ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বেড়েছে গ্রামীণ জীবনমান

এশিয়ায় গ্রাম পর্যায়ে বেশি পাকা সড়ক বাংলাদেশে

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১২ মার্চ ২০১৭

এশিয়ায় গ্রাম পর্যায়ে বেশি পাকা সড়ক বাংলাদেশে

সমুদ্র হক ॥ গ্রামের বেশিরভাগ সড়ক এখন পাকা। যমুনার চরেও পাকা সড়ক তৈরি হয়েছে। গত নয় বছরে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে গ্রামের সড়ক ব্যবস্থায়। এই সড়ক গ্রামের অর্থনীতির চালিকাশক্তি আরও সুদৃঢ় করছে। দারিদ্র্য কমছে দ্রুত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বগুড়ার সান্তাহারের জনসভায় বলেছেন, সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় শীঘ্রই সকল ইউনিয়নের সঙ্গে পাকা সড়কের সংযোগ স্থাপিত হবে। সূত্র জানায়, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে গ্রাম পর্যায়ে পাকা উন্নত সড়ক বেশি। গ্রাম পর্যায়ে প্রতি একশ’ বর্গকিলোমিটার এলাকায় পাকা সড়ক ২শ’ ৩০ কিলোমিটার। একই আয়তনে পার্শ¦বর্ত্তী দেশ ভারতে এই হার ১শ’ ৩৬ কিলোমিটার। পাকিস্তানে ৩৫ কিলোমিটার ও নেপালে মাত্র ১৪ কিলোমিটার। উন্নয়নের ধারায় বলা হয়: কোন এলাকার উন্নয়নে পাকা সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার সঙ্গে বিদ্যুত পৌঁছানো গেলে উন্নয়নের বাকি কাজ আপন গতিতেই এগিয়ে যায়। বাংলাদেশ এই ধারায় এগিয়ে যাচ্ছে। প্রথমে গ্রামীণ সড়ক নির্মাণ, তার পরই বিদ্যুত পৌঁছানো। বাংলাদেশে গ্রামীণ সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়নে সরাসরি উপকৃত হচ্ছে গ্রামের বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ। পরোক্ষে উপকৃত হচ্ছে নগরীর মানুষ। কৃষি উৎপাদিত ফসল বিপণনে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। গ্রামের উৎপাদিত কৃষিপণ্যসহ কুটির শিল্পের পণ্য এখন দেশের প্রতিটি স্থান ছাড়াও বিদেশেও যাচ্ছে। বিদ্যুত ও সোলার প্যানেল পৌঁছে কুটির শিল্পের প্রসার ঘটেছে। বেড়েছে শিক্ষার হার। বিশেষ করে নারীশিক্ষা বেড়ে নারী উন্নয়নের নানা ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। উন্নয়নের এই ধারার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তথ্য যোগাযোগ ও প্রযুক্তি (আইসিটি)। প্রযুক্তির এই বিস্তারে কৃষক পরিবারের জীবনমান বেড়েছে। গাঁয়ের বধূ এখন স্মার্টফোনে যোগাযোগ করতে পারে। তারাও ভাইবার স্কাইপেতে বিদেশে স্বজনদের সঙ্গে ছবি দেখে, কথা বলে। যাদের এক সময় চাষাভুষা বলা হতো তাদের সন্তানরা বিদেশবিভূঁইয়ে গিয়ে রেমিটেন্স পাঠিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়িয়েছে। বেড়েছে সঞ্চয়ের হার। একটা সময় গ্রামের নারী-পুরুষ বিভিন্ন এনজিওর ক্রেডিট প্রোগ্রামের লোন নিত। এখন তা অনেক কমেছে। গ্রামের নারী-পুরুষ এখন জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের আওতায় পরিবার সঞ্চয়পত্রসহ সঞ্চয়ের নানা ক্যাটাগরির সঞ্চয়পত্র কেনে। আরেকদিকে গ্রামের নারী গার্মেন্ট সেক্টরকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। গার্মেন্টে নারীশ্রমিক বেশি। তৈরি পোশাক রফতানিতে বৈদেশিক মুদ্রা আসছে। বাংলাদেশে উপজেলা সড়ক, ইউনিয়ন সড়ক ও গ্রাম সড়কগুলো চারটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। বর্তমানে সব মিলিয়ে গ্রামীণ বা পল্লী সড়ক প্রায় সাড়ে ৩ লাখ কিলোমিটার। এর বড় একটি অংশই পাকা। ভিশন ২০২১’র কর্মপরিধিতে বাকি কাঁচা সড়ক পাকা হয়ে যাবে এমনটিই আশা করা হয়েছে। গ্রামীণ সড়ক নির্মাণের প্রতিষ্ঠান স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি) সূত্র জানায়Ñগ্রামীণ সড়ক উন্নয়নের দুই- তৃতীয়াংশ কাজ করে সরকার। বাকিটা বিদেশী অর্থায়নে। এক তথ্যে দেখা যায় ১৯৯০ সালে গ্রামীণ পাকা সড়ক ছিল মাত্র ৮ হাজার ৬শ’ ৬০ কিলোমিটার। মাঠ পর্যায়ের চিত্র বলে দেয়: গ্রামে পাকা সড়ক হওয়ার সঙ্গে সব ধরনের যন্ত্রযান (বাস, মিনিবাস, ট্রাক, সিএনজি চালিত অটোরিকশা, টেম্পো, ব্যাটরি চালিত যান) একেবারে দোর গোড়ায় পৌঁছে। উপজেলার সঙ্গে জেলা শহরের যোগাযোগ এতটাই নিবিড় হয়েছে যে, জেলার কাছাকাছি উপজেলাকে জেলার অংশ বলেই মনে করা হয়। বগুড়ার সারিয়াকান্দি এলাকায় যমুনার অনেক চরেও পাকা সড়ক হয়েছে। আবার জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কের ধারে উপজেলা সত্তর দশকের জেলা শহরের মতোই মনে হয়। এসব সড়কের ক্রস পয়েন্টে (ফিডার সড়কের মোড়) বাস, সিএনজি চালিত অটোরিকশা, ব্যাটারি চালিত যানবাহন স্ট্যান্ড গড়ে ওঠায় সেখানে আধুনিক দোকানপাট বসেছে। কোথাও মার্কেট হয়েছে। উপজেলা সদরেও শহরের ডিপার্টমেন্ট স্টোরের মতো দোকানপাট স্থাপিত হয়েছে। উন্নত সড়ক ব্যবস্থার কারণে কৃষি উপকরণ বিশেষ করে সার-ডিজেল এখন কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে। কৃষক তার উৎপাদিত পণ্য কখনও পাওয়ার টিলারের সঙ্গে ট্রলি এঁটে, কখনও মিনিট্রাকে করে দ্রুত নিয়ে যাচ্ছে হাটবাজারে। কৃষি উপকরণের সহজ প্রাপ্তিতে এবং বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) নানা ধরনের ধান উদ্ভাবনে এখন ভরবছর কোন না কোন আবাদ হচ্ছেই। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে সবজি আবাদ বেড়ে বিদেশে রফতানি হচ্ছে। বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের ধারে কয়েক কিলোমিটার জুড়ে প্রতিদিন কলা ও শাক-সবজির হাট বসে। এসব পণ্য ট্রাকের পর ট্রাকে চলে যায় পূর্বাঞ্চলের দিকে। নওগাঁ ও বগুড়ার বিভিন্ন হাটবাজারে গড়ে উঠেছে চালের আড়ত। অনেক উন্নত চাল ফ্যাক্টরি স্থাপিত হয়েছে এসব এলাকায়। বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে বর্তমানে সকল ধরনের আবাদ বেড়ে গিয়ে সেখানে দারিদ্র্যতা এতটাই কমেছে যে এখন আর কোন কামলাকিষান, দিনমজুর ওই অঞ্চল থেকে দেশের কোথাও যায না। এক গবেষণায় বলা হয়েছে, যেখানে গ্রামীণ পর্যায়ে উন্নত সড়ক ব্যবস্থা আছে সেখানে দারিদ্র্যতার হার ২৪ ভাগে নেমে এসছে। পাকা সড়ক না থাকায় সময় এই হার ছিল ৬০ শতাংশ। একই সঙ্গে এই এলাকায় সঞ্চয়ের হার ৩৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬১ শতাংশে ঠেকেছে। গ্রামের মানুষ অস্তিত্ব রক্ষায় নিজের গরজেই উন্নয়নকে কাজে লাগাচ্ছে। ফলে জীবনমান বেড়েছে। জীবনমান উন্নত হওয়ার সঙ্গে অবকাঠামো স্থাপনা বিশেষ করে বসতভিটা পাকা হতে থাকে। এ কাজ অনেকটা এগিয়ে দেয় রেমিটেন্স পাঠানো ব্যক্তিরা। রেমিটেন্সে গ্রামের মানুষ প্রথমেই দুটি কাজ শুরু করে। তা হলো খড়ের বাড়ি উঠিয়ে দিয়ে টিনের অথবা পাকা বাড়ি নির্মাণ ও জমি কেনা। এরপর পাকা বাড়ি সাজাতে বৈদ্যুতিক পাখা, আসবাবপত্র, রঙিন টিভি, রেফ্রিজারেটর (ফ্রিজ), ওভেন, কম্পিউটার কেনে। গ্রামে লিকুফায়িড পেট্রোলিয়াম (এলপি) গ্যাস সিলিন্ডার পৌঁছে রান্না হচ্ছে। সাফল্য এসেছে শিক্ষার বিস্তারে। উন্নত সড়কের গ্রামগুলোত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা হার শতভাগের কাছাকাছি ঠেকেছে। মেয়ে শিক্ষার হার বেড়ে ড্রপআউট কমেছে। বাল্যবিয়ের হার কমেছে। বিশেষ করে শিক্ষিত মেয়েদের কম বয়সে বিয়ের কথা হলে তারাই বিয়ে ঠেকিয়ে দেয়। তথ্য প্রযুক্তির প্রভাব এতই বেশি যে গ্রামের প্রায় প্রত্যেকের হাতেই আছে সেলফোন। যে কৃষকের অক্ষরজ্ঞান কম তারাও এখন মোবাইল ফোনে নম্বর সেভ করে কথা বলে। শিক্ষিত তরুণ-তরুণী স্মার্টফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ ব্যবহার করে। গ্রামীণ জীবনমান উন্নত হওয়ার অন্যতম কারণ পাকা সড়ক।
×