ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

হলি আর্টিজানে আইএসের হামলা- তথ্য দিতে পারেননি গুনারত্নে

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ১৪ মার্চ ২০১৭

হলি আর্টিজানে আইএসের হামলা- তথ্য দিতে পারেননি গুনারত্নে

শংকর কুমার দে ॥ কে এই রোহান গুনারত্নে? তিনদিনব্যাপী পুলিশপ্রধানদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনের প্রথমদিনে গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে ইসলামিক স্টেটস (আইএস) হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করে রীতিমতো তোলপাড় সৃষ্টি করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তিনি। শুধু তাই নয়, হলি আর্টিজানে কমান্ডো অভিযানের জন্য দেরি করা ছিল ভুল এবং তার বক্তৃতায় আরও দাবি, যেই আইএস জঙ্গীরা হামলা চালিয়েছে তারা কওমি মাদ্রাসা থেকে উৎপন্ন। প্রথমদিনে গুনারতেœর এসব কথা বলার পর তিনদিনব্যাপী পুলিশপ্রধানদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনের দ্বিতীয়দিনে সকল বিষয় ছাপিয়ে তার ওপর ছিল সবার দৃষ্টি, সবার মুখে মুখে ছিল তার নাম। এই সেই রোহান গুনারত্মে, যিনি কানাডার লাকবিমা নিউজ নামক সংবাদপত্রে মিথ্যা তথ্য-উপাত্ত লেখার মাধ্যমে উত্থাপন করে কানাডিয়ান তামিল কংগ্রেসের (সিটিসি) ভাবমূর্তি বিনষ্ট করার অভিযোগে কানাডার আদালতে ৫৩ হাজার ডলার জরিমানা দিয়েছেন। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লাকবিমা নিউজ নামক সংবাদপত্রে লেখা এক নিবন্ধে তিনি দাবি করেন, লিবারেশন টাইগার অব তামিলের (এলটিটিই) একটি অংশ হচ্ছেÑ কানাডিয়ান তামিল কংগ্রেস (সিটিসি)। ২০১৪ সালের ২১ জানুয়ারিতে কানাডিয়ান তামির কংগ্রেসকে লিবারেনশ টাইগার অব তামিলের অংশ উল্লেখ করার কারণে কানাডিয়ান তামিল কংগ্রেস রোহান গুনারতেœর বিরুদ্ধে কানাডার ওন্টারিও সুপিরিয়র কোর্ট অব জাস্টিস আদালতে মামলা করেন। ওন্টারিও সুপিরিয়ন কোর্ট অব জাস্টিস আদালতের বিচারক স্টিপেন ই. ফায়ারস্টোন তার বিচারের রায়ে উল্লেখ করেন যে, রোহান গুনারতেœর লেখায় দাবি বিশ্বাসযোগ্য নয় ও বিতর্কিত। এ জন্য তার বিরুদ্ধে ৫৩ হাজার ডলার জরিমানা করেন কানাডিয়ান আদালত। এর মধ্যে কানাডিয়ান তামিল কংগ্রেস (সিটিসি)-এর ভাবমূর্তি বিনষ্ট (ডেমেজ) করার জন্য তাদের ক্ষতিপূরণ হিসাবে ৩৭ হাজার হাজার ডলার ও আদালতের খরচবাবদ হিসাবে ১৬ হাজার ডলার জরিমানাসহ মোট ৫৩ হাজার ডলার জরিমানা করা হয় রোহান গুনারতেœকে। রোহান গুনারত্মের উকিপিডিয়ায় কানাডিয়ান আদালতে তার বিরুদ্ধে অসত্য, মিথ্যা, বিতর্কিত তথ্যে নিবন্ধ প্রকাশের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। সিঙ্গাপুরভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর পলিটিক্যাল ভায়োলেন্স এ্যান্ড টেররিজম রিসার্চ (আইসিপিভিটিআর) পরিচালক এই রোহান গুনারত্মেই বলেছেন, আইএস গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালিয়েছে। এখন প্রশ্ন উঠেছে, কানাডার আদালতে মিথ্যা, অসত্য, বিতর্কিত তথ্য দিয়ে নিবন্ধ লিখে যেই ব্যক্তি জরিমানা দিয়েছেন তিনি আবার বাংলাদেশে এসেও একই কাজটি করেছেন। প্রশ্ন উঠেছে, তিনদিনব্যাপী পুলিশপ্রধানদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এসে তার বক্তব্যে গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে ইসলামিক স্টেটস (আইএস) হামলা চালানোর কথা বলে কি বাংলাদেশের ভাবমূতি বিনষ্ট বা বিতর্কিত করেছেন? যদি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিনষ্টই করে থাকেন তাহলে তাকে কি জেনেশুনেই বাংলাদেশে ইসলামিক স্টেটস (আইএস) আছে এই কথাটি বলানোর জন্যই কি আনা হয়েছে? নাকি তিনি এই কথাটি যে সম্মেলনে বলবেন, তা জেনেই অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ করে আনা হয়েছে? ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর পলিটিক্যাল ভায়োলেন্স এ্যান্ড টেররিজম রিসার্চ (আইসিপিভিটিআর) পরিচালক, জঙ্গীবাদ বিশেষজ্ঞ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয় গুনারতেœকে। হোটেল সোনাগাঁওয়ে অনুষ্ঠিত জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদসহ আন্তঃদেশীয় অপরাধ দমনের লক্ষ্যে আয়োজিত সম্মেলনে ১৪টি দেশের পুলিশপ্রধান ছাড়াও পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থা (ইন্টারপোল), ফেসবুক প্রতিনিধি, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই), আন্তর্জাতিক সংস্থার বিশেষজ্ঞ ও কর্মকর্তারা অংশগ্রহণকারী কর্মকর্তারা শুনে গেলেন বাংলাদেশে আইএস আছে! বাংলাদেশে আইএস আছে, এই কথাটি রোহান গুনারত্মেকে দিয়ে বলানোর মাধ্যমে কার লাভ হয়েছে আর কার ক্ষতি হয়েছে সেই হিসাব-নিকাশ করা হচ্ছে বিশেষজ্ঞ মহলে। পুলিশপ্রধানদের সম্মেলনের দ্বিতীয়দিনে পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক বলেছেন, ‘হোম গ্রোন’ জঙ্গীদের সঙ্গে আইএসের ভার্চ্যুয়াল ওয়ার্ল্ডে যোগাযোগ থাকতে পারে। তবে দেশীয় জঙ্গীদের আইএস-অধ্যুষিত এলাকায় গিয়ে প্রশিক্ষণ নেয়া বা অন্য কোন কর্মকা-ে যুক্ত থাকার কোন প্রমাণ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। সোমবার সোনারগাঁ হোটেলের লবিতে এক সংক্ষিপ্ত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন আইজিপি। জঙ্গীবাদ বিশেষজ্ঞ রোহান গুণারতেœ সম্মেলনের প্রথমদিনে বলেন, গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলা করেছিল জেএমবি নয়, আইএস। তাদের হোম গ্রোন বলা ভুল, হামলাকারীদের পরিচয় সম্পর্কে রাজনৈতিক নেতৃত্ব অসত্য বলেছেন বলেও গুনারতেœ দাবি। আইজিপি তার দাবি সম্পর্কে বলেন, জঙ্গীগোষ্ঠীটির অনেকে তাদের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন। কেউ বলেননি তারা আইএস। অনেকে মারা গেছেন। তাদের আত্মীয়স্বজনও বলেননি। সবাই জেএমবির কথাই বলেছেন। আইজিপি বলেন, কেউ বাংলাদেশ ত্যাগ করে আইএসের সঙ্গে ট্রেনিং নেয়নি। তবে ভার্চ্যুয়াল ওয়ার্ল্ডে তাদের বিচরণ থাকতে পারে। নেটওয়ার্ক থাকতে পারে। ফেসবুকে থাকতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়ায় থাকতে পারে। সেটা তাদের নিজস্ব। আইজিপি বলেন, দেশীয় জঙ্গীদের আইএস বলে চালানো প্রোপাগান্ডা (প্রচারণা) এবং বেজলেস প্রোপাগান্ডা (ভিত্তিহীন প্রচারণা)। আইজিপি বলেন, গুলশানের ঘটনার পর আইএস হামলার দায় স্বীকার করলেও পুলিশী অভিযানে যারা নিহত হয়েছেন, আইএস তাদের ব্যাপারে কোন মন্তব্য করেনি। রোহান গুণারতেœর বক্তব্য সম্পর্কে শহীদুল হক বলেন, রোহান গুনারত্মে পুলিশ কর্মকর্তা বা সেনা কর্মকর্তা নন। তিনি নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে মাঠে কাজ করেন না। তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক। তিনি তার মতো করে বলেছেন। এ দেশের প্রেক্ষাপট তার ভাল জানা নেই। রোহান গুনারতেœ যা বলেছেন, তা বাংলাদেশ পুলিশ অনুমোদন করে না বলেও জানান আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক। পুলিশের সাবেক আইজি নূরুল হুদা হোটেল সোনারগাঁও লবিতে দৈনিক জনকণ্ঠের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, রোহান গুনারত্মে গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলা ও আইএস থাকার যে তথ্য উল্লেখ করেছেন তা সম্পূর্ণ নিশ্চিত না হয়ে বাংলাদেশের বিষয়ে এভাবে বলা ঠিক হয়নি। হোটেল সোনারগাঁও লবিতে র‌্যাবের ডিজি বেনজীর আহমেদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, বাংলাদেশে আইএস আছেÑ এই কথাটি বলে কত বড় সর্বনাশ করার চেষ্টা করা হয়েছে তা কি রোহান গুনারতেœ বুঝতে পেরেছেন? সম্মেলনের দ্বিতীয়দিনে রোহানের কাছে জানতে চেয়েছিলাম তার কাছে কি আইএস বিষয়ে কোন সুনির্দিষ্ট আছে কিনা জিজ্ঞেস করেছিলাম। কিন্তু রোহান আমতা-আমতা করে এড়িয়ে গেছেন। একটি দেশে আইএস এর অস্তিত্ব থাকার অর্থ সবদিক দিয়েই নেতিবাচক, যা বাংলাদেশে আদৌ নেই। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মোঃ মনিরুল ইসলামের কাছে এই বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে প্রথমদিন থেকেই বলা হচ্ছে, দেশে আইএস নেই। রোহান গুনারতেœ সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য না দিয়ে গড়পড়তা যেভাবে বলেছেন তাতে তিনি সম্মেলনের অতিথিদের কাছে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছেন। অপরাধ ও সন্ত্রাস বিশেষজ্ঞরা বলেন, তিনদিনব্যাপী ১৪ দেশের পুলিশপ্রধানদের সম্মেলন ও বিশেষজ্ঞদের আহ্বান করার বিষয়টি বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। অপরাধ, জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে নতুন যুগের সূচনা করবে, যার ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনবে। রোহান গুনারতেœ কোন দেশের প্রতিনিধি নয়। তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, গবেষক, জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কাজ করা একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হিসেবে তার বক্তব্যে আইএস থাকা না থাকার বিষয়ে কোনই প্রভাব পড়বে না। তবে কোন দেশে গিয়ে সেই দেশের ক্ষতি হয় এমন বক্তব্য দেয়াটা যে ঠিক নয় রোহান গুনারতেœ তা অনুধাবন করতে পেরেছেন বলে সম্মেলনে আসা বিশেষজ্ঞদের দাবি। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ডিসি মোঃ মাসুদুর রহমান বলেছেন, দেশে প্রথমবারের মতো আন্তঃদেশীয় অপরাধ ও সন্ত্রাস দমনে অভিজ্ঞতা ও তথ্য বিনিময়ের মাধ্যমে একটি সমন্বিত কৌশল প্রণয়ন করার লক্ষ্য নিয়ে অনুষ্ঠিত সম্মেলন করার ফলে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হচ্ছে। ঢাকার সোনারগাঁও হোটেলে অনুষ্ঠিত হচ্ছেÑ ১৪ দেশের পুলিশ সম্মেলন, যা পুলিশপ্রধানদের মধ্যে সহযোগিতা বাড়াতে একটি প্ল্যাটফর্ম গঠনও এর লক্ষ্য। সম্মেলনের তৃতীয়দিনে মঙ্গলবার সম্মেলন শেষে একই যৌথ ঘোষণা দেয়ার কথা রয়েছে।
×