ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রদায়িকীকরণ এবং জাতীয় নাগরিক কমিশন

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ১৩ মার্চ ২০১৭

পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রদায়িকীকরণ এবং জাতীয় নাগরিক কমিশন

(শেষাংশ) তারা জাতিকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত আলোর পথে নিয়ে যাবেন, না পাকিস্তানপন্থীদের দাবি অনুযায়ী মধ্য-যুগীয় তামসিকতায় নিক্ষেপ করবেন। গত ১৯-২১ জানুয়ারি (২০১৭) ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে সূচিত মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী নাগরিক আন্দোলনের রজতজয়ন্তী পালনের পাশাপাশি সংগঠনের ৭ম জাতীয় সম্মেলন আয়োজন করেছিল। সম্মেলনের মূল অধিবেশনে এবং প্রতিনিধিদের জন্য নির্দিষ্ট অধিবেশনে পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রদায়িকীকরণের কঠোর সমালোচনা হয়েছে। প্রতিনিধিদের দাবি অনুযায়ী সম্মেলনে গৃহীত এক প্রস্তাবে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছিল এ বিষয়ে সুপ্রীমকোর্টের একজন বিচারপতির নেতৃত্বে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে দায়ী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শিক্ষানীতি গ্রহণের জন্য। সরকার বিচার বিভাগীয় তদন্ত না করে বিভাগীয় তদন্ত কমিটি করেছে শুধু মুদ্রণপ্রমাদ ও তথ্যবিভ্রাট অনুসন্ধানের জন্য। সরকারী কমিটির সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য করে নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে গত ১১ ফেব্রুয়ারি (২০১৭) সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের প্রাক্তন বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানীকে চেয়ারম্যান এবং বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও গবেষক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনকে সদস্য সচিব করে ১৩ সদস্যবিশিষ্ট নাগরিক কমিশন গঠন করা হয়েছে। কমিশনের অন্যান্য সদস্য হচ্ছেন- ১. অধ্যাপক অজয় রায়, ২. বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলাম, ৩. অধ্যাপক অনুপম সেন, ৪. বিচারপতি শামসুল হুদা, ৫. অধ্যাপক কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক, ৬. বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, ৭. শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, ৮. অধ্যাপিকা ফরিদা মজিদ, ৯. অধ্যাপিকা পান্না কায়সার, ১০. শিক্ষাবিদ মমতাজ লতিফ ও ১১. লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির। কমিশনকে বলা হয়েছে ১০ মার্চের ভেতর এ বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন প্রদানের জন্য। কমিশনের সদস্যরা, বিশেষভাবে সদস্য সচিব অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন কঠোর পরিশ্রম করে নির্ধারিত সময়ের ভেতর প্রায় ৩৫০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন প্রদান করেছেন। কমিশনের তদন্তের ভিত্তি ছিল গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন ও বিজ্ঞজনদের লেখা, গোয়েন্দা প্রতিবেদন, নিজস্ব গবেষণা এবং বিশেষজ্ঞদের অভিমত। জনবল, অর্থবল ও সময়ের অভাবে কমিশন পর্যালোচনার জন্য ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি প্রকাশিত পাঠ্যপুস্তকের মাত্র কয়েকটি বেছে নিয়েছিল, যেখানে অসঙ্গতি বেশি ধরা পড়েছে। কমিশনের প্রতিবেদনের উপসংহারে বারোটি সুপারিশ করা হয়েছে। এই সুপারিশগুলো হচ্ছেÑ ১. হেফাজতের দাবির কারণে স্কুলের পাঠ্যসূচীতে যে সাম্প্রদায়িকীকরণ হয়েছে তা থেকে সরে আসার ঘোষণা সরকারকে দিতে হবে। ২. ক্রমান্বয়ে একমুখী শিক্ষার দিকে অগ্রসর হতে হবে এবং এ বিষয়ে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। ৩. মাদ্রাসা শিক্ষার আমূল পরিবর্তন করতে হবে। এই ব্যবস্থায় বাংলার বদলে যেভাবে উর্দুকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে তা রদ করতে হবে। শুধু তাই নয়, প্রাথমিক শিক্ষালয়ে ও মাদ্রাসার প্রাথমিক স্তরে (ইবতেদায়ি) একই ধরনের পাঠক্রম থাকতে হবে। ৪. শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে কয়েকটি ভাগ করে শিক্ষার বিভিন্ন সেক্টরে মনিটরিং ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। ৫. এনসিটিবির সিন্ডিকেট ভাঙ্গতে হবে। যিনি যে বিষয়ে দক্ষ তাকেই পদায়ন করা বাঞ্ছনীয় এবং তা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। সম্পাদনা বা সঙ্কলন কমিটি প্রাথমিক/মাধ্যমিক পর্যায়ের কৃতী শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করা বাঞ্ছনীয়। যাদের জন্য পাঠ্য তাদের কোন প্রতিনিধিত্ব থাকবে না তা অবাস্তব। ৬. শুধু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষককে দিয়ে বই লেখার প্রবণতা বাদ দিয়ে যারা প্রাঞ্জল ভাষায় বই লিখতে পারেন তাদের দিয়ে স্কুল পাঠ্যপুস্তক লেখানোর প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। ৭. শিক্ষাক্ষেত্রের সব বিষয়ে বর্ণবাদ, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা পরিহার করার প্রয়োজনে প্রশাসনের দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। ৮. কবীর চৌধুরী শিক্ষা কমিশন অবিলম্বে শুধু বাস্তবায়ন নয়, শিক্ষা আইন পাস করতে হবে। ৯. প্রতিবছর বইয়ে বানান ভুল থাকা গ্রহণযোগ্য নয়। ভুলের দায়িত্ব বোর্ডের বিশেষজ্ঞের। যারা এ ভুল করছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ১০.সকল ধারার শিক্ষাব্যবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং বাঙালী জাতির ইতিহাস পাঠ বাধ্যতামূলক করতে হবে। ১১.যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় না এবং জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয় না সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদকে সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি করতে। ১২.হেফাজতে ইসলাম ও জামায়াতে ইসলামীর মতো সকল মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী সংগঠন অবিলম্বে নিষিদ্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অবস্থানকারী জামায়াত-হেফাজতীদের অপসারণ করতে হবে। আমরা আশা করব সরকার এসব সুপারিশ গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন প্রজন্ম গড়ে তোলার অঙ্গীকার পূরণ করবে। ১৯ জানুয়ারি নির্মূল কমিটির সম্মেলন উদ্বোধন করতে গিয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ অত্যন্ত উদ্দীপনায় ভাষণ দিয়েছিলেন। ভাষণের উপসংহারে তিনি বলেছিলেন, ‘নির্মূল কমিটির ৭ম জাতীয় সম্মেলনে আমি অনেক প্রতিভাবান তরুণ মুখ দেখতে পাচ্ছি। তরুণদের প্রতি আমি আহ্বান জানাব, আপনারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়ুন, বঙ্গবন্ধুর জীবনী পড়ুন, আমাদের গৌরবময় ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে জানুন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শে নিজেদের উজ্জীবিত করুন। বাঙালীর হাজার বছরের ইতিহাসে বহু অর্জন রয়েছে। এর মধ্যে শ্রেষ্ঠতম অর্জন হচ্ছে স্বাধীনতা। স্বাধীনতা অর্জনের পাশাপাশি ধর্মনিরপেক্ষ ও মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য এত মূল্য বিশ্বের অন্য কোন জাতিকে দিতে হয়নি। বহু ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এ স্বাধীনতা ও মূল্যবোধ আমাদের রক্ষা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, দেশপ্রেম কোন বিমূর্ত বিষয় নয়। দেশকে ভালবাসার অর্থ হচ্ছে দেশের মানুষকে ভালবাসা, প্রকৃতিকে ভালবাসা। তরুণ প্রজন্মকে তাই দেশপ্রেমের মহান চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে হবে। ‘একাত্তরে আমরা বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালীর শৌর্যবীর্যের পাশাপাশি অপরিসীম ত্যাগ সমগ্র বিশ্বের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। বাংলাদেশকে মর্যাদার সুউচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করেছিল। আজ তাঁর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নতি ও অগ্রগতির পথে আমরা দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছি। এই সম্মেলনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে যেসব অতিথি এসেছেন, আপনাদের প্রতি আমার আহ্বান, আপনারা বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাস্প্রদায়িক চেতনা এবং উন্নয়নের বার্তা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরবেন। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ার সংগ্রামে আগামী দিনগুলোতে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে এই প্রত্যাশা ব্যক্ত করে আমি এই সংগঠনের রজতজয়ন্তী ও ৭ম জাতীয় সম্মেলনের শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করছি।’ আমরা মহামান্য রাষ্ট্রপতির ওপর পূর্ণ আস্থা রাখতে চাই। মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। ৯ মার্চ ২০১৭
×