ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মামলার প্রস্তুতি বিটিআরসির ॥ ইতোমধ্যে ৯ কোম্পানি ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে

১২ পিএসটিএন কোম্পানির কাছে পাওনা ৭১ কোটি টাকা

প্রকাশিত: ০৪:৪৬, ১৩ মার্চ ২০১৭

১২ পিএসটিএন কোম্পানির কাছে পাওনা ৭১ কোটি টাকা

ফিরোজ মান্না ॥ দীর্ঘদিন ধরে সরকারের পাওনা পরিশোধ না করায় পিএসটিএন (পাবলিক সুইচড টেলিফোন নেটওয়ার্ক) কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে মামলা করার প্রস্তুতি নিয়েছে বিটিআরসি। মোট ১২টি পিএসটিএন কোম্পানির কাছে সরকারের পাওনা দ্াড়িয়েছে ৭১ কোটি টাকার বেশি। এই টাকা আদায়ের জন্য বিটিআরসি কোম্পানিগুলোকে কয়েক দফা চিঠি দিলেও কেউ টাকা পরিশোধ করেনি। ইতোমধ্যে ৯টি কোম্পানি তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। বর্তমানে তিনটি প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম পরিচালনা করছে। চালু কোম্পানিগুলোর কাছেও বড় অঙ্কের টাকা পাওনা হয়েছে সরকারের। ব্যবসা গুটিয়ে নেয়া কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে অবৈধ ভিওআইপি কার্যক্রমসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। তারা লাইসেন্স নেয়ার সময় পারফরমেন্স ব্যাংক গ্যারান্টি (পিবিজি) দিয়েছিল তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা সরকার পাওনা হয়েছে। ব্যাংক গ্যারান্টি কেটে নিলেও সরকারের পাওনা পরিশোধ হবে না। বিটিআরসি জানিয়েছে, দেশে মোবাইল ফোনের পাশাপাশি ফিক্সডফোন বা ল্যান্ডফোন সেবায় প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে উন্নত সেবা দিতে ২০০৪ সালে বেসরকারী খাতে পিএসটিএন লাইসেন্স দেয়া হয়। মানসম্মত সেবার কারণে শুরুতে কিছু গ্রাহকও পায় প্রতিষ্ঠানগুলো। শুরুতে দেশের একমাত্র ফিক্সড ফোন অপারেটর ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল)। ২০০৪ সালে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে অঞ্চলভিত্তিক পিএসটিএন অপারেটর হিসেবে সেবা পরিচালনার অনুমতি দেয় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। পরবর্তী সময়ে ২০০৭ সালের শেষদিকে দেশব্যাপী পিএসটিএন সেবাদানে লাইসেন্স দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা। দেশব্যাপী ও অঞ্চলভিত্তিক সেবাদানের জন্য দুটি শ্রেণীতে দেশে মোট ১২টি পিএসটিএন লাইসেন্স দেয়া হয়। দেশব্যাপী এ সেবার লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- টেলিবার্তা লিমিটেড, র‌্যাংকস টেলিকম লিমিটেড, পিপলস টেলিকমিউনিকেশন্স এ্যান্ড ইনফরমেশন লিমিটেড, ঢাকা টেলিফোন কোম্পানি লিমিটেড ও ন্যাশনাল টেলিকম লিমিটেড। আর অঞ্চলভিত্তিক পিএসটিএন সেবাদানের লাইসেন্স পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো হলো, ওয়ানটেল কমিউনিকেশন্স লিমিটেড, বাংলাফোন লিমিটেড, এসএ টেলিকম লিমিটেড, ওয়েসটেক লিমিটেড, জালালাবাদ টেলিকম লিমিটেড, নেক্সটেল টেলিকম লিমিটেড, ওয়ার্ল্ডটেল বাংলাদেশ লিমিটেড। বর্তমানে মোট ১২টি পিএসটিএন অপারেটরের মধ্যে ৯টির কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। র‌্যাংকসটেল, বাংলাফোন এবং ওয়ার্ডটেলের কার্যক্রম চালু আছে। তবে এদের মধ্যে শুধু বাংলাফোন বকেয়া পরিশোধ করছে। র‌্যাংকসটেল ও ওয়ার্ডটেল বকেয়া পরিশোধ না করায় বিটিআরসি এই দুটি প্রতিষ্ঠানসহ ব্যবসা গুটিয়ে নেয়া ৯ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করবে। বিটিআরসি ২০১তম সভায় এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। জানা গেছে, অবৈধ ভিওআইপি (ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল) করার দায়ে ২০১০ সালের মার্চে র‌্যাংকসটেল, ওয়ার্ল্ডটেল, পিপলসটেল, ঢাকা ফোন ও ন্যাশনাল ফোন এই ৫ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় বিটিআরসি। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে পরের বছরই শর্তসাপেক্ষে লাইসেন্স ফিরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিটিআরসি। শর্তের মধ্যে ছিল বকেয়া আন্তঃসংযোগ ফি পরিশোধ, বিটিআরসির বিরুদ্ধে করা পিএসটিএন প্রতিষ্ঠানগুলোর সব মামলা প্রত্যাহার, শর্তের বিষয়ে ভবিষ্যতে নতুন করে মামলা ও ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারবে না কোন কোম্পানি। কার্যক্রম বন্ধের সময় এসব প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক ছিল প্রায় সাড়ে ৭ লাখ। বন্ধ পাঁচ পিএসটিএন প্রতিষ্ঠানে প্রায় ১ হাজার ৫শ’ কর্মী কর্মরত ছিলেন। মামলা প্রত্যাহার ও বকেয়া পরিশোধে সম্মত হওয়ায় র‌্যাংকসটেল, ওয়ার্ল্ডটেল ও ন্যাশনাল ফোনকে পুনরায় সেবা চালুর অনুমতি দেয় বিটিআরসি। পরবর্তী সময়ে শর্ত মেনে আবারও সেবা চালু করে র‌্যাকসটেল ও ওয়ার্ল্ডটেল। দেশব্যাপী পিএসটিন সেবাদানের লাইসেন্স পাওয়া ৫ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বর্তমানে চালু রয়েছে শুধু র‌্যাংকসটেলের সেবা। আর অঞ্চলভিত্তিক পিএসটিএনের মধ্যে চালু রয়েছে বাংলাফোন এবং ওয়ার্ল্ডটেল। পিএসটিএন অপারেটররা তারবিহীন ফিক্সড ফোনসেবা দিচ্ছে। তবে এ সংযোগ সীমিত পরিসরে স্থানাস্তরযোগ্য হলেও মোবাইল ফোন অপারেটরদের মতো না। পিএসটিএন অপারেটরদের বেশির ভাগই সেবাদানের ক্ষেত্রে সিডিএমএ প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। শুধু ওয়ার্ল্ডটেল জিএসএম প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ সেবা দিচ্ছে। দেশব্যাপী সেবাদানের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে ২ দশমিক ৫ মেগাহার্টজ করে তরঙ্গ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বিটিআরসির এক কর্মকর্তা বলেন, টেলিযোগাযোগ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে সরকারের পাওনা আদায়ে উদ্যোগ নিচ্ছে বিটিআরসি। পর্যায়ক্রমে সব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেই পাওনা অর্থ আদায় করা হবে। মূলত কম খরচে ভয়েস কল করার সুবিধা ও ডেটা কানেকটিভিটি সেবার জন্য এসব লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল। বিটিআরসি জানিযেছে, বর্তমানে পিএসটিএন সেবার গ্রাহক রয়েছে প্রায় ১১ লাখ। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) গ্রাহক সংখ্যা ৭ লাখ ৮৫ হাজার। বেসরকারী পিএসটিএনের গ্রাহক সংখ্যার মধ্যে রয়েছে র‌্যাংকসটেলের ২ লাখ ৬৬ হাজার, ওয়ার্ল্ডটেলের ১৪ হাজার ও বাংলাফোনের ৫ হাজার। বিটিআরসির একজন কর্মকর্তা বলেন, পিএসটিএন বন্ধ করে দেয়ার ১৫ মাস পরেই চালুর অনুমতি দেয় মন্ত্রণালয়। ওই অনুমতি অত্মঘাতী ছিল বলে মনে করেন তিনি। এরপর থেকে পিএসটিএন কোম্পানিগুলো সরকারের টাকা পরিশোধ না করে কেবল বকেয়া বাড়াতে থাকে। বর্তমানে পিএসটিএন কোম্পানির কাছে ৭১ কোটি টাকার বেশি বকেয়া দাঁড়িয়েছে। যখন পিএসটিএন বন্ধ ছিল তখন বৈধপথে আন্তর্জাতিক কল বহু গুণে বেড়েছে।
×