ্যাং ওয়ানকুয়ান। গত আট বছরের মধ্যে এটাই ছিল প্রথম কোন চীনা প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ঢাকা সফর। সে সময় উভয়পক্ষই বাংলাদেশ ও চীনের সামরিক সহযোগিতা এগিয়ে নেয়ার অঙ্গীকার করে। ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালের পর থেকে বেজিং ঢাকার কাছে পাঁচটি মেরিটাইম পেট্রোল ভেসেল, দুটি করভেট, ৪৪টি ট্যাঙ্ক, ১৬টি জেট ফাইটার, ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য জাহাজবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রি করেছে। এছাড়া চীন থেকে মিং ক্লাস সাবমেরিনও কিনেছে বাংলাদেশ। রবিবার চট্টগ্রামে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নবযাত্রা ও জয়যাত্রা নামে ওই দুটি সাবমেরিন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর বহরে যুক্ত হয়েছে। সেই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া ২০১৫ সালে চীনা সামরিক বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলের ঢাকা সফরের সময় একটি চুক্তি হয়, যাতে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা বলা হয়। বাংলাদেশের সেনা প্রধান জেনারেল বেলালের চীন সফরের সময় বেজিংয়ের পক্ষ থেকে আশা প্রকাশ করা হয়, দুই দেশের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের সফর, সমরতাত্ত্বিক পর্যায়ে যোগাযোগ এবং প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ নিয়ে দুই দেশের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের জুন মাসে চীন সফরের পর প্রতিরক্ষা খাতে উচ্চ পর্যায়ের বেশ কয়েকটি সফর বিনিময় হয়েছে। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক ছাড়াও নৌ ও বিমান বাহিনী প্রধানও চীন সফর করেন। এর আগে চীনের সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান জেনারেল সু কি লিয়াং বাংলাদেশ সফর করেন। তখন দু’দেশের মধ্যে চারটি সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর হয়। বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরা চীন থেকে বরাবরই উচ্চতর পেশাদারিত্বের প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকে। পাশাপাশি বাংলাদেশ চীন থেকে বড় ধরনের সামরিক সরঞ্জাম সংগ্রহ করে। এই সহযোগিতা আরও বাড়াতে চায় চীন। এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও বাংলাদেশকে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা দিতে আগ্রহী। ঢাকা-ওয়াশিংটন প্রতিরক্ষা সহযোগিতা আরও জোরদার করতে চায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে একটি সামরিক লজিস্টিক সহায়তা চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছে। এই চুক্তির মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা বাড়াতে চায় দেশটি। এছাড়া সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ প্রতিরোধেও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে বিভিন্ন সহায়তা দিতে আগ্রহী বলে জানিয়েছে। তবে এ বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে এখনও চূড়ান্তভাবে কোন কিছু জানানো হয়নি।
×