ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বৃষ্টিতে উপকূলের কৃষকের আহাজারি

প্রকাশিত: ০৪:২৯, ১৩ মার্চ ২০১৭

বৃষ্টিতে উপকূলের কৃষকের আহাজারি

স্টাফ রিপোর্টার, গলাচিপা ॥ পাঁচ দিনের লাগাতার অকাল বৃষ্টি পটুয়াখালীর গলাচিপা ও রাঙ্গাবালী উপকূলীয় উপজেলার চাষীদের অর্থনৈতিক মেরুদ- ভেঙ্গে দিয়েছে। কেবল সরকারী হিসাবে ৬১ হাজার ৬০ হেক্টর জমির গোল আলু, মিষ্টি আলু, তরমুজ, মুগডালসহ রবিশস্যের ক্ষতি হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ক্ষতির পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এক লাখ ৮৪ হাজার ৪৪০ ক্ষুদ্র, প্রান্তিক, মাঝারি ও বড় পর্যায়ের চাষী। বেসরকারী হিসাবে ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বেশি। মাঠপর্যায়ের চাষীরা জানান, রবিবারও এলাকার হাজার হাজার একর জমির রবিশস্য পানির নিচে তলিয়ে আছে। দুই উপজেলার অধিকাংশ সরকারী খালের মুখ বন্ধ থাকায় পানি নিষ্কাশন ব্যাহত হচ্ছে। উপজেলা কৃষি অফিসার আবদুল মান্নান বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করে জানান, দ্রুত পানি নিষ্কাশন না হলে ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বেড়ে যাবে। সংসদ সদস্য আ খ ম জাহাঙ্গীর হোসাইন জানান, বদ্ধ খালগুলোর পানি দ্রুত নিষ্কাশনের জন্য কৃষি বিভাগকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে পুলিশের সহায়তা নেয়ার জন্য বলা হয়েছে। এছাড়া ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আবার রবিশস্য চাষের জন্য কৃষকদের জরুরীভিত্তিতে প্রণোদনা হিসেবে সার, বীজ ও নগদ অর্থসহ অন্যান্য সহায়তা দেয়ার জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করা হয়েছে। মাঠপর্যায়ে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, গত বুধবার থেকে শুরু হয় লাগাতার বৃষ্টি। বর্ষা মৌসুম ছাপিয়ে গেছে অঝোর বর্ষণ। যে সময়টাতে সবেমাত্র গোল আলু ও তরমুজ ওঠা শুরু করেছে, ঠিক সে মুহূর্তে আকস্মিক বর্ষণে চাষীরা হতভম্ব হয়ে পড়ে। মাত্র এক-দেড় দিনে তরমুজ, গোল আলু, মিষ্টি আলু, চীনা বাদাম, মরিচসহ অন্যান্য রবিশস্যের ক্ষেত এক থেকে দু’ফুট পানির নিচে তলিয়ে যায়। নলুয়াবাগী, হরিদেবপুর, গোলখালী, মুরাদনগর, পাড়ডাকুয়া, ডাকুয়া, হোগলবুনিয়া, কলাগাছিয়া, চরকাজল, চরবিশ্বাস, চরআগাস্তি, আমখোলা, চরমোন্তাজ, বাহেরচর, ছোট বাইশদিয়াসহ কয়েকটি এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোথাও কোথাও ক্ষেতে কোমর পরিমাণ পানি জমেছে। বহু জায়গায় চাষীরা সেচ মেশিন বসিয়েছে। কিন্তু অবিরাম বর্ষণে কৃষকের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। বিশেষ করে যেসব এলাকায় সরকারী খালগুলো বেদখল হয়ে গেছে ও খালের মুখে বাঁধ দেয়া হয়েছে, সেসব এলাকায় জলাবদ্ধতা ভয়াবহ আকার নিয়েছে। এখনও বহু জায়গার ক্ষেতে পানি জমে আছে। পানি নিষ্কাশন করতে না পেরে চাষীরা চরম হাতাশায় ভুগছে। বহু কৃষক কৃষি অফিসে ধর্ণা দিচ্ছে। অকাল বৃষ্টিতে লাখো কৃষক সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছে। হরিদেবপুর গ্রামের অবস্থাপন্ন চাষী সজল নাগ ৮ লাখ টাকা সুদে এনে ১২ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ করেছেন। কিন্তু অকাল বর্ষণে সমস্ত তরমুজ গাছ পচে গেছে। গাছে যেসব তরমুজ প্রায় পেকে এসেছিল, তাও নষ্ট হয়ে গেছে। এখন লগ্নির টাকার জন্য কেবলই মাতম করছেন। একই দশা হয়েছে শান্তিরঞ্জন দাসের। দু’লাখ টাকা সুদে এনে তিন হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ করে এখন পথে বসেছেন। ডাকুয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান ৬ লাখ টাকা সুদে এনে চার হেক্টর জমিতে তরমুজ ও তিন হেক্টর জমিতে গোল আলু চাষ করেছেন। এক হেক্টর জমির গোল আলু বিক্রি করে লাখ দুয়েক টাকা ঘরে তুলতে পেরেছেন। বাকি ফসল বর্ষার পানির স্রোতে ভেসে গেছে। চরবিশ্বাসের নাসির গাজী প্রায় ২০ হেক্টর জমিতে গোল আলু ও তরমুজ চাষ করে এখন সর্বস্বান্ত হয়েছেন। স্থানীয় কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, গলাচিপা ও রাঙ্গাবালী উপজেলায় ১৬ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে তরমুজ ও বাঙ্গি-ফুটের চাষ হয়েছে। এ দুটি ফসলের এরই মধ্যে ৮০ ভাগ ক্ষতি হয়েছে। গোল আলু চাষ হয়েছে ১০৫০ হেক্টর জমিতে, যার ৯০ ভাগ ক্ষতি হয়েছে। সাড়ে ৭শ’ হেক্টর জমির মিষ্টি আলুর ৬০ ভাগ ক্ষতি হয়েছে। ২৬ হাজার হেক্টর জমির মুগডালের ক্ষতির পরিমাণ ৭০ ভাগ। প্রায় পাঁচ হাজার হেক্টর জমির ফেলন ডালের ক্ষতির পরিমাণ ৫০ ভাগ। একই ভাবে মরিচ, বাদাম, পেঁয়াজ, তিল ও শাকসবজিরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। রাঙ্গাবালী উপজেলা ঘুরে এসে কৃষি অফিসার জানান, রাঙ্গাবালীর চেয়ে গলাচিপা অঞ্চলে চাষীদের ক্ষতি বেশি হয়েছে। অধিকাংশ সরকারী খাল বেদখল হয়ে যাওয়ায় পানি অপসারণ বন্ধ হয়ে গেছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বাড়বে। ভোলায় আলুচাষী দিশাহারা নিজস্ব সংবাদদাতা ভোলা থেকে জানান, ভোলায় টানা তিন দিনের বৃষ্টিতে ক্ষেতে পানি জমে আলুর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কোন কোন ক্ষেতে আলু পচে যাচ্ছে। এতে শত শত কৃষক দিশাহারা হয়ে পড়েছে। বাধ্য হয়ে ক্ষেত থেকে কেউ কেউ অপুষ্ট আলু তুলে ফেলছে। এদিকে এসব আলু পাইকাররা না কেনায় ক্ষেত থেকে আলু তুলেও চরম বিপাকে পড়েছে চাষীরা। লাখ লাখ টাকা লোকসানের আশঙ্কা করছে কৃষকরা। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় চলতি মৌসুমে ভোলা জেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় তিন হাজার টন বেশি আলু উৎপাদন হয়েছে। গত বছরের তুলনায় এবার আলুর ফলনও ছিল ভাল। কিন্তু নিম্নচাপের প্রভাবে গত তিন দিনের বৃষ্টিতে অধিকাংশ ক্ষেতেই পানি জমে। এতে আলুতে পচন দেখা দিয়েছে। কোন কোন ক্ষেতের আলু গাছ উঠে যাচ্ছে। আলু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এ ভয়ে কৃষকরা বাধ্য হয়ে তড়িঘড়ি করে অপুষ্ট আলু তুলে ফেলছে। এদিকে পানি জমে যাওয়ায় ক্ষেত থেকে তোলা এসব আলু পরবর্তীতে দ্রুত পচে যেতে পারে আশঙ্কায় পাইকাররাও কিনছে না। এতে ক্ষতির মুখে পড়েছে তারা। ধার-দেনা করে যারা আলুর আবাদ করেছে তারা এখন চরম দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছে। ভোলা সদর উপজেলার ইলিশা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, আলুক্ষেতে নারী-পুরুষ-শিশু সকলেই মহাব্যস্ত। পানি থেকে যদি তাদের আলু রক্ষা করা যায় তাই সকলে আলু তুলছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক সামসুদ্দিন ও আলাউদ্দিন বলেন, আরও ১৫ থেকে ২০ দিন পরে আলু তুলতে পারলে তারা একরপ্রতি ২০-২৫ মণ বেশি আলু পেতেন। দিনাজপুরে কয়েক কোটি টাকার কাঁচা ইট নষ্ট স্টাফ রিপোর্টার দিনাজপুর থেকে জানান, বৃষ্টির কারণে বিভিন্ন ইটভাঁটির কাঁচা ইটের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ইটভাঁটি মালিকরা জানান, কাঁচা ইট নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তাদের উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। এর ফলে তাদের কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। দিনাজপুর ইটভাঁটি মালিক সমিতি সূত্রে জানা যায়, দিনাজপুরে প্রায় ২৫০টি ইটভাঁটি রয়েছে। হঠাৎ করে শুক্রবার রাত থেকে শনিবার দুপুর পর্যন্ত বৃষ্টির ফলে প্রতিটি ইটভাঁটিতে গড়ে ৩০ থেকে ৩৫ লাখ কাঁচা ইট নষ্ট হয়ে গেছে। শুকাতে দেয়া ইট নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সেগুলো মাঠ থেকে তুলে জমা করতে হবে। তারপর মাঠ পুরোপুরি শুকিয়ে আবার ইট তৈরি করতে হবে। এর ফলে বাড়তি শ্রমিক খরচ লাগবে।
×