বুলি একাই বাড়ি মাথায় করে রাখে। কথাটি শুনলে সবাই হাসবে। এতবড় বাড়ি মাথায় করা যায়? আর বুলি তো সেই এতটুকু। আসল কথা হলো বুলিকে নিয়ে বাড়িতে হৈচৈ হয়। চোখের একটু আড়াল হলেই ‘বুলি কই, বুলি কই’ হৈচৈ।
খেয়েছে কিনা? না। খায়নি কেন? খাবার সময় এখনও হয়নি। ঘুমিয়েছে কি না? হাঁ। কোথায় ঘুমাল? কার কাছে ঘুমাল? সিমিনের কাছে। -এসব নিয়ে বাড়ির সবাই উতলা থাকে। আর এই ঘটনা সবই বুলিকে নিয়ে। সুতরাং বুলির জন্য বাড়ি এত সরব। বুলি একটু কাঁদলে হৈচৈ পড়ে যায়। আবার হাসলেও হৈচৈ পড়ে যায়। এভাবেই বুলি বাড়ি মাথায় করে রাখে।
সিমিন বুলির ফুপু। বুলি ডাকে ‘পুপু’। সিমিনের গলা ধরে শোয়। বলে, ‘একতা গল্প ছোনাও পুপু। পলীল গল্প।’
সিমিন বলল, ‘ওরে আমার সোনা, তুমিই তো একটা পরী। আমাদের পরীটা দুধ খায়, মাছ খায়Ñ।’
বুলি বাধা দিয়ে বলে, ‘আমাল গল্প না, পলীল গল্প কও পুপু।’
সিমিন বলল, ‘ঠিক আছে, পরীর গল্প বলব। শুনতে শুনতে তুমি ঘুমিয়ে পড়বে তো?’
সিমিনের কথায় সায় দিয়ে বলে বুলি, ‘তিক আচে। ঘুমিয়ে পলব।’
সিমিন বলতে শুরু করে, ‘একটা সাদা পরী, একটা লাল পরী আর একটা নীল পরী। এই তিনটা পরী একদিন উড়তে উড়তে চলে এল আমাদের বাগানে।’
বুলি উতলা হয়ে বলে, ‘পলীলা উলল কেন? ওলা ঘোলাল গালিতে আসলো না কেন?’
সিমিন বলল, ‘ও মা, ওরা ঘোড়ার গাড়ি কোথায় পাবে? ওদের পাখা আছে তাই উড়তে পারে। উড়ে উড়ে যেখানে খুশি যেতে পারে।’
হতাশ হয়ে বলে বুলি, ‘আমাল পাখা নাই কেন?’
সিমিন জবাব দেয়, ‘তুমি যে মানুষ।’
বুলি বলল, ‘বা, তুমি তো বললে আমি পলী।’
সিমিন বুঝিয়ে বলে, ‘তুমি হলে মানুষ-পরী। মানুষ-পরীর পাখা থাকে না। হাত-পা থাকে।’
‘ওÑ। পলীলা লেখাপলা কলে না, তাই হাত নাই।’ Ñবুলি এমনভাবে বলে যেন সব বুঝতে পেরেছে ও।
‘ওরে আমার পাকা বুড়ি’ Ñবুলির ঠোঁট ধরে আদর করতে করতে বলে সিমিন।
‘আমি বুলি না, বুলি তোমাল মা। আমাল দাদি বুলি।’ Ñঠোঁট ফুলিয়ে বলে বুলি।
হেসে খই ফোটায় সিমিন। এভাবে নানা কথা বলতে বলতে দুজন ঘুমিয়ে পড়ে।
সিমিন এখন সেভেনে পড়ে। বুলির কথার জবাব দিতে দিতে হাঁপিয়ে ওঠে। বুলিকে নিয়ে বিকেলে গাঙের ধারে যায় সে। সেখানে বক দেখে লাফিয়ে ওঠে বুলি। বলে, ‘বক কী খায় পুপু?’
সিমিন জবাব দেয়, ‘মাছ খায়। পাবদা-পুঁটি-মলাÑ কত মাছ।’
বুলি বলল, ‘মাছ তো পানিল ভেতলে আচে। বক ধলতে পালবে?’
সিমিন জবাব, ‘অনেক বড় ঠোঁট বকের। কেন ধরতে পারবে না?’
ঠিক তখনই একটি বক ঠোঁট দিয়ে একটি ছোটমাছ ধরে ফেলল। হাততালি দিয়ে লাফাতে থাকল বুলি, ‘কী মজা, কী মজাÑ বক মাছ ধলেচেÑ কী মজা।’
ফড়িং ওড়া দেখেও বুলি মজা পায়। দৌড়ে ধরতে যায় ফড়িং। ধরতে পারে না। ঘাসের মাথায় বসা একটি ফড়িং ধরে সিমিন। ফড়িংটি ডানা ঝাপটায় আর বোঁ বোঁ আওয়াজ হয়। মজা পায় বুলি। ফড়িং নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে আরও জোরে ডানা ঝাপটায়। সিমিন বলে, ‘ও কাঁদছে, ওকে ছেড়ে দিই?’
‘আমাল কাছে দাও, আমি ছেলে দেব।’ বলে বুলি ফড়িংটি নিয়ে ছেড়ে দিলে বেশি দূর যেতে পারে না। কাছেই একটা পাটকাঠির উপরে বসে।
বুলি ছোট ছোট ঘাসফুল দেখে অবাক হয়। বেগুনি, হলুদ, সাদা, নীল অনেক রঙের ফুল। বুলি বলে, ‘পুপু, এই পুল দিয়ে মালা গাঁথে দাও।’
সিমিন মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, ‘এই ফুল দিয়ে মালা গাঁথা যাবে না। তোমাকে আমি হিজল ফুলের মালা গেঁথে দেব।’
‘এখন দাও।’ Ñবুলির আবদার।
সিমিন বলল, ‘এখন ফুল তাজা নেই। কাল সকালে দেব।’ সকালে সিমিন বুলিকে নিয়ে হিজলতলা যায়। বাড়ির পাশে মসজিদ এবং তার পাশে ইশকুল। মসজিদের সামনে একটি বড় হিজল গাছ ও একটি দেবদারু গাছ। দেবদারু উঁচু হয়ে ওপরে উঠে গেছে। হিজল ডালপালা ছড়িয়ে আছে। ইশকুলের মাঠে অনেকখানি ছায়া করে রাখে। সিমিন দেখতে পেল মাঠের ওই এলাকাটুকু লাল হয়ে আছে। ফুলের বিছানা। হিজল ফুলের নরম বিছানা। বেতের ঝোপ থেকে আনা লতার সঙ্গে মালা গাঁথতে বসল সিমিন। বুলি কখন ফুলের ওপরে আরাম করে বসেছে তা খেয়ালই করেনি। দুহাতে ফুল নাড়ছে বসে বসে। মালাটার অনেকখানি গাঁথা হয়েছে। হঠাৎ উঠে বুলি বলল, ‘পুপু, ভিজে গেছে। আমাল জামা ভিজে গেছে।’
বুলির দিকে তাকিয়ে সিমিন হাসে। এই শীতের ভেতরে ওর ফ্রক ও উলের পাজামা ভেজা। সিমিন বলল, চলো বুলি এখনই বাড়ি যেতে হবে।
বুলি মাথা নেড়ে বলে, ‘না, আমি বালি যাব না। মালা গাঁথা শেষ কলো।’
সিমিন বলল, ‘ঠিক আছে, গাঁথছি।’
সিমিন একটি করে ফুল নিয়ে লতার সঙ্গে পরিয়ে দেয়। বুলির কথা থামে না। ঠিক মালা গাঁথার মতোই ওর কথামালা চলতে থাকে। বুলি বলে, পুপু তুমি ওই ইশকুলে যাও, আমিও যাব তোমাল সাতে।
সিমিন বলল, ‘তুমি আর একটু বড় হও, তখন যাবে।’
বুলি বলল, ‘না, তোমলা সবাই মিলে গান গাও, আমিও গাব।’
: কী গান? তুমি গাইতে পার?
: পালি।
সিমিন ওর গান শুনে হেসে ওঠে। বলে, আমরা তো সোনার বাংলা গান করি জাতীয় পতাকা উঠানোর সময়।
: আমিও পতাকা উতাব।
: ঠিক আছে আগে বড় হও।
: আমি তো অনেক বলো। এই দ্যাখো কত বলোÑ । এই বলে বুলি উঠে দাঁড়ায়।
: ঠিক আছে, তুমি আমার চেয়েও বড়। পাকনা মেয়ে। চলো, এবার বাড়ি চলো। মালা গাঁথা হয়ে গেছে। এই ন্যাও তোমার মালা।
‘পলিয়ে দেবে না পুপু?’ Ñআবদার করল বুলি।
: কেন দেব না?
সিমিন বুলির গলায় মালাটি পরিয়ে দেয়। হিজল ফুলের মালাটিতে তখনো কুয়াশা জড়িয়ে আছে। লাল মালায় বুলিকে পুতুলের মতো লাগে।
অলঙ্করণ : প্রসূন হালদার
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: