ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শামসুল আরেফিন খান

ওরা যে ভালবাসার কাঙাল

প্রকাশিত: ০৩:৪২, ১৪ মার্চ ২০১৭

ওরা যে ভালবাসার কাঙাল

ধ্রুপদীসহ পঞ্চপা-বের ১২ বছরের অজ্ঞাতবাস শেষ হতে তখন মাত্র ১ বছর বাকি। পরম মিত্র ‘বিরাট রাজা’ তাদের আশ্রয় দিলেন বলেই রক্ষে। নইলে দুর্যোধনের হাতে তাদের চরম সর্বনাশ হয়ে যেত। দুর্যোধন খুঁজতে খুঁজতে বিরাট রাজার দেশে হাজির হলো। বিরাট রাজার চাইতে ক্ষমতাবান ছিল তার সেনাপতি। সে আবার দুর্যোধনের সকল নটঘট ও নষ্টামির দোসর, হৃদ্যক মিত্র। তারই কারসাজিতে দুর্যোধনের জন্য রাজকীয় সংবর্ধনার আয়োজন হলো। ধ্রুপদীসহ পা-বরা সবাই ছিল বিভিন্ন ছদ্মবেশে। নাচগানের আয়োজনেও তারা অংশীদার। সেই আয়োজনে অর্জুন অবস্থান নিয়েছিল বৃহন্নলা ছদ্মনামে নপুংসকবেশে। মহাভারতের কল্পকাহিনীর বাইরে সর্বযুগে সর্বকালেসর্বদেশেই বৃহন্নলারা বিরাজমান ছিল এবং এখনও আছে। নারীও না পুরুষও না, মানুষ বটে। যার মধ্যে নারী হরমন বেশি তাকে অনেকটা মেয়ের মতোই দেখায়। পুরুষ হরমনের আধিক্যে অবয়ব পুরুষালি। স্বভাবে আচরণে চালচলনে এমনকি সাজগোজেও নারীকেই তারা নানা অঙ্গভঙ্গিতে অনুকরণ করার প্রয়াস রাখে। অর্জুনের ছদ্মবেশটাও ছিল শাড়ি পরা নারীর। অংশগ্রহণ ছিল সঙ্গীতে। এরাও নারীবেশেই চলাফেরা করে। নাচগানে অধিক আগ্রহ এদেরও বৈশিষ্ট্য! এদের সমাজ জগত সংসার নিজেদের থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। তাদের জীবন, জগত সম্পূর্ণ আলাদা। আমরা চিনি হিজড়া নামে। নানা অপ্রীতিকর পট সৃষ্টি ও বিড়ম্বনার কারণে সমাজের বিদ্বেষ ও অবহেলার পাত্র হয়েছে জনমদুঃখী এই লিঙ্গ প্রতিবন্ধী মানুষগুলো। যেখানে এখনও সভ্যতা হামাগুড়ি দিচ্ছে ও খাবি খাচ্ছে। আমাদের মতো সেই সব দেশে এরা মানুষের মর্যাদা থেকেই বঞ্চিত! কিন্তু কেন? জন্মের ওপর তো কারও হাত থাকে না! আরও একটি বিষয় স্মরণ করা দরকার, যেটা তথাকথিত সভ্য সমাজ এড়িয়ে চলে। সেটা কী জানেন? সেটা খুবই বেদনাভরা এক বাস্তবতা যে, ওরা আমাদেরই স্বজন, কারও না কারও আত্মজ! বুঝতে সহজ হবে আর একটি সত্য তুলে ধরলে। হিজড়া বলুন বৃহন্নলা বলুন, এরা কেউ হিজড়া মায়ের পেটে জন্মায় না। এদের জন্মদাতা পিতাও একজন স্বাভাবিক বীর্যবান পুরুষ। বৃহন্নলারা বংশবৃদ্ধি বা প্রজনন ক্ষমতার অধিকারীই নয়। তা হলে এই সম্প্রদায়ে জনসংখ্যা বাড়ছে কী ভাবে? সেটাও আমাদের চোখের সামনেই ঘটে চলেছে। কিন্তু সবার চোখে সত্যটা ধরা পড়ে না। গর্ভধারিণী একজন দুঃখী মা-ই লিঙ্গ প্রতিবন্ধী নিজ সন্তানকে সবার অগোচরে হিজড়াদের হাতে তুলে দিচ্ছে। এটা গচ্ছিত রাখা নয়, চিরতরে বিসর্জন! সর্বস্বত্যাগী সম্প্রদান। আমরা শুধু একটা দৃশ্যই অবলোকন করি, যা বহির্দৃশ্য। যে বাড়িতেই লিঙ্গ প্রতিবন্ধী সন্তান জন্ম নেয়, সেখানেই সদলবলে বৃহন্নলারা ছুটে যায়। নাচগানে মাতিয়ে তোলে। লেনদেনটা হয় গোপনে, সবার অলক্ষ্যে অগোচরে। জন্মদাতা বাবা অন্য সন্তানদের মঙ্গল চিন্তা করে, বংশ মর্যাদার কথা ভেবে নির্দয় হন। অভাগিনী মা বুকে পাথর বাঁধেন। আমাদের মতো দরিদ্র চেতনা ও বিবেক প্রতিবন্ধী সমাজ, সংসার এবং ‘যাদের হৃদয়ে কোন প্রেম নেই, প্রীতি নেই, করুণার আলোড়ন নেই’ ‘তেমন কিছু আত্মবিস্মৃত নির্দয় মানুষের কর্তৃত্বাধীন পরিবার এদের অকুলপাথারে ভাসিয়ে দেয় সমাজ, দেশ-জাতির আবর্জনা ও বোঝা মনে করে। আমি কোন উল্লেখযোগ্য নামী-দামী লেখক নই। একজন নগণ্য সাংবাদিক ও ইদানীংকালের ফেসবুকার। আমার এক স্নেহাষ্পদ বন্ধু তার পোস্টে প্রশ্ন রেখেছেন, রাস্তায় হিজড়াদের অসভ্য ভীতিকর নোংরা আচরণ থেকে মুক্তি পাব কবে? ‘তার ছেলেরা রাস্তায় যে সব অপ্রীতিকর অবস্থার শিকার হয় তার বিবরণ দিয়েছেন। তাতে মায়ের মনে যে প্রতিক্রিয়া হওয়া স্বাভাবিক, সেটাই তিনি ব্যক্ত করেছেন। আজকাল ঢাকার রাস্তায় হিজড়াদের দ্বারা কিছু বিরক্তিকর টানাহেঁচড়া, অর্থ চেয়ে জোরাজুরি, অসভ্য আচরণ, এমনকি প্রকাশ্যে ছিনতাই ঘটতেও দেখা যায়। কলকাতায় বৃহন্নলাদের পুনর্বাসনের জন্য তাদের ট্রাফিক পুলিশের চাকরি দেয়ার কথা শুনেছি। বন্ধুর পোস্টে মন্তব্য হিসেবে আমি লিখেছি : বর্ণিত পরিস্থিতি সত্যিই বিব্রতকর এবং দুঃখজনক! রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় পুনর্বাসনই এর একমাত্র সমাধান। তবে সহানুভূতির সঙ্গে দেখতে হবে বিষয়টাকে। বিকলাঙ্গ ভিক্ষুকরা যেমন কোন গডফাদারের অধীনে সংঘবদ্ধচক্রের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে, তেমনি জন্মপ্রতিবন্ধী কথিত হিজড়ারাও স্বার্থান্বেষী অপশক্তির হাতের ক্রীড়কে হয়ে পড়েছে, বিশেষ করে বাংলাদেশ ও ভারতে। পেশাদার দুর্বৃত্তরা ওদের অনেক অনৈতিক কাজে নিয়োজিত করার সুযোগ পাচ্ছে। তাদের হাতে পড়ে বৃহন্নলারা যৌন লালসার শিকার হচ্ছে বলেও শোনা যায়। আমেরিকা, ইউরোপে ওদের নাগরিক স্বীকৃতি থাকায় শিক্ষা স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানে সমান অধিকার ভোগ করছে। আমাদের দেশেও জন্মের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা-সংস্কৃতির বিশেষায়িত প্রক্রিয়াধীন করা গেলে এই লিঙ্গ প্রতিবন্ধীরাও সমাজের আবর্জনা ও জাতির বোঝা না হয়ে সম্পদে পরিণত হতে পারে। এদের মধ্য থেকে উঠে আসতে পারে জ্ঞানতাপস প-িত মানুষ, স্ফুরিত হতে পারে সঙ্গীত প্রতিভা, নাট্যপ্রতিভা এবং চিত্রকলা পারদর্শী গুণী মানুষ। তার অনেক বিচ্ছিন্ন দৃষ্টান্ত রয়েছে। যেমন, আমাদের দেশের একজন খ্যাতিমান পানি সম্পদ বিশেষজ্ঞ এবং ওপার বাংলার একজন খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকারের কথা সবার জানা রয়েছে। শিক্ষা-দীক্ষায় জারিত করে এই শ্রেণী অপাঙ্ক্তেয় মানুষগুলোকে জাতির স্বার্থে দেশের কর্মশক্তিতে পরিণত করার কথা ভাবতে হবে। ওরা যে ভালবাসার কাঙাল! নিয়তি ওদের চাঁদের আলোয় স্বপ্ন দেখার সুযোগ দেয়নি। বাসর ও মধুচন্দ্রিমার সুখ থেকে বঞ্চিত রেখেছে! তাই বলে কি ওরা একটু ভালবাসা পেতে পারে না? ভালবাসা দিয়ে, আইনী সুরক্ষা দিয়ে হতভাগ্য চিরদুঃখী মানুষগুলোকে সমাজে আদরণীয় করে তুলতে হবে। বিদেশে বহু সংস্থা রয়েছে যারা তাদের নিয়ে কাজ করছে। সরকারপ্রধান নিশ্চয়ই ওদের কথা ভাবছেন, কারণ একটি সমৃদ্ধ উন্নত জাতি গড়তে হলে তার সর্বাঙ্গ সুন্দর ও সাবলীল করে তুলতে হবে। সেটা তিনি বেশ ভাল করেই জানেন। লেখক : প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা, ভাষাসৈনিক, কলামিস্ট e-mail:arefeen0404 @gmail.com
×