ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মুফতি হান্নান ছিনতাই চেষ্টার ষড়যন্ত্র হয় গত ডিসেম্বরে

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ১২ মার্চ ২০১৭

মুফতি হান্নান ছিনতাই চেষ্টার ষড়যন্ত্র হয় গত ডিসেম্বরে

শংকর কুমার দে ॥ ফাঁসির দ-প্রাপ্ত হুজি প্রধান মুফতি আবদুল হান্নানের ছিনতাইয়ের চেষ্টা চক্রান্তের পেছনে দেশী-বিদেশী যোগসাজশের আভাস পেয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা। জঙ্গী সদস্যদের কাছে কারাগার থেকে তাকে মুক্ত করার জন্য জিহাদের ডাক দেয়াসংবলিত একটি অডিওবার্তা আলজাজিরা টেলিভিশনে প্রচারে পাঠায় মুফতি হান্নান। হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশের (হুজি-বি) সঙ্গে আরেক নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) মুফতি হান্নানসহ ১৯ জঙ্গী ছিনতাই চেষ্টার সঙ্গে জড়িত। প্রিজনভ্যান থেকে জঙ্গী সদস্যদের ছিনতাইয়ের ঘটনা সফল হলে আলজাজিরা টেলিভিশনে প্রচার হতো বলে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের দাবি। মুফতি হান্নানের নির্দেশে গত সাত বছরে তেরোটি জঙ্গী হামলা ও নাশকতার ঘটনা ঘটিয়ে অন্তত ১০১ জন নিহত ও ৬০৯ জন আহত করেছে। তার জঙ্গী সংগঠন হুজি-বির ভয়ঙ্কর জঙ্গী হামলার একটি ও দুটি হামলাচেষ্টার ঘটনার মূল লক্ষ্যবস্তু ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, হুজি প্রধান মুফতি হান্নানকে ছিনতাইয়ের ষড়যন্ত্র হয় প্রায় তিন মাস আগে গত ডিসেম্বরে। গত ৭ ডিসেম্বর সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ তার ফাঁসির আদেশ বহাল রাখার পরই তাকে ছিনিয়ে নেয়ার ছক কষা হয়। এর পরের মাস জানুয়ারিতে কাশিমপুর কারাগার এলাকা রেকি করে হুজি বি ও এবিটি দুই গোষ্ঠীর জঙ্গীরা। ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও শাহজাহানপুর এলাকায় তিন জঙ্গী গ্রেফতার হওয়ার পর মুফতি হান্নানকে ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা ফাঁস হয়ে যায়। এরপর মার্চ মাসেই মুফতি হান্নানসহ ১৯ জঙ্গীকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টার ঘটনা ঘটে। এ ছিনতাইচেষ্টার ঘটনার সঙ্গে যে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র রয়েছে তার কিছু আলামত পেয়েছেন গোয়েন্দারা। গোয়েন্দা সূত্রমতে, হুজিপ্রধান মুফতি হান্নানকে ছিনতাইচেষ্টার তথ্য প্রথম ফাঁস হয় গত ফেব্রুয়ারি মাসে। মোহাম্মদপুর ও শাহজাহানপুর থেকে আবু বক্কর সিদ্দিক মাহমুদ ওরফে আল হাদি (২২), জাভেদ হোসাইন (১৯) ও সালেহ আহমদ (৪৯) নামের তিন জঙ্গীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাদের গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে মুফতি হান্নানের ছিনতাইচেষ্টার চক্রান্তের কথা প্রথম জানতে পারেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তিন জঙ্গীকে গ্রেফতারের পর শাহজাহানপুর থানায় পুলিশের পক্ষ থেকে যে মামলা করা হয়েছে, তাতে উল্লেখ করা হয়, কারাগার থেকে আদালতে আনা-নেয়ার পথে মুফতি হান্নানকে ছিনিয়ে নিতে হবে। আটক তিন জঙ্গীর অন্যতম সালেহ জিজ্ঞাসাবাদে এ তথ্য জানায়। সালেহর সঙ্গে জড়িত আরও অন্তত ৪-৫ জঙ্গী। জিজ্ঞাসাবাদে সালেহ জানায়, তার সঙ্গে জঙ্গী সালমান ও জুনায়েদ রয়েছে। মুফতি হান্নান গ্রেফতার হওয়ার পর জুনায়েদ আনসারুল্লা বাংলা টিমের সঙ্গে যুক্ত হয়। হুজির পুরনো সদস্য জুনায়েদ ও এবিটির সালমান মুফতি হান্নান ও বিপুলকে ছিনিয়ে নিতে মাহমুদ ও জাভেদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করে। এর পরই মুফতি হান্নানকে ছিনিয়ে নিতে মাঠে নামে জঙ্গীগোষ্ঠী। জিজ্ঞাসাবাদে মাহমুদ ও জাভেদ জানিয়েছে, গত জানুয়ারিতে মুফতি হান্নানকে ছিনিয়ে নেয়ার জন্য কাশিমপুর কারাগার এলাকায় রেকি করা হয়। সিলেটে সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলার দায়ে হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নানসহ তিন জঙ্গীর মৃত্যুদ-াদেশ বহাল রেখে আপীল বিভাগের দেয়া রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করা হয় গত ১৯ জানুয়ারি। এর পরই মুফতি হান্নান তার নেতৃত্বাধীন নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠনকে নতুন করে সংগঠিত করার জোর উদ্যোগ গ্রহণ করে। কারাগার থেকে কিভাবে মুক্ত হওয়া যায় সে ছকও কষতে থাকে। পাশাপাশি কারাগার থেকে একটি জিহাদী অডিওবার্তা পাঠায় বাইরের সহযোগীদের কাছে। তার এই জিহাদী ডাকের অডিও আলজাজিরা টেলিভিশনে প্রচারের কথাও বলে মুফতি হান্নান। মুফতি হান্নানসহ ১৯ জঙ্গীকে ছিনতাইচেষ্টার ঘটনাটি পুলিশের পাশাপাশি তদন্ত করছে গোয়েন্দা সংস্থাও। হুজিপ্রধানকে কারাগার থেকে কিভাবে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টার ঘটনার ছক কষেছে সে বিষয়ে বেশকিছু অভিযোগ ও তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। এর মধ্যে কারাগারে মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, ফেসবুক, বিকাশের এ্যাকাউন্ট পরিচালনার মতো সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার যেসব অভিযোগ তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফাঁসি কার্যকরের আগেই কমান্ডো হামলা চালিয়ে তাকে ছিনিয়ে নেয়ার নির্দেশও পাঠায় মুফতি হান্নান। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ফাঁসির আসামি মুফতি হান্নান নিজেই তাকে কারাগার থেকে ছিনিয়ে নেয়ার ছক কষেছে নাকি কারাগার থেকে আদালতে আনা-নেয়ার সময় অথবা কারাহাজত (গারদখানা) থেকে কিভাবে তাকে ছিনতাই করে নিয়ে যাওয়া হবে তারও ছক কষা এবং ছক বাস্তবায়নের জন্য জঙ্গীদের নির্দেশ পাঠায় স্বয়ং মুফতি হান্নান। এরপর উদ্দেশ্য কার্যকর করার উদ্যোগ নেয় জঙ্গীরা। মোস্তফা কামাল নামে এক জঙ্গী ধরা পড়লেও অন্য জঙ্গীরা পালিয়ে যায়। কমান্ডো হামলার মাধ্যমে মুফতি হান্নানকে ছিনিয়ে নেয়ার জন্য অন্তত এক ডজন জঙ্গী ছিল ঘটনাস্থলের আশপাশের এলাকায়। কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারের এক কর্মকর্তা বলেন, মুফতি হান্নান ফাঁসির আসামি হিসেবে তার রাজকীয় হালে আরাম-আয়েশে থাকার কোন সুযোগ-সুবিধা নেই। তবে যেসব অভিযোগ উঠেছে তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। গোয়েন্দা প্রতিবেদন সম্পর্কে তাদের কিছুই জানা নেই জানিয়ে কাশিমপুর কারাগারের এক কর্মকর্তা বলেন, মুফতি হান্নানকে ছিনিয়ে নেয়ার চক্রান্ত নস্যাত হওয়ার পর কারাগারে নিরাপত্তা আরও জোরদার করা হয়েছে। ঢাকা রেঞ্জের একজন কর্মকর্তা বলেন, মুফতি হান্নানসহ ১৯ জঙ্গীকে বহনকারী প্রিজনভ্যানের সামনে-পেছনে নিরাপত্তায় থাকা দুটি পুলিশের গাড়িতে ১৫ পুলিশ সদস্য ছিল। সাধারণত হাবিলদার পদমর্যাদার কোন কর্মকর্তার নেতৃত্বে প্রিজনভ্যানের নিরাপত্তা দেয়া হয়। তবে মুফতি হান্নানসহ ১৯ জঙ্গীকে বহনকারী প্রিজনভ্যানের নিরাপত্তা ‘এ’ গ্রেডে উন্নীত করা হয়। ২০১৪ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশালে তিন জঙ্গী বহনকারী পুলিশের প্রিজনভ্যানে হামলা চালায় নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবির সদস্যরা। পরে এক পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে সালেহীন ওরফে সালাউদ্দিন, বোমা মিজান ও হাফেজ মাহমুদ ওরফে রাকিব নামের তিন জঙ্গীকে ছিনিয়ে নেয়। পরে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে রাকিব মারা যায় আর বোমা মিজান ও সালেহীন পালিয়ে যায় প্রতিবেশী দেশ ভারতে। তিন বছর আগের ওই জঙ্গী হামলার পর কাশিমপুর কারাগারের ভেতর থেকে মোবাইল ফোনসহ বন্দীদের সঙ্গে বাইরের জঙ্গীদের যোগাযোগ ও চক্রান্ত হয়- কারা কর্তৃপক্ষ এমন তথ্য-আলামত পায়। আবারও তিন বছর পর একই কায়দায় মুফতি হান্নানসহ ১৯ জঙ্গী ছিনতাইয়ের চেষ্টা করা হয়। প্রসঙ্গত, গত সোমবার বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে ঢাকার আদালত থেকে কাশিমপুর কারাগারে মুফতি হান্নানসহ ১৯ জঙ্গীকে নেয়ার সময় টঙ্গী সরকারী কলেজগেট এলাকায় জঙ্গীরা বোমা হামলা চালায়। পুলিশ হামলায় জড়িত সন্দেহে ঘটনাস্থল থেকে মোস্তফা কামাল নামে এক যুবককে আটক করেছে। মোস্তফা কামালসহ অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করে সন্ত্রাস দমন আইনে টঙ্গী মডেল থানায় মামলা হয়। এ মামলায় কামালকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। গাজীপুর জেলা পুলিশ মিনহাজ নামে কামালের এক বন্ধুকে আটক করে। নরসিংদী থেকে গ্রেফতার হওয়া মোস্তফার আরেক সহযোগী জঙ্গীকে গ্রেফতার করার পর রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
×