ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গোলাম কুদ্দুছ

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূচনা ও ১১ মার্চ ১৯৪৮

প্রকাশিত: ০৩:৪৩, ১৪ মার্চ ২০১৭

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের  সূচনা ও ১১ মার্চ ১৯৪৮

(গতকালের পর) দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা, মতাদর্শ এবং নেতৃত্বের প্রশ্নে ‘নিখিল বঙ্গ মুসলিম লীগ’-এর মধ্যে দুটো ধারা সৃষ্টি হয়। একটি ধারা ধর্মের নামে রাষ্ট্র পরিচালনা এবং ধর্মীয় অনুশাসন ও চিন্তা-চেতনা তথা ইসলামী তাহজিব-তমদ্দুনের ভিত্তিতে দেশ শাসনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এই ধারায় পূর্ব বাংলায় নেতৃত্ব দেন মাওলানা আকরম খাঁ ও খাজা নাজিমুদ্দিন। অপরদিকে মুসলিম লীগের উদারনৈতিক প্রগতিশীল অংশের নেতা ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম। এই প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসীদের একটি অংশ ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে ঢাকায় এক বৈঠকে কমরুদ্দীন আহমদকে আহ্বায়ক করে ‘গণআজাদী লীগ’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলে। এই সংগঠন ‘আশু দাবি, কর্মসূচী, আদর্শ’ নামে একটি মেনিফেস্টো প্রকাশ করে। এতে ভাষা সম্পর্কে বলা হয়, ‘মাতৃভাষার সাহায্যে শিক্ষাদান করিতে হইবে। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এই ভাষাকে দেশের যুগোপযোগী করার জন্য সর্বপ্রকার ব্যবস্থা করিতে হইবে। বাংলা হইবে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’ স্বাধীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট মুহম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে পাকিস্তানের নতুন সরকার যাত্রা শুরু করে। যে ধর্মীয় বিশ্বাস ও আবেগের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের ব্যক্তিগত উচ্চাকাক্সক্ষা, ক্ষমতার মোহ এবং কোটারী স্বার্থের কারণে সে আশা দ্রুতই নিঃশেষ হতে শুরু করে। সাধারণ মানুষের মতামতকে তোয়াক্কা না করে, গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি অবজ্ঞা করে পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন নতুন শাসকগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব ইচ্ছা এবং ধ্যান-ধারণামতো পাকিস্তান শাসন করার নীতি গ্রহণ করে। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালী জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা না করে শুরুতেই পাকিস্তান সরকার মানিঅর্ডার, পোস্টকার্ড, মুদ্রায় শুধু উর্দু ও ইংরেজী ভাষা ব্যবহার শুরু করে। একই সময়ে পাকিস্তান নৌবাহিনীতে নিয়োগের ইন্টারভিউয়ের ক্ষেত্রেও বাংলাকে উপেক্ষা করা হয়। এর ফলে সচেতন, শিক্ষিত এবং প্রগতিবাদী মানুষের মাঝে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ১৪ আগস্টের পর মুসলিম লীগের সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম গ্রুপের কলকাতায় অবস্থানকারী কর্মীরা ঢাকায় এসে তখনকার প্রগতিশীল অংশের সঙ্গে যুক্ত হয়ে একটি যুব সংগঠন গড়ে তোলায় উদ্যোগী হন। ১৫০ নং মোগলটুলিতে অবস্থিত মুসলিম লীগের অফিস প্রগতিশীল কর্মীদের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে। নানা প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান খান বাহাদুর আবুল হাসানাত আহমেদের বাড়ির বিশাল লন এবং হলরুমে যুব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সমগ্র পূর্ববাংলা থেকে ৭ শতাধিক প্রতিনিধি এ সম্মেলনে অংশ নেন। তসদ্দুক আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে ব্যাপক আলাপ-আলোচনার পর অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ওই কর্মী সম্মেলনে ভাষা সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবও গৃহীত হয়। অনেক লেখককে এ প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যেতে দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে ভাষাসৈনিক গাজিউল হক বলেছেন, ‘৬ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা থেকে শুরু করে প্রায় পরদিন ভোর পর্যন্ত বিষয় নির্বাচনী কমিটির বৈঠক চলে। এই বৈঠকে পরদিনের গৃহীতব্য প্রস্তাবগুলো আলোচিত হয় এবং পরবর্তীকালে সাধারণ সভায় গৃহীত হয়। বিষয় নির্বাচনী কমিটির ভাষা সম্পর্কিত প্রস্তাবসহ প্রায় সব প্রস্তাবের আলোচনায় মুজিব ভাই বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেন। ভাষা সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলো ছিল নিম্নরূপ : ‘পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে, বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন ও আইন-আদালতের ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হইবে সে সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দেওয়া হউক এবং জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক।’ উল্লেখ্য, প্রস্তাবের শেষ অংশটি ‘জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক’ সংযোজনের প্রস্তাব করেন সেদিনকার আপোসহীন সংগ্রামী ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁকে সমর্থন করেন রাজশাহীর যুবনেতা আতাউর রহমান। সুতরাং এই কথা নিঃসন্দেহে বলা চলে, পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র বাইশ দিন পর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে যখন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার প্রশ্নটি ওঠে এবং যে দাবি জানানো হয়, তখনও বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রথম সারির নেতৃত্বের কাতারেই ছিলেন।’ {সূত্র : ভাষা আন্দোলনের আর্থ-সামাজিক পটভূমি, সম্পাদনা- ড. আতিউর রহমান (চতুর্থ খ-), ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের শ্রেণী অবস্থান, ড. আতিউর রহমান ও সৈয়দ হাশমী, পৃ. ৫১}। ওই কর্মী সম্মেলনে ভাষা সম্পর্কিত প্রস্তাবটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সম্পর্কে লেখক ও গবেষক বদরুদ্দীন উমর বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে, বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন ও আইন-আদালতের ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হইবে সে সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত প্রদানের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দেওয়া হউক এবং জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক।’ [সূত্র : পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (প্রথম খ-), লেখক : বদরুদ্দীন উমর, পৃ. ২৫]। বদরুদ্দীন উমর প্রস্তাবকারী হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম উল্লেখ না করলেও তার উত্থাপিত প্রস্তাবটিকে সামনে এনেছেন। এই তথ্যটিও প্রকৃত ইতিহাসের সত্য অনুসন্ধানের জন্য বিশেষভাবে গুরত্বপূর্ণ। অধ্যাপক মুস্তাফা নুর উল ইসলাম ওই কর্মী সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ভাষা সম্পর্কিত প্রস্তাব গ্রহণ এবং কর্মী সম্মেলন সফল করার জন্য শেখ মুজিবের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলে তিনি মত প্রকাশ করেছেন। তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠা ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের তরুণ শিক্ষক আবুল কাসেমের নেতৃত্বে তার বাসা ১৯নং আজিমপুরে ‘তমদ্দুন মজলিস’ নামে একটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ইসলামী তাহজিব ও তমদ্দুন প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী এই সংগঠন রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সংগঠনের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শিরোনামে একটি বই বংশালের বলিয়াদি প্রিন্টিং প্রেস থেকে মুদ্রিত এবং ১৯নং আজিমপুর থেকে প্রকাশিত হয়। বইটিতে তিনটি প্রবন্ধ এবং সংগঠনের উদ্দেশ্য, আদর্শ ও কর্মসূচী সংক্ষিপ্তাকারে প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধ তিনটি লেখেন অধ্যাপক আবুল কাসেম, অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন ও আবুল মনসুর আহমদ। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে গ্রহণের যৌক্তিকতা এবং জনমত সৃষ্টিতে তমদ্দুন মজলিস ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে। ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে তমদ্দুন মজলিসের সাহিত্য সম্পাদক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যাপক এএসএম নুরুল হক ভূঁইয়াকে আহ্বায়ক করে প্রথম ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে এ কমিটি গঠিত হলেও এতে অন্যান্য সংগঠনের প্রতিনিধিও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ১৯৪৭ সালের ১৮ নবেম্বর দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, পূর্ববঙ্গের প্রখ্যাত কবি, লেখক, শিল্পী, সাংবাদিক, পেশাজীবী, শিক্ষাবিদদের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি স্মারকলিপি মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের নিকট প্রদান করা হয়। এই স্মারকলিপিতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়। করাচীতে পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলন পাকিস্তানের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের ২৭ নবেম্বর করাচীতে একটি শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে বিভিন্ন প্রদেশের কর্মকর্তা এবং প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। পূর্ববাংলা থেকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী ও শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদ অংশগ্রহণ করেন। এ সম্মেলনের উদ্দেশ্য, সিদ্ধান্ত ও প্রস্তাব নিয়ে বিভ্রান্তি এবং পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। করাচীতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলন শেষে ৫ ডিসেম্বর মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার ও আবদুল হামিদ ঢাকায় এসে পৌঁছেন। বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তারা জানান যে, সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। ৬ ডিসেম্বর দৈনিক ‘মর্নিং নিউজ’ পত্রিকায় এ সংবাদ প্রকাশিত হলে সর্বত্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে বেলা দুটোয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা এ সমাবেশে অংশ নেয়। তমদ্দুন মজলিসের সম্পাদক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন মুনীর চৌধুরী, আবদুর রহমান, একেএম আহসান, কল্যাণ দাশগুপ্ত, এম আহমদ প্রমুখ। ওই সভায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে চারটি দাবি উত্থানে করেন ডাকসুর ভিপি ফরিদ আহমেদ এবং সেগুলো সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। ছাত্রসভা শেষে এক বিরাট মিছিল সচিবালয়ে যায় এবং মন্ত্রীদের কাছে এ সম্পর্কিত ব্যাখ্যা দাবি করে। শিক্ষা সম্পর্কিত প্রস্তাব নিয়ে সরকারের মন্ত্রীদের মধ্যে পারস্পরিক দোষারোপ প্রত্যক্ষ করা যায়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, শিক্ষক, সাংবাদিক এবং সুধী সমাজ কথিত প্রস্তাবের বিপক্ষে বিবৃতি এবং মতামত ব্যক্ত করেন। চলবে...
×