শংকর কুমার দে ॥ নব্য জেএমবি ও হুজি এই দুই জঙ্গী সংগঠনের অন্তত এক শ’ জঙ্গী এখন সক্রিয়। এখন নব্য জেএমবির নেতৃত্ব দিচ্ছে আশকোনার জঙ্গী আস্তানা থেকে সটকে পড়া শীর্ষ জঙ্গী মাঈনুল ইসলাম মুসা। হুজির নেতৃত্ব দিচ্ছে কারাগারে আটক ফাঁসির দ-প্রাপ্ত আসামি মুফতি হান্নান। মুসার নেতৃত্বে অন্তত ৩৫ জঙ্গী আত্মগোপন করে আছে। এরা সবাই সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্য। অনুরূপ সংখ্যক হুজি জঙ্গী তৎপর রয়েছে। রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম ও উত্তরাঞ্চলের আরও অন্তত একডজন ‘গোপন’ জঙ্গী আস্তানায় আত্মগোপন করে আছে তারা। যেসব জঙ্গী আত্মগোপন করে আছে তাদের রয়েছে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র, বোমা, গ্রেনেড, সুইসাইড ভেস্ট। এরা প্রশিক্ষিত জঙ্গী। এই ধরনের তথ্যের কথা জানিয়েছে কুমিল্লায় পুলিশের ওপর হামলাকারী জঙ্গী আহমেদ আসওয়াদ ইমতিয়াজ তালুকদার ওরফে অমি ও মুফতি হান্নানকে প্রিজনভ্যান থেকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টাকালে গ্রেফতার হওয়া জঙ্গী মোস্তফা কামাল। কুমিল্লায় গ্রেফতার হওয়া অমি ও টঙ্গীতে গ্রেফতার হওয়া মোস্তফা কামালকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হলি আর্টিজান ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলার পর ২৬৮ জনের একটি নিখোঁজ তালিকা প্রকাশ করা হয়। পরে তা সংশোধন করে ৬৮ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করে, যারা জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি। কুমিল্লায় পুলিশের ওপর হামলাকারী জঙ্গী আহমেদ আসওয়াদ ইমতিয়াজ তালুকদার ওরফে অমি এদের একজন। গুলিবিদ্ধ অমি বর্তমানে কুমিল্লার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। জিজ্ঞাসাবাদে অমি জানিয়েছে, তারা হাতে তৈরি বোমা বা গ্রেনেডগুলো ঢাকার সায়েদাবাদের একজনের কাছে হস্তান্তর করতে যাচ্ছিল। সেখানে নব্য জেএমবির একটি আস্তানা আছে। এছাড়াও মিরপুরে একটি জঙ্গী আস্তানা আছে। চট্টগ্রামে গোপন জঙ্গী আস্তানা আছে এমন দুটি স্থানের কথাও বলেছে এই জঙ্গী। উত্তরাঞ্চলে বেশ কয়েকটি আস্তানায় কয়েক জঙ্গী আত্মগোপন করে থাকার তথ্যও দিয়েছে জঙ্গী অমি।
গত ৭ মার্চ কুমিল্লায় শ্যামলী পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাস তল্লাশির সময় কৌশলে বাস থেকে নেমে পুলিশের ওপর হামলা চালায় অমি ও মাহমুদ হাসান নামের দুই জঙ্গী। পরে পুলিশ ও জনতা তাদের আটক করে। তাদের দেয়া তথ্যানুযায়ী চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের একটি আস্তানা থেকে বিপুল গ্রেনেড উদ্ধার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে অমি বলেছে, গত বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি বাসা ছেড়ে যায় সে। তারপর ঢাকায় যে কয়েকটি ভাড়া বাসা রয়েছে নব্য জেএমবির সদস্যদের তার প্রায় সবক‘টিতেই অবস্থান ও যাতায়াত করেছে সে। তবে অমি সে দিন কার কাছে বোমাগুলো নিয়ে যাচ্ছিল সেই বিষয়ে তথ্য না দেয়ায় এখনও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
জিজ্ঞাসাবাদে অমি জানায়, গ্রেফতার অমির সঙ্গে নব্য জেএমবির সাবেক সমন্বয়ক তামিম চৌধুরী, হলি আর্টিজানে হামলাকারী পাঁচ জঙ্গীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল এবং তামিম নিহত হওয়ার আগে না’গঞ্জের জঙ্গী আস্তানায় এক সপ্তাহ ছিল। রাজধানী ঢাকার আজিমপুর, মিরপুর ও উত্তরায় অবস্থানকারী নব্য জেএমবি জঙ্গীদের ধরতে যেসব পুলিশ অভিযান চালিয়েছে তার প্রায় সবক‘টিতে যোগাযোগ ছিল তার। নব্য জেএমবির আরেক নেতা আবু ইব্রাহিম আল হানিফের সঙ্গেও তার পরিচয় ঘটে টুইটারের মাধ্যমে। শীর্ষ জঙ্গী মুসার আশকোনার আস্তানায় যাতায়াত থাকার উল্লেখ করে অমি বলেছে, তামিমের মৃত্যুর পর নব্য জেএমবির বর্তমান নেতা মাইনুল ইসলাম মুসা।
গত ১০ মার্চ হুজি প্রধান মুফতি আবদুল হান্নানসহ ১৯ জঙ্গীকে প্রিজনভ্যানে আদালত থেকে কাশিমপুর কারগারে নেয়ার সময়ে তাদের ছিনিয়ে নেয়ার জন্য প্রিজনভ্যানে হামলা চালায় জঙ্গীরা। এ সময় মোস্তফা কামাল নামে এক জঙ্গী ধরা পড়ে। তার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে অস্ত্র, গুলি, বোমা, গ্রেনেড তৈরির সরঞ্জামাদি। মোস্তফা কামালের দেয়া জবানবন্দী অনুযায়ী নরসিংদী থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে তার সহযোগী মিনহাজুল ইসলামকে। তাদের এখন জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদে জঙ্গী তৎপরতায় লিপ্তরা বড় ধরনের নাশকতা, জঙ্গী হামলার ছক কষছে।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেছেন, অনেক তরুণ শিক্ষার্থী জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন সময় যারা নিখোঁজ হয়েছে তাদের খোঁজ চলছে। এদিকে র্যাব-পুলিশের তালিকা অনুযায়ী এখনও অনেক কিশোর, তরুণ পরিবার থেকে নিখোঁজ রয়েছে। তাদের সম্পর্কে তথ্য পেতে তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।
তবে যেসব অভিভাবক সন্তানদের নিখোঁজ হওয়া নিয়ে তথ্য দিতে কার্পণ্য করছে তাদের বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলায় জড়িত জঙ্গীরা দীর্ঘদিন নিখোঁজ থাকার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো নিখোঁজদের তালিকা তৈরি শুরু করে। প্রথম দফায় গত ১৯ জুলাই র্যাব ২৬২ জনের তালিকা তৈরি করেছিল। গত ২০ জুলাই সারাদেশে নিখোঁজ ২৬১ জনের তালিকা প্রকাশ করে র্যাব। সেটি যাচাই-বাছাই শেষে ৬৮ জনের এ তালিকা প্রকাশ করল র্যাব। সংশোধিত তালিকার নিখোঁজ ৬৮ জন হচ্ছেনÑ মোঃ মহিবুর রহমান (৩০), মোঃ সাজ্জাদ রউফ ওরফে অর্ক (২৪), ডাঃ আরাফাত হোসেন তুষার, তাহমিদ রহমান সাফি (৩০), খাঁন মোঃ মাহমুদুল আহসান রাতুল (২৩), ঝুন্নুন শিকদার (৩০), কাজী মোঃ মইনউদ্দিন শরীফ (৩০), মোঃ তাওসিফ হোসেন (২৩), জুবায়েদুর রহিম, ইব্রাহীম হাসান খান (২৫), জুনায়েদ হাসান খান, এ এস এম ফারহান হোসেন (২৯), মনোয়ার হোসেন (সবুজ), আশরাফ মোহাম্মদ ইসলাম, মোঃ বাদশা আলী (২৫), মোঃ সুমন (২৮), মোঃ আশিক ওরফে সাব্বির রহমান (১৬), নজিবুল্লাহ আনসারী (২৭), মোঃ বাশারুজ্জামান ওরফে আবুল বাশার, মোঃ শরিফুল ইসলাম, রাহাত বিন আব্দুল্লাহ (২৬), বেলাল মোল্লা সোহেল (২২), মোঃ মাজেদুল হক (৩৫), আমান উল্লাহ আমান (২৪), মোঃ কামরুজ্জামান (২৩), মোঃ সাহারাত আলী (২৬), হাসানুর রহমান ওরফে আসানুর, ইকবাল হোসেন (২৯), মোঃ তহিদুল ইসলাম (২০), হাসান আলী (৩৭), ফারুক হোসেন (৩৭), সুমন হোসেন, রাশেদ হোসেন (২৫), শাহজাহান (৩৩), মোঃ জুবায়ের হোসেন ফারুক (২১), মোঃ তাজুল ইসলাম চৌধুরী (৩৮), তামিম আহমেদ চৌধুরী (৩১), মোঃ জাকির হোসেন (২৮), আশরাফুজ্জামান (৩২), মোঃ শাহরিয়ার খান ওরফে শাহজাহান (৩৩), সাদমান হোসেন (পাপন) (২৩), মোঃ আকরাম হোসেন (২৫), জুলহাস শেখ (৩২), মোঃ হাবিবুল্লাহ (২৬), জহিরুল ইসলাম চৌধুরী (২৬), মোঃ ইমরান (২২), এ টিএ ম তাজ উদ্দিন (৩৬), মোঃ হাবিবুর রহমান (১৬), মোঃ ইসমাইল হোসেন (২২), মোঃ মিন্টু রহমান ওরফে বৈরাগী মিন্টু (২৭), মোঃ মারজুক হায়দার ওরফে জাহিন (১৭), মহিদুল ইসলাম ওরফে মিশুক (১৭), রাকিবুল ইসলাম ওরফে রিয়েল (২৪), মিন্টু মিয়া (ঈদু) (৩৫), রেজাউল করিম (২৬), ইকবাল হোসেন (২০), জাহাঙ্গীর আলম (২৫), মকসুদ আলী (২৫), আব্দুল হামিদ (৩০), রিয়াজ উদ্দিন (১৫), জহিরুল ইসলাম (১৬), সাখাওয়াত হোসেন (২৮), মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ ওজাকি ওরফে সুজিত দেবনাথ, ডাঃ রোকনুদ্দীন খন্দকার (৫০), নাঈমা আক্তার, রেজওয়ানা রোকন (২৩), রামিতা রোকন (১৭) ও সাদ কায়েস (৩০)।
গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, নিখোঁজ ২৬২ জনের তালিকা যাচাই-বাছাই শেষে তারা এ সংশোধিত তালিকা প্রকাশ করেছে। নতুন এ নিখোঁজ তালিকার ৬৮ জনের মধ্যে কতজনের জঙ্গী সংশ্লিষ্টতা রয়েছে সেটাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কুমিল্লায় পুলিশের ওপর হামলা ও টঙ্গীতে হুজি প্রধান মুফতি হান্নানকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা ঘটনায় জঙ্গী সম্পৃক্ততায় নিখোঁজদের বিষয়ে আবার নতুন করে খোঁজ নেয়া হচ্ছে।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: