এম এ রকিব ॥ এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে/যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান/জাতি গোত্র নাহি রবে...। জাতি গোত্রের উর্ধে ওঠে মানুষ পরিচয় ধারণ করেছিলেন লালন। অসাম্প্রদায়িক মহাত্মার এই দর্শন পৃথিবীকে শান্ত করতে পারে। শান্তি করতে পারে। আজ তা প্রমাণিত। মহাপ্রয়াণের বহু বহু কাল পরও তাই উদার লালন হয়ে ওঠেন মানুষের নিশ্চিত আশ্রয়। কুষ্টিয়ার আখড়া বাড়িতে সারা বছরই চলে মানুষ হওয়ার সাধনা। তবে এখন উপস্থিতি বেড়ে কয়েকগুণ হয়ে গেছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ভক্ত অনুরাগীরা সমবেত হয়েছেন ছেউড়িয়াতে। উপলক্ষ দোল পূর্ণিমা উৎসব।
লালন গবেষকদের মতে, দোল পূর্ণিমার সঙ্গে প্রেমময় আত্মার সম্পর্ক স্মরণীয় করে রাখতে প্রতিবছর এই রাতে লালন শাহ নিজেই ভক্ত শিষ্যদের নিয়ে ঘটা করে উৎসবটি পালন করতেন। তারপর থেকে লালনের ভক্ত অনুসারীরা উৎসবটি পালন করে আসছেন। এরই ধারাবাহিকতায় প্রতিবছর লালন স্মরণোৎসবের আয়োজন করে কুষ্টিয়া লালন একাডেমি। শনিবার থেকে শুরু হয়েছে এবারের আয়োজন। তিনদিনব্যাপী আয়োজনের মূল সেøাগান ‘আর কি হবে এমন জনম।’ আয়োজনের উল্লেখযোগ্য দিক বাউল সমাবেশ।
সাধুসংঘের রীতি অনুযায়ী, দোল পূর্ণিমার সন্ধ্যায় ‘রাখল সেবা’র মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে বাউলদের দেড় দিনের মূল উৎসব। চলবে রবিবার দুপুরে ‘পূর্ণ সেবা’ পর্যন্ত। সারা রাত ধরেই চলবে গান ও তত্ত্ব আলোচনা। বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে পালন করা হবে নানা আচার। গানে গানে মনের মানুষের খোঁজ করছেন সাধুরা। এছাড়া উন্মুক্ত মঞ্চে প্রতিদিন সন্ধ্যায় থাকবে বিশেষ আলোচনা। একই মঞ্চে রাতে গানে গানে লালনকে তুলে ধরবেন শিল্পীরা। মঞ্চ ঘিরে বসেছে মেলা গ্রামীণ মেলাও। সাধানযন্ত্র একাতারা-দুতরা ঢোল, বাঁশিসহ নানা কারুকপণ্যের পসরা সাজিয়েছেন দোকানিরা। লোকশিল্পের নানা নিদর্শন শেকড়ের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।
লালনের জীবন-কাহিনী অনেকাংশেই রহস্যাবৃত। তার জীবনের ধারাবাহিক ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে গবেষক ও ইতিহাসবিদদের বিভিন্ন তথ্য, জনশ্রুতি বা অনুমানের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। লালনের জন্ম, জাত ও ধর্ম নিয়েও যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। লালন নিজেও তার জাত-ধর্ম সম্পর্কে নিস্পৃহ ও উদসীন ছিলেন। তার জাত-ধর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হয়ে তাই তিনি জবাব দিয়েছেন, ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে। লালন বলে জাতের কি রূপ দেখলাম না এ নজরে’। জানা যায়, লালন শাহ ১৭৭৪ সালে বর্তমান কুষ্টিয়া (তৎকালীন নদীয়া) জেলার কুমারখালী থানার চাপড়া ইউনিয়নের অন্তর্গত গড়াই নদীর তীরবর্তী ভাড়ারা গ্রামের (চাপড়া গ্রামসংলগ্ন) হিন্দু কায়স্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মাধব কর ও মাতা পদ্মাবতী। মতান্তরে, লালন যাশোর জেলার হরিণাকু- থানার (বর্তমান ঝিনাইদহ জেলা) হরিশপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবারে ১৭৭৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম দরিবুলাহ দেওয়ান ও মাতার নাম আমিনা খাতুন। লালন ছিলেনÑ পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান। আর্থিক সঙ্কটের কারণে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করতে পারেননি। শৈশবে পিতৃ বিয়োগ হওয়ায় অল্প বয়সেই তার ওপর সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে। ইতোমধ্যেই তার বিয়ে হয়। সাংসারিক চিন্তা ও আত্মীয়বর্গের বৈরিতা তাকে বিশেষ পীড়িত করে তোলে। একপর্যায়ে লালন সমাজ ও স্বজন কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে ব্যথিত ও অভিমানে চিরতরে গৃহত্যাগ করেন। পরে তিনি সিরাজ সাঁই নামের এক তত্ত্বজ্ঞানসিদ্ধ বাউল গুরুর সান্নিধ্যে এসে বাউল মতবাদে দীক্ষা গ্রহণ করেন। বাউল মতবাদে দীক্ষা গ্রহণের পর গুরুর নির্দেশে লালন কুষ্টিয়া শহরের নিকটবর্তী কালীগঙ্গা নদীর (বর্তমানে বিলুপ্ত) তীরে ছেঁউড়িয়া গ্রামে এসে বাংলা ১৮২৩ সাল মতান্তরে ১৮৩০ সাল নাগাদ আঁখড়া স্থাপন করেন। অল্প দিনের মধ্যেই লালনের প্রভাব ও পরিচিতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। পরে গ্রামের লোকেরা আঁখড়া তৈরি করে দেয়। লালনের সঙ্গীত ছিল অধ্যাত্ম ভাবাবেগের অমিয় ফসল। লালন মুখে মুুখে গান রচনা করতেন আর তার শিষ্যরা সেগুলো খাতায় লিখে রাখতেন। লিপিকরের কাজ করতেন মানিকশাহ ওরফে মানিক প-িত ও মনিরুদ্দীন শাহ।