ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গোলাম কুদ্দুছ

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূচনা ও ১১ মার্চ ১৯৪৮

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ১৩ মার্চ ২০১৭

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের  সূচনা ও ১১ মার্চ ১৯৪৮

রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু বাংলাকে ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার লড়াই দীর্ঘদিনের। এই লড়াইয়ে রাজন্যবর্গ, কবি, লেখক, শিক্ষিত শ্রেণী বিভিন্ন সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। বাংলা ভাষার বিকাশ এবং প্রচলনে আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্র বঙ্গদেশে আগমন এবং সিংহাসন দখলের বিবরণী প্রকাশিত হয়। সেনাপতি সৈয়দ হোসেন ‘আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্’ নাম ধারণ করে হিজরী ৮৯৯ এবং খ্রিস্টাব্দ ১৪৩৯ সালে গৌড়ের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তার ২৬ বছরের শাসনামলে রাজ আনুকূল্য পেয়ে বাংলা ভাষার শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। এ সময় বাংলা ভাষায় বহু গ্রন্থ প্রণীত হয়। সে সময় ফতেয়াবাদ মুল্লুকের জমিদার ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী অর্জুন। ফতেয়াবাদ মুল্লকের অন্তর্গত ফুল্লশ্রী গ্রামের বিজয়গুপ্ত মনসামঙ্গল রচনা করেছিলেন। সুলতান হোসেন শাহ্র সেনাপতি পরাগল খাঁর নির্দেশে কবীন্দ্র পরমেশ্বর মহাভারতের আদিপর্ব হতে স্ত্রীপর্ব পর্যন্ত বাংলা ভাষা অনুবাদ করেন। এ সময় মালাধর বসু ভগবতের দশম ও একাদশ স্কন্ধ বাংলায় অনুবাদ শুরু করেছিলেন। আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্র পরবর্তী তার বংশের অন্য সুলতানরাও বাংলা ভাষার বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করতে শুরু করেন। পরবর্তীকালে আরাকান রাজসভার আনুকূল্য পেয়ে বাংলা ভাষার বেশ কয়েক বিখ্যাত কবি তাদের কাব্যগুণে ভাষার বিকাশ ও বিস্তৃতিতে যেমনিভাবে অবদান রেখেছেন, একইভাবে বাঙালী মুসলমান সমাজেও নাড়া দিয়েছেন। ভিনদেশী ভাষায় বলতে-লিখতে এবং কাজকর্ম চালাতে অভ্যস্ত শিক্ষিত মুসলমান শ্রেণী কিছুটা হলেও মাতৃভাষার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। ভারত বিভক্তি ও পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা দ্বিশত বছরের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য বহু মানুষ নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছিল। মানুষের সংগ্রাম ও রক্তদান বৃথা যায়নি। অবশেষে ১৯৪৭ সালের ১৮ জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অধিবেশনে ভারতীয় স্বাধীনতা আইন পাস হয়। এর পরদিন ১৯ জুলাই ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতীয় উপমহাদেশকে বিভক্ত করে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের ব্রিটিশ সরকারের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তান জন্মলাভ করে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববঙ্গ, পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ নিয়ে পাকিস্তান গঠিত হয়। ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন করাচীতে নবনির্বাচিত গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর কাছে পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। লিয়াকত আলী খান নবপ্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। অবিভক্ত বাংলার চট্টগ্রাম বিভাগ, ঢাকা বিভাগ, রাজশাহী বিভাগের কিয়দংশ, খুলনা জেলা, বনগাঁ বাদে যশোর জেলা এবং করিমগঞ্জ মহকুমা বাদ দিয়ে সিলেট জেলা নিয়ে পূর্ববঙ্গ গঠিত হয়। তখন এই প্রদেশের আয়তন ছিল ৫৫ হাজার ১২৬ বর্গমাইল এবং লোকসংখ্যা ছিল ৪ কোটি ১৯ লাখ। পশ্চিম পাকিস্তানের লোকসংখ্যা ছিল ২ কোটি ৪১ লাখ। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট খাজা নাজিমুদ্দিন পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৬ আগস্ট তিনি মন্ত্রিসভা গঠন করেন। মন্ত্রীরা হলেন নুরুল আমিন, আবদুল হামিদ, হাসান আলী, হামিদুল হক চৌধুরী, সৈয়দ মুহম্মদ আফজাল, মুহম্মদ হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী ও মফিজউদ্দিন। ভবিষ্যত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবি উচ্চারিত হয় ব্রিটিশ কর্র্তৃক ভারতবর্ষ ভাগ করে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আলাপ-আলোচনা থেকে। ১৯ মে ১৯৪৭ দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায় যে, হায়দরাবাদে ‘মজলিস-এ-এত্তেহাদুল মোছলেমিন’-এর বার্ষিক অধিবেশন উপলক্ষে আয়োজিত এক উর্দু সম্মেলনে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির অন্যতম নেতা চৌধুরী খালেকুজ্জামান ভবিষ্যত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেন। চৌধুরী খালেকুজ্জামানের এ বক্তব্যের প্রায় দুই মাস পর ১৯৪৭ সালের ১৪ জুলাই আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ ভবিষ্যত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার পক্ষে জোরালো বক্তব্য দেন। চৌধুরী খালেকুজ্জামান এবং ড. জিয়াউদ্দিনের বক্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় বাঙালী মুসলমান লেখকদের মধ্যে। সর্বপ্রথম এ সকল বক্তব্যের বিরোধিতা এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন সে সময় কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘সওগাত’ ও ‘শিশ সওগাত’-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আবদুল হক। এ সময় আবদুল হক ভবিষ্যত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার পক্ষে নানা যুক্তি উপস্থাপন করে ৪টি প্রবন্ধ লেখেন। তিনটি নিজের নামে এবং একটি মিসেস এমএ হক ছদ্মনামে। প্রথম প্রবন্ধটি দৈনিক ইত্তেহাদে ১৯৪৭ সালের ২২ ও ২৭ জুন, দ্বিতীয়টি দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ৩০ জুন, তৃতীয়টি ইত্তেহাদে ২৭ জুলাই এবং ৪র্থটি ৩ জুলাই ‘বেগম’ পত্রিকায় মিসেস এমএ হক নামে। আবদুল হক তার প্রতিটি প্রবন্ধেই ভাষা হিসেবে বাংলার মর্যাদা, গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং অকাট্য যুক্তি দিয়ে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করেন। তার বহু যুক্তি বর্তমান সময়েও সমান প্রযোজ্য। ২৯ জুন ১৯৪৭ ইত্তেহাদে প্রকাশিত তার প্রবন্ধ ‘বাংলা ভাষা বিষয়ক প্রস্তাব’-এ তিনি লেখেন : ‘আমরা কেন আমাদের দেশে ইংরেজী-উর্দু-হিন্দী বলতে বাধ্য থাকব? আমাদের দেশে যারা বাস করে সেসব ইংরেজ বা উর্দু-হিন্দী ভাষী কেন বাংলা শিখতে বাধ্য হবে না? আমার মত এই যে, এ দেশে যেসব অভারতীয় বা অবাঙালী বাস করবে তাদের বাংলা শিখতে হবে, যদি তারা এ দেশে বাস করতে চায় এবং আমাদের সঙ্গে চলতে চায়। বাংলা শেখা তাদেরই গরজ। তাদের জন্য ইংরেজী-উর্দু-হিন্দী শেখা আমাদের গরজ নয়, বরং আমাদের পক্ষে ঘোর অমর্যাদাকর। আন্তর্জাতিক সম্বন্ধের জন্য এবং আন্তর্জাতিক সাহিত্য সংযোগের জন্য যতটুকু ইংরেজী-উর্দু-হিন্দী শেখা দরকার, শুধু ততটুকুই আমরা শিখব এবং অন্তত ততটুকু বাংলা পৃথিবীর জাতিগুলোকেও শিখতে হবে।’ লেখক আবদুল হকের প্রবন্ধের পরপরই ২০ জুলাই ১৯৪৭ ইত্তেহাদে মাহবুব জামাল জাহেদীর ‘রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক প্রস্তাব’ নামে একটি লেখা প্রকাশিত হয়। জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯৪৭ সালের ২৯ জুলাই দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লেখেন। আলোচ্য প্রবন্ধে তিনি রাষ্ট্রভাষারূপে ইংরেজী, উর্দু, বাংলার তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলেও চূড়ান্ত বিচারে বাংলার পক্ষেই অবস্থান গ্রহণ করেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিনের ‘উর্দু’কে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এছাড়া এ সময় মুহম্মদ এনামুল হক, কাজী মোতাহার হোসেন, এম ওয়াজেদ আলী, ফররুখ আহমদসহ বিশিষ্ট লেখকরা রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয় এবং সংবাদ প্রকাশে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উচ্চারিত হয়। চলবে...
×