ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অগ্নিঝরা মার্চ

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১২ মার্চ ২০১৭

অগ্নিঝরা মার্চ

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ অগ্নিঝরা মার্চের আজ ১২তম দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ, বিদ্রোহ-বিক্ষোভে সুপ্ত আগ্নেয়গিরি ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠেছিল। শিকল ছেঁড়ার অদম্য আকাক্সক্ষায় দুরন্ত-দুর্বার হয়ে উঠেছিল বীর বাঙালী জাতি। একাত্তরের এদিন চিরপরিচিত শাপলাকে আমাদের জাতীয় ফুল করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। শিল্পী কামরুল হাসানের আহ্বানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে আয়োজিত শিল্পীদের এক সভায় এ ঘোষণা দেয়া হয়। ঘোষণা শেষে মুক্তিকামী মানুষকে সেদিন আরও বেশি উৎসাহী করে তুলতে তাঁরা প্রতিবাদী পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুন বিলি করেন। একাত্তরের ১১ মার্চ জাতিসংঘের তদানীন্তন মহাসচিব উ থান্ট এক নির্দেশে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত জাতিসংঘের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী যেন সদর দফতরে ফিরে যান। এ নির্দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ক্ষুব্ধ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বাংলাদেশের মানুষও এ পৃথিবীর বাসিন্দা। তাদের প্রতিও জাতিসংঘের দায়িত্ব রয়েছে। একাত্তরের এ দিনে জাতীয় পরিষদ সদস্য মোহাম্মদ জহির উদ্দিন পাকিস্তান সরকার প্রদত্ত খেতাজ বর্জন করেন। রাওয়ালপিন্ডিতে এক সরকারী ঘোষণায় আগামী ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসের নির্ধারিত সম্মিলিত সশস্ত্র বাহিনীর কুচকাওয়াজ, খেতাব বিতরণ ও অন্যান্য অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়। চলচ্চিত্র প্রদর্শকরা আজ বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ঢাকাসহ সারাদেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেন। ময়মনসিংহে এক জনসভায় ন্যাপপ্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সাত কোটি বাঙালীর মুক্তি সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি তাঁর সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, আমি জানি শেখ মুজিবুর রহমান কখনই জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে না। আপনারা শেখ মুজিবের ওপর সম্পূর্ণ ভরসা রাখুন। মওলানা ভাসানী পশ্চিম পাকিস্তানী প্রগতিশীল নেতাদের উদ্দেশে জনসভায় বলেন, আল্লাহর ওয়াস্তে আপনারা বাঙালীদের ব্যাপারে নাক গলাবেন না। লাহোরে স্থানীয় বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিকসহ ছাত্র, শ্রমিক ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতারা এক যুক্ত বিবৃতিতে অবিলম্বে বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান। রেডিও পাকিস্তান করাচী কেন্দ্রের খ্যাতনামা বাংলা খবর পাঠক সরকার কবীর উদ্দিন বেতারে বঙ্গবন্ধুর খবর প্রচারে নিয়ন্ত্রণ আরোপের প্রতিবাদে রেডিও পাকিস্তান বর্জন করেন। বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এক বিবৃতিতে স্বাধীনতা সংগ্রাম বানচালে প্রয়াসী বৃহৎ ব্যবসায়ী ও মজুদদারদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়। অপর এক বিবৃতিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যবহারের জন্য কোন জ্বালানি সরবরাহ না করতে সংশ্লিষ্ট সরবরাহকারীদের নির্দেশ দিয়ে বলা হয়, গণদুশমনদের কোনভাবে সাহায্য করা হলে তেল কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে চরম ব্যবস্থা নেয়া হবে। মুক্তিপাগল বাঙালীর এমন অদম্য অগ্রগতিতে ক্রমেই স্তিমিত হতে থাকে পাকিস্তানী বাহিনীর কর্মকা-। লাগাতার অসহযোগ আন্দোলনের ফলেই পূর্ব বাংলায় থাকা পাকিস্তানী সামরিক জান্তারা দমে যেতে থাকে। মার্চের শুরুতে পতাকা উত্তোলন এবং ইশতেহার পাঠের পর থেকে বাঙালীর স্বাধীনতাপ্রাপ্তির আকাক্সক্ষা আরও তীব্র হতে থাকে। পেশাজীবীরা পথে নেমে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। বাংলাদেশে পাকিস্তানী শাসন ব্যবস্থা বলে কিছু নেই। শুধুমাত্র ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া পুরো বাংলাদেশের সমস্ত কিছু পরিচালিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর অঙ্গুলি হেলনে। একাত্তরের এ দিনে পূর্ব পাকিস্তানের সিভিল সার্ভিস এ্যাসোসিয়েশনের বাঙালী কর্মকর্তারা স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। তারা আন্দোলনে অর্থের যোগান দিতে তাদের একদিনের বেতন দেয়ার ঘোষণা দেন। এ দিনে রাস্তায় নেমে আসেন শিল্পী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কর্মজীবী সবাই। তারা সেøাগানে সেøাগানে মাতিয়ে রাখেন ঢাকার রাজপথ। পূর্ব পাকিস্তানের সাংবাদিক ইউনিয়ন আন্দোলনকে জোরদার করতে, আরও সংঘবদ্ধ করতে রাজপথে নেমে আসে। পাকিস্তানবিরোধী সেøাগানে রাজপথকে উত্তাল করে তোলে জনতা। শিল্পী মর্তুজা বশীর ও কাইয়ুম চৌধুরীর নেতৃত্বে এ দিন চারুশিল্প সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামে এ পরিষদ বিশেষ ভূমিকা রাখে। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শুধু সংগ্রাম, মিছিল-সমাবেশই নয়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সারাদেশেই যুবসমাজকে একত্রিত করে চলতে থাকে গোপনে গেরিলাযুদ্ধের প্রশিক্ষণ। গোপনে অস্ত্র-গোলাবারুদও যোগাড় চলতে থাকে নানা মাধ্যম থেকে। আর এ প্রশিক্ষণ আর অস্ত্র যোগানে সাহায্য করে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীতে থাকা কিছু বাঙালী অফিসার-জওয়ান ও অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা-সৈনিকরা। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণেই জাতির সামনে স্পষ্ট বার্তা এসে গেছে, বিনা যুদ্ধে পাক হানাদাররা কিছুই মেনে নেবে না। আসবে না হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন মহান স্বাধীনতা। যুদ্ধ করেই যে দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করতে হবে, এটি বুঝতে পেরেই সারাদেশে বীর বাঙালীরা নিতে থাকে রণ প্রস্তুতি।
×