ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

একুশ শতক ॥ ‘স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ প্রস্তাবের বিরোধিতা

প্রকাশিত: ০৩:৪২, ১২ মার্চ ২০১৭

একুশ শতক ॥ ‘স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ প্রস্তাবের বিরোধিতা

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস, জাতীয় পতাকা বা জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে যারাই লিখেছেন, তারা অনেক বিষয়কেই এড়িয়ে গেছেন। বিশেষ করে ১৯৬৬ সালের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক মেরুকরণটি কেউই তেমনভাবে ব্যাখ্যা করেননি। অনেকেই এটি মনে করেছেন যে, ছয় দফা কেবল একটি স্বায়ত্তশাসনের দাবি ছিল। এর অন্তর্নিহিত বিষয়গুলো যে বস্তুত পাকিস্তানের কার্যকারিতাকেই খতম করে দিয়েছিল এবং এর ফলে এই অঞ্চলের রাজনীতির মেরুকরণটা যে ভিন্নমাত্রা পেয়েছিল সেটি খুব সহজে কেউ অনুধাবন করেন না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক লেখকদের প্রথম প্রবণতাটি হচ্ছে ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর এটিই যেন স্বাধীনতার সময়। আমরা এই সময়ের মানুষকেই মুক্তিযোদ্ধা বলি এবং তাদেরকেই সনদ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা বানাই। অথচ সেই ৬২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আগরতলা গিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করার যে সুদৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং তার পরে ধাপে ধাপে ধর্মভিত্তিক একটি রাষ্ট্রকে ভেঙ্গে ভাষাভিত্তিক একটি রাষ্ট্র নির্মাণে যে অসাধারণ নেতৃত্ব প্রদান করেন সেটি আলোচনাতেই আনি না। এর একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বাধীন তরুণ অংশটি ছাড়া ২৬ মার্চের আগে আর কেউ সশস্ত্র যুদ্ধের কথা ভাবেইনি। এমনকি মার্চ মাসেও মনে করা হয়েছে যে, ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলোচনা সফল হবে-বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন এবং আওয়ামী লীগের সাংসদরা মন্ত্রী হবেন। দ্বিতীয়ত হচ্ছে আওয়ামী লীগসহ তৎকালীন রাজনৈতিক দলগুলো ধীরে ধীরে একটি সশস্ত্র লড়াইতে কেমন করে যুক্ত হয় সেটি কেউ আলোচনা করতে চান না। খুব সাম্প্রতিককালে এসব বিষয় আলোচনা করে বেশ কটি বই প্রকাশ হয়েছে। কোন কোন বইতে এসব বিষয় বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। কোন কোন বইতে লেখকগণ তাদের পছন্দের লোকজনকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করেছেন। অনেকেই এটি এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেন যে, আওয়ামী লীগ ঘরানাতেও স্বাধীনতার বিপক্ষের নেতা-কর্মী কম ছিল না। ইতিহাসের পাতা থেকে একটি অতি সাধারণ দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে পারি। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ হলের ছাত্র। বলতে গেলে সারাদিন রাজপথে কাটে। আফতাব আমাকে দিয়ে পোস্টার লেখায়, সেøাগান দেয়ায়। মাহবুব ভাই পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করে দিয়ে সারাদিনের এনার্জি জোগান দেন। আমাদের মাঝে তখন জয় বাংলা সবচেয়ে জনপ্রিয় সেøাগান। আমরা তখন বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে মিছিল কুচকাওয়াজ করছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সেøাগান তখন রাজপথে। কিন্তু এটি খুব স্পষ্ট করে বলা দরকার যে, সিরাজুল আলম খানের শিষ্যরা ছাড়া আর কেউ এমন সেøাগান উচ্চারণ করেনি। আওয়ামী লীগের ভেতরে ও ছাত্রলীগ এবং শ্রমিক লীগসহ অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনের ভেতরেও তখন দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করছিল। আওয়ামী ঘরানার বাইরে যারা, এমনকি বাম রাজনীতি করতেন তারাও জয় বাংলা সেøাগান তো দূরের কথা স্বাধীন বাংলার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েই বিবেচনা করেনি। তাদের মাথায় তখন পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি আর দুনিয়ার মজদুর বিরাজ করত। ১১ দফার একটি দফা ছাড়া বাকি দফাগুলোর দিকে তাকালে এর সত্যতা পাওয়া যাবে। ছাত্রলীগের কথাই বলি। তখন নূরে আলম সিদ্দিকী বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি ও শাজাহান সিরাজ সাধারণ সম্পাদক। আমরা শাজাহান সিরাজের ঘরানার মানুষ। নূরে আলম সিদ্দিকী আমাদের বিপরীত ঘরানার নেতা। তখন আমরা জয় বাংলা সেøাগান দিলে নূরে আলম সিদ্দিকীর সমর্থকরা চুপ করে থাকে। আমরা বীর বাঙালী অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর সেøাগান দিলেও ওরা চুপ করে থাকে। ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপ তখন জয় সর্বহারা ও ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া গ্রুপ জয় জনতা, জয় সমাজতন্ত্র সেøাগান দেয়। তখনও বাংলাদেশের বাম রাজনীতিকরা শেখ মুজিবকে সাম্রাজ্যবাদ, আমেরিকার দালাল বলে চিহ্নিত করে। বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য ছাত্রলীগের এই অংশ এ ধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলন করছে সেই বিষয়টিই তখন তথাকথিত সুশীলরা বলছিল। মাত্র হাতেগোনা দুয়েকজন বুদ্ধিজীবী তখন সশস্ত্র লড়াই করে স্বাধীনতা অর্জনের পক্ষে কথা বলতেন। আমরা ছাত্রলীগের সিরাজুল আলম খান-শাজাহান সিরাজ-রব অংশের সমর্থকরা প্রচ-ভাবে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশের পথে নেয়ার জন্য রাজপথ কাঁপাই। সেøাগানে পোস্টারে তারই প্রকাশ ঘটে। পুরো দেশে ছাত্রদের মাঝে এই অংশটিই প্রবল বিধায় দেশজুড়ে ছাত্রলীগ স্বাধীন বাংলার প্রত্যয় প্রকাশিত হয়। কিন্তু সত্তর সালেও ছাত্রলীগ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলার প্রস্তাব নিতে পারছিল না। ছাত্রলীগের রাজনীতি দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর অংশটি ধীরে চলার পথে আর আমরা দ্রুত সামনে যাবার পথে। সময়টিকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে হলে এটি বলতেই হবে যে, ছাত্রলীগের সিরাজপন্থীরা তখন স্বাধীন বাংলার মূল স্রোত। আওয়ামী লীগের মূল স্রোতে তাজউদ্দীন আহমদ ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা ছাত্রলীগের এই বিপ্লবীদের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকলেও বস্তুত আওয়ামী লীগের রাজনীতি ধীরে ধীরে সত্তরের নির্বাচনমুখী হতে থাকে। বঙ্গবন্ধু একদিকে ছাত্রলীগের বিপ্লবী অংশটিকে সামনে চলার কথা বলেছেন, অন্যদিকে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করার সকল উপায়কেই কাজে লাগিয়েছেন। এটি এক ধরনের অসাধারণ সমন্বয়। রাজপথের আন্দোলনের জঙ্গী ধারার সঙ্গে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করা এবং সামরিক সরকারের অধীনে একটি বিপ্লবী ছাত্র সংগঠনের পাকিস্তানবিরোধী রাজনীতিকেও সঙ্গে রাখা কোনভাবেই সহজ কাজ ছিল না। বাস্তবতা হচ্ছে আওয়ামী লীগের আপোসকামী অংশ কোনকালেই সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ গড়ার পক্ষে ছিলেন না। তাদের স্বপ্ন ছিল নির্বাচনের মাধ্যমে পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করা। বঙ্গবন্ধু তাঁর দলকে জানতেন। সেজন্য তিনি তাঁর দলকে নির্বাচনমুখী করেন। এমনকি ছাত্রলীগের যে অংশটি বিপ্লবী সেøাগান দিয়েছে ও সশস্ত্র যুদ্ধের কথা বলেছে সেই অংশটিকেও তিনি নির্বাচনমুখী করেন। ’৭০ সালের আগস্ট মাসের একটি ঘটনার কথা স্মরণ করা যায়। এই ঘটনাটি একদিকে ছাত্রলীগের আপোসকামী অংশটিকে চিহ্নিত করবে, অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের দৃঢ়তাকে তুলে ধরবে। সেই সময়েই ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় পরিষদের সভায় স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার প্রস্তাব পেশ করার সিদ্ধান্ত হয়। সেই সময়কার একটি ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন লেখক মহিউদ্দিন আহমদ : “ছাত্রলীগের ভেতর যে মেরুকরণ ঘটছিল, তার একটা বিস্ফোরণ হয় ’৭০ সালের আগস্ট মাসে। ঢাকায় ৪২ নং বলাকা বিল্ডিংয়ের ছাত্রলীগের অফিসে তখন কেন্দ্রীয় কমিটির বর্ধিত সভা চলছিল। কেন্দ্রীয় কমিটিতে সিরাজপন্থীদের মুখপাত্র ছিলেন স্বপন কুমার চৌধুরী। ২১ আগস্ট রাতে সভা চলার সময় তিনি ‘স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটা প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করেন। এ নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ আলোচনা ও বিত-া হয়। স্বপন ভোটাভুটির দাবি জানান। কেন্দ্রীয় কমিটির ৪৫ জন সদস্যের মধ্যে ৩৬ জন ছিলেন প্রস্তাবের পক্ষে। সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী এই প্রস্তাবের ঘোরতর বিরোধিতা করেন। অবস্থা বেগতিক দেখে তিনি সভা মুলতবি করে দেন। তখন সবাই মিলে ধানম-ির ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবের বাসায় যান।” সেই রাতে বঙ্গবন্ধুর বাসায় ছাত্রলীগের এই অংশটির সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলাপ হয় এবং বঙ্গবন্ধু এই অংশটিকে গ্রামে গ্রামে কাজ করার নির্দেশ প্রদান করেন। মহিউদ্দিন সেই রাতের আলোচনায় আরও কিছু বিপ্লবী আচরণের বিবরণ দিয়েছেন এবং বঙ্গবন্ধু বিষয়ে কিছু মন্তব্যও করেছেন। আমি স্মরণ করতে পারি যে, বঙ্গবন্ধু সিরাজুল আলম খানকে অত্যন্ত ¯েœহ করতেন এবং সিরাজুল আলম খানও বঙ্গবন্ধুকে পরম শ্রদ্ধা করতেন। আজকে যখন পেছনে ফিরে তাকাই তখন বারবার মনে হয় বঙ্গবন্ধু সিরাজুল আলম খানকে প্রশ্রয় দিতেন বলেই তার সমর্থকরা বাংলাদেশের সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি নিতে পেরেছিল। অন্যদিকে দলের আপোসকামী অংশটিকেও তিনি সঙ্গে রেখেছিলেন। মহিউদ্দিন আহমেদ লিখেছেন, “শেখ মুজিব এর আগে বিপ্লবী পরিষদের সঙ্গে আলাপ করে ছাত্রলীগের একদল বিশ^স্ত কর্মীকে বাছাই করতে বলেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল এদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। সত্তরের মাঝামাঝি মুজিব নিশ্চিত হন দেশে নির্বাচন হবে।” সেজন্যই তিনি সশস্ত্র প্রশিক্ষণের পাশাপাশি নির্বাচনকেও গুরুত্ব প্রদান করেন। ‘স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ প্রস্তাব পেশ এবং তার বিরোধিতা সম্পর্কে ছাত্রলীগ নেতা মনিরুল ইসলাম তার “জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সমাজতন্ত্র” বইতে যা লিখেছেন তার অংশবিশেষ তুলে ধরা প্রয়োজন মনে করি। মনিরুল ইসলাম উল্লেখ করেছেন যে, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ‘স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ প্রস্তাব পেশ করার আগে সেটি ছাত্রলীগের বর্ধিত সভায় উত্থাপন ও আলোচনা হয়। একটি প্রস্তাব নামক অধ্যায়ে তিনি সেই সময়কার প্রেক্ষিতটি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন। তিনি এটিও বলেন যে, রাজশাহীর আবদুল করিমের সমর্থনে প্রস্তাবটি আলোচনার জন্য উত্থাপিত হয়। তিনি আরও জানান যে, কেন্দ্রীয় কমিটির ৬৭ জনের মাঝে ৬০ জনই যেহেতু সিরাজুল আলম খানের অনুসারী ছিলেন সেহেতু সেই প্রস্তাব পাস করার বিষয়ে কারও কোন সন্দেহ থাকার কারণ ছিল না। তিনি আরও জানান যে, বর্ধিত সভায় কেউ সরাসরি প্রস্তাবের বিরোধিতা না করে সেটিকে পাশ কাটিয়ে যাবার চেষ্টা করা হয়। তবে ইতিহাস হচ্ছে যে, নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রস্তাব পাস হয়নি। তিনি সভা ত্যাগ করে চলে যান। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস লেখার সময় আপোসকামিতার সেই প্রসঙ্গগুলো এড়িয়ে যাওয়া মোটেই সমীচীন হবে না। তবে আজ আমরা এটি স্পষ্ট করেই বলতে পারি যে, বিপ্লবের ধারাকে সাময়িকভাবে পাস কাটানো গেলেও তার মূল প্রবাহকে ঠেকিয়ে রাখা যায় না। সেদিন প্রস্তাবটিকে পাস কাটানোর প্রচেষ্টাকে এড়িয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টার পরও একাত্তরে স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ কেবল ঘোষিত হয়নি, বাস্তবে জন্ম নিয়েছে। ঢাকা, ১০ মার্চ, ১৭ ॥ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণা ও কর্মসূচীর প্রণেতা ॥ ই-মেইল : [email protected], ওয়েবপেজ :ww w.bijoyekushe.net
×