ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ক্যাম্পাসে প্রথম দিন...

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ১২ মার্চ ২০১৭

ক্যাম্পাসে প্রথম দিন...

সকাল থেকেই মনটা খুব ফুরফুরে। রাতে ভাল ঘুম হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ক্লাস বলে কথা। ওরিয়েন্টেশন ক্লাসে পাশে এসে বসল একটি মেয়ে। পরিচিত হলাম একে অপরের সঙ্গে। মিষ্টি চেহারার মেয়েটি বলল- ‘এ বছরই ভর্তি হয়েছি। নতুন বিভাগে একটু ভয় ভয় লাগছে।’ তুমি কি আমার বন্ধু হবে? মেঘ না চাইতেই যেন বৃষ্টি! আমি তো এক বাক্যেই রাজি। ও মা! পরে দেখা গেল মেয়েটি আর কেউ নয়। বিভাগেরই বড় আপু। তৃতীয় বর্ষে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম দিনের এমন গোলমেলে পাকানো গল্প শোনাচ্ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী সাইমন জাহিদ। হাসতে হাসতে আরও যুক্ত করলেন, দিনটি ছিল একেবারেই অন্যকরম। সারা জীবন মনে রাখার মতো। উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে অনেকটা যুদ্ধময় পথ পাড়ি দিয়ে আসতে হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। তাই আনন্দটাও ছিল অনেক বেশি। খুব দ্রুতই পরিচিত হয়ে গিয়েছিলাম নতুন বন্ধুদের সঙ্গে। হাজারো স্বপ্নকে সারথী করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটে এসেছেন ফাতেমা আক্তার আশা। টাঙ্গাইল সদর থেকে আসা মেয়েটি পড়ছেন হিসাব বিজ্ঞান বিভাগে। বর্তমানে থাকেন রাজশাহী নগরীতে একটি মেসে। ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন সেই ক্লাস এইট থেকে। তখন টিভিতে বিজ্ঞাপন দেখে ভাবতামÑ এই মেয়েগুলো এত স্মার্ট হয় কীভাবে? খালামনির কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, ‘এর সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজনেস অনুষদে পড়ে’। তারপর থেকে বিজনেস অনুষদে পড়ার ইচ্ছা জেকে বসে আমার ভেতর।’ বলতে বলতে চোখজোড়া ঝকমকিয়ে উঠল আশার। একটু থেমে বললেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিনটি রাবি ক্যাম্পাসে হওয়ায় আমার আনন্দ ছিল অনেক বেশি। প্রথম দিন কোন ক্লাস হয়নি। শিক্ষকরা বিভিন্ন উপদেশ দিয়েছিলেন, যা সারা জীবন মনে রাখার মতো। একটু নার্ভাসনেস কাজ করছিল। কিন্তু প্রথমেই পরিচয় হয় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৌফিক তাজের সঙ্গে। বন্ধুত্ব হয় বিভাগের আরও অনেকের সঙ্গে। নতুন ক্যাম্পাসে নতুন বন্ধু। বেশকিছু মানিয়ে নিতে খুব বেশি দেরি হয়নি।’ এভাবেই ক্যাম্পাসের প্রথম দিনের কথা বলছিলেন আশা। ঝিনাইদহ থেকে তিন জেলা পাড়ি দিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছেন সুবির সাধুখাঁ। স্বপ্নবাজ এ তরুণের কাক্সিক্ষত বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভাগে ভর্তির সুযোগ পাওয়ায় তার আনন্দ যেন আকাশছোঁয়া। তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম ক্যাম্পাসের প্রথম দিনের অনুভূতি কেমন ছিল। হাসি মাখা মুখে সোজা উত্তর, এর চেয়ে বড় আনন্দের দিন আর হয় না। এরপর একটানা বলতে থাকলেন সুবির, কলেজে পড়ার সময় রাবি ক্যাম্পাসে ঘুরেছি। মতিহারের সবুজ চত্বর সেদিন আমাকে মুগ্ধ করেছিল। কিন্তু এই ক্যাম্পাসে ভর্তির পর ৬ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে ক্লাস করতে যাওয়ার দিনটি ভুলতে পারব না কোন দিন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজের ক্যাম্পাস ভাবতে পারার অনুভূতিটা বলে বোঝাতে পারব না। নুসরাত জাহান কণার অভিজ্ঞতা একটু অন্যরকম। বড় ভাই বোনদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে দেখেই ক্যাম্পাস প্রীতি জাগে তার মধ্যে। অনেক দিনের সেই স্বপ্ন সফলতার পথে যেন ভাবতেই পারছিলেন না তিনি। বললেন, ‘ক্যাম্পাসে প্রথম দিনের সে অনুভূতি এককথায় অসাধারণ।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলাম শিক্ষা বিভাগের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহিল বাকি। ক্যাম্পাসের প্রথম দিনটি কেমন ছিল? জানতে চাওয়া মাত্রই উত্তর, একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আমি? নিজের কাছেই এই অবিশ্বাস্য প্রশ্নটি করি। এমন নয়-ছয় ভাবতে ভাবতেই ক্লাসে গিয়ে বসি। আমার পাশেই ছিল তাসনিম। আমার ব্যাগে পানি দেখে প্রথম বন্ধু হয়ে হাত বাড়াল পানির আশায়। উষ্ণ আবেশে তার হাতে তুলে দিলাম হৃদয় শীতল করা পানির বোতলটি। হয়ে গেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বন্ধু। এভাবেই বলে যাচ্ছিলেন আব্দুল্লাহ। বন্ধুর সঙ্গে সুর মেলাল একই বিভাগের নাজমা খাতুন। তিনি বললেন, ‘প্রথম থেকেই ঢাবিতে পড়ার প্রবল ইচ্ছা ছিল। প্রথম বারেই চান্স পাওয়ায় অনেক খুশি হয়েছিলাম। আগে থেকেই শুনতান ঢাবির শিক্ষার্থীরা কো অপারেটিভ হয়। প্রথম দিন ক্লাস করতে গিয়েই সেটা বুঝতে পেরেছিলাম। বিভাগের বড় ভাইয়া-আপুরা আমাদের বরণ করে নিয়েছিল আপনের মতো করে।’ ‘প্রথম ক্লাসে বড় ভাইয়ারা এসে গান করতে বলেছিল। আমরা তো প্রথমে একটু ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম।’ এভাবেই ক্যাম্পাসে প্রথম দিনের কথা বর্ণনা করছিলেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থী রাবেয়া খাতুন নিতু। আর বলেন, ‘অনেক ভাললাগার অনুভূতিতে পূর্ণ ছিল ক্যাম্পাস জীবনের প্রথম দিনটি। বিভাগের বড় ভাইয়া-আপুরা ফুল দিয়ে বরণ করে নিয়েছিল। আবদুল জলিল স্যারের কথাগুলো কোন দিন ভুলতে পারব না।’ ‘তিনি বলেছিলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় হলো নতুন নতুন জ্ঞানের উদ্ভব ঘটানোর স্থান। তাই এখানে এসে চিন্তা ভাবনার প্রসার ঘটাতে হবে। যা অন্যের থেকে তোমাকে সতন্ত্র করে তুলবে।’ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আসাদুজ্জামান। ক্যাম্পাসের প্রথম দিনটি সম্পর্কে জানতে চাইলে খোলা মেলা উত্তর, রংপুরের বদরগঞ্জ থেকে ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসেই পাহাড়ে ঘেরা এই ক্যাম্পাসের প্রেমে পড়ে যাই। যখন প্রথম ক্লাস করতে রুম থেকে বের হই তখন থেকেই যেন আনন্দ পিছু হটছিল না। এই দিনটির অপেক্ষায় ছিলাম অনেক দিন থেকে। ক্লাসে গিয়ে বসার সঙ্গে সঙ্গেই মনের মাঝে আনন্দময় একটি ভাবনা উঁকি দিল, আমি আজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আর কলেজে পড়ি না। এটা ভাবতে অনেক ভাল লেগেছিল। যা বলে বোঝাতে পারব না। প্রথম দিনে স্যারের একটি উদাহরণ আমি কখনও মন থেকে সরাতে পারব না। তিনি বলছিলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ হলো ঘোড়ার মতো, আর আমেরিকানরা বানরের মতো। কারণ, আমাদের অনেক কষ্ট করতে হয়।’ এখনও কাজে হাপিয়ে গেলে স্যারের সেই কথাটি মনে করে সামনে চলার সাহস পাই। কথা হলো রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বজরুল হুদা হিমেলের সঙ্গে। পড়ছেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে। গ্রামের বাড়ি লালমনিরহাটের আদিতমারি থানায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর প্রথম দিনটি কেমন ছিল? জানতে চেয়েছিলাম তার কাছে। বললেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করাটা আমার কাছে ছিল স্বর্গসুখের মতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিনটির জন্য অনেক রাত ঘুম আসেনি আমার। ভর্তির পর যখন বাসায় ছিলাম তখন আম্মুকে বার বার বলতাম, আমার ক্লাস কবে শুরু হবে? কবে আমি নিজেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে পরিচয় দিতে পারব? আরও কত কি। বিশেষ করে ক্লাস শুরুর আগের রাতে দুই চোখের পাতা এক হয়নি। কেননা ওই দিনটিই ছিল আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিন। তবে ক্যাম্পাসের প্রথম দিনটি আমার কাছে আনন্দ ও দুঃখের মধ্য দিয়েই শেষ হয়েছে। তবে বিভাগের হলরুমে ওই দিনের ক্লাসে আমার দুঃখ হলো দেরিতে বিভাগে যাওয়ার কারণে সবার মতো আমি ফুল পাইনি। এই দুঃখ আমার সারা জীবন থাকবে বলেই মিষ্টি একটি হাসি দিয়ে কথা শেষ করেন হিমেল। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে পড়ছেন আরিফুল ইসলাম। বলছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন সফল হয়েছে। এতে আমি খুব খুশি। সঙ্গে আমার পরিবারের সদস্যরাও। তাই স্বভাবতই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম দিনের ক্লাস আমার কাছে একটু ভিন্ন আনন্দ বয়ে এনেছিল এটা আর বলে বোঝাতে হবে না নিশ্চয়। স্যারের একটি কথা প্রথম দিন থেকেই তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে আমায়। তিনি বলেছিলেন, ‘প্রথম বর্ষকে হেলায় কাটিও না।’ টাঙ্গাইলের মওলানা ভাষানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনফর্মেশন এন্ড টেকনোলজি বিভাগের শিক্ষার্থী রুহুল আমিন বলছিলেন তার প্রথম দিনের অভিজ্ঞতার কথা, ‘ছোট বেলা ভয়ে ভয়ে স্কুলে যাওয়ার মতোই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম ক্লাস করতে গিয়েছিলাম। তবে ভর্তির সময় আব্বুর সঙ্গে কয়েকবার ক্যাম্পাসটি ঘুরে দেখার কারণে ওই দিন বিভাগের হলরুমটি খুুঁজে পেতে কষ্ট হয়নি। ঠিক সকাল ১০টায় গিয়ে বসি প্রথম ক্লাস করতে। ছেলেদের মধ্য থেকে একজন ও মেয়েদের থেকে একজনের হাতে তুলে দেন ফুলের স্টিক। তারপর বিভাগের বড় ভাইয়া ও আপুরা আমাদের সবার হাতেই একে একে তুলে দেন সেই ফুলের স্টিক। আর সেই সঙ্গে নিজেকে মনে হতে থাকে আমিও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এটা ভাবতে ভালই লাগছিলো।’ এভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম জীবনের কিছু অভিজ্ঞতা বলছিলেন রুহুল। তবে সেদিনের কিছু উপদেশের কথা কোন দিন ভুলব না। এক শিক্ষক একটি উদাহরণ টেনে বলেছিলেন, ‘একটি পণ্য তৈরি করতে যেমন মেশিনকে ভাল হতে হয়, ঠিক তেমনি ভাল থাকতে হয় কাঁচামালকেও। আর বিশ্ববিদ্যালয় হলো সেই মেশিনের মতো, এখানকার শিক্ষার্থীরা হলো কাঁচামাল। এর একটির সমস্যা হলে বিনষ্ট হবে দুটিই। কাজেই তোমাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কখনও হেলায় গা ভাসিয়ে দিও না।’
×