ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিবিসি

কল্পবিজ্ঞানের সেই সাত ভবিষ্যদ্বাণী আজ সত্য

প্রকাশিত: ০৬:২৩, ১১ মার্চ ২০১৭

কল্পবিজ্ঞানের সেই সাত ভবিষ্যদ্বাণী আজ সত্য

বিজ্ঞানের বিস্ময়কর ও বিচিত্র জগতে পাঠকদের টেনে নিয়ে যেতেন আইজাক আসিমভ। পেশায় ছিলেন জৈব রসায়নের অধ্যাপক। কিন্তু লেখার হাত ছিল অসাধারণ। বিজ্ঞানের দারুণ কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়ের সঙ্গে কল্পনায় মিশেল দিয়ে তিনি রহস্যের এমন জাল বুনতেন নিপুণ হাতে যে পাঠকমাত্র সম্মোহিত হয়ে সেই জগতে বিচরণ করে চলত। পাঁচ শ’রও বেশি বই নিজে লিখেছেন বা সম্পাদনা করেছেন। তার সবচেয়ে বিখ্যাত রচনাগুলোর মধ্যে আছে ফাউন্ডেশন সিরিজ, গ্যালাকটিক এম্পায়ার সিরিজ ও রোবোট সিরিজ। তার আই, রোবোট হলো সেই রোবোট সিরিজেরই কাহিনী যা কিনা রোশেট বিষয়ক ছোট ছোট কল্পবিজ্ঞান কাহিনীর সংগ্রহ। গোড়াতে এটি ১৯৪০ থেকে ১৯৫০ সালের মধ্যে ছাপা হয়েছিল আইজাক আসিমভ আই। রোবোট গ্রন্থটি লিখেছিলেন ৬০ বছরেরও বেশি আগে। তারপর থেকে যতই দিন গেছে তার কাহিনী ক্রমে ক্রমে সত্য হয়ে উঠেছে। তিনি যে জগত কল্পনা করেছিলেন তা এখন আমাদের সামনে। রোবোট আজ সর্বত্রই উপস্থিত। আমাদের বাড়িতে, আমাদের ব্যাগে, আমাদের পকেটে আসিমভের লেখা কল্পকাহিনীর সেই যান্ত্রিক হিউম্যায়েড রোবোট নয় বরং সিলিকন টিপসের শক্তিশালী কৃত্রিম বুদ্ধি বা এআই যা রয়েছে মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপ থেকে শুরু করে ফ্রিজ, গাড়ি এবং বাচ্চাদের খেলনা পর্যন্ত সবকিছুর মধ্যে। আসিমভের রোবোটের মর্মবস্তু হচ্ছে তাদের বুদ্ধিদীপ্ততা ও গতি, নির্ভরযোগ্যতা এবং অনেক ক্ষেত্রে মানুষের চাইতে অনেক বেশি মাত্রায়ও ভালভাবে কাজ করতে পারার ক্ষমতা। আসিমভ তার গ্রন্থে রোবোট সম্পর্কে যেসব ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন সেগুলোই আজ সত্যে পরিণত হতে চলেছে। তার সেই ভবিষ্যদ্বাণীর মধ্যে তিনি যে রোবোট প্রযুক্তির সুনির্দিষ্ট দিকগুলো ব্যাখ্যা করেছিলেন তা নয়, তবে কৃত্রিম বুদ্ধি ও রোবোটিক্সের যুগ মানবজাতির ওপর যে নৈতিক, আবেগগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক উভয় সঙ্কট চাপিয়ে দিচ্ছে তা তিনি আগে থেকে দেখতে পেয়েছিলেন। যেমন হলো : আবেগগত নির্ভরতা : ত্রিশ বছর বয়সের নিচে যে কাউকে যদি এক সপ্তাহের জন্য মোবাইল বাদ দিতে বলা হয় তাহলে তার চেহারায় তাৎক্ষণিক আতঙ্কের ভাব ফুটে উঠবে। অন্তর থেকে আর্তনাদের মতো বলে উঠবে ‘মোবাইল ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না।’ এটা শুধু সুবিধার ব্যাপার নয়। মোবাইল আমাদের নিত্যসঙ্গী। সর্বক্ষণ আমাদের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে ও পূর্ণ আশ্বস্ত করছে। আমাদের এই আবেগগত নির্ভরতারই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন আসিমভ ১৯৪০ সালে তার রোব্বি এপিসোডে। সেখানে একটা শিশু নিজের বাবা-মায়ের চাইতে তার রোবোট চাইল্ড মাইন্ডারের সঙ্গে অধিকতর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং এর পরিণতি হয় সুদূরপ্রসারী। সবকিছুর ইন্টারনেট : ১৯৫০ সালে লেখা ‘দি এভিটেবল কনফ্লিক্ট’ গ্রন্থে আসিমভ মেশিনকে এযাবতকালে আবিষ্কৃত ক্যালকুলেটিং সার্কিটের সমষ্টি বলে বর্ণনা করেছেন। এই মেশিনগুলো সারা বিশ্ব থেকে প্রায় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সময়ে প্রায় অসীম সংখ্যক ড্যাটা সংগ্রহ করে এবং বিশ্ব অর্থনীতিকে সুষ্ঠুভাবে চালাতে সেই ড্যাটা ব্যবহার করে। এ তো গেল প্রায় ৭০ বছর আগের কাহিনীর কথা। আর আজ সবকিছুতেই রয়েছে ইন্টারনেট। এই ইন্টারনেট প্রতিটি শত শত কোটি ড্যাটা প্রসেস করে চলেছে। এই ইন্টারনেট ছাড়া আমাদের জীবন অচল। মানুষ যেখানে অক্ষম : ১৯৪০ এর দশকের ছায়াছবির নায়করা চলন্ত বিমানের নিয়ন্ত্রণ দখলের জন্য মারামারির দৃশ্য দ্বারা দর্শকদের শ্বাসরুদ্ধ করে রাখত। নিখুঁত লক্ষ্যভেদী শূটিংয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিত। কিন্তু আসিমভ কলম ধরার পর এমন এক বিশ্বকে দেখালেন যেখানে বুদ্ধিমান রোবোটের কাছে মানুষ হয়ে পড়বে শক্তিহীন ও অক্ষম। আর ঠিক এমন একটা জগতই আজ আমাদের চারপাশে গড়ে উঠেছে। ইলেক্ট্রনিক স্যাটন্যাভ না থাকলে ক’জনই বা ম্যাপ দেখে দেখে নগরী দিয়ে চলতে পারে? এবিএস বন্ধ থাকলে ক’জনই বা সজোরে ব্রেক কষে গাড়ির পেছনে যাওয়া পরিহার করতে পারে। কম্পিউটার না থাকলে ক’টা বিমানই বা কুয়াশার মধ্যে অবতরণ করতে পারে? বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষতা : আই, রোবোটের সবচেয়ে লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্যগুলোর একটি হলো যেভাবে আসিমভ কৃত্রিম বুদ্ধির (এআই) ক্রমবর্ধমান বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষতার চিত্র এঁকেছেন। তার প্রথম দিকের কাহিনীগুলোয় রোবোট কথা পর্যন্ত বলতে পারত না। কিন্তু বইয়ের পরের দিকের কাহিনীগুলো তারা মানুষের সঙ্গে জটিল মাইন্ড গেম খেলছে। তার সেই কল্পনাই আজ বাস্তবে পরিণত হয়েছে। কয়েক সপ্তাহ আগে জাপানের এক বীমা কোম্পানি জানায় যে তারা ৩৪ জন গুরুত্বপূর্ণ স্টাফকে বাদ দিয়ে তাদের জায়গায় সুপার স্মার্ট ওয়াটসন কম্পিউটার বসাতে যাচ্ছে। এগুলো যে কেবল রুটিন খোঁজখবর নেয়ার কাজ করবে তা নয়, উপরন্তু আর্থিক পরিশোধ সম্পর্কে জটিল সিদ্ধান্ত নেবে। কোম্পানি এমন কৃত্রিম বুদ্ধিসম্পন্ন কম্পিউটার বেছে নিয়েছে যেগুলো মানুষের মতো চিন্তা করতে পারে এবং অবিন্যস্ত কথা, ছবি, অডিও ভিডিও সহ আপনার যাবতীয় ড্যাটা বিশ্লেষণ এবং ব্যাখ্যা করতে পারে। মনের ভাষা পাঠ করা : ১৯৪১ সালে ‘লায়ার’ নামে আসিমভের একটি ছোটগল্প বেরিয়েছিল। ওটা ছিল এমন এক রোবোটের কাহিনী যার মনের ভাষা পাঠ করার ক্ষমতা ছিল এবং এর দ্বারা সে তার সান্নিধ্যে আসা মানুষদের জীবন তছনছ করে দিয়েছিল। মনে হতে পারে যে আসিমভের কল্পনার দিগন্ত একটু বেশি দূর প্রসারিত হয়েছিল। কিন্তু বড়ই অদ্ভুত ব্যাপার এই কিছুদিন আগে জানা যায় সুইজারল্যান্ডের ডাক্তাররা এমন এক কম্পিউটার বের করেছেন যা বিপর্যয়কর ‘লকড্ ইন’ সিনড্রোমে আক্রান্ত রোগীদের মনের ভাষা পাঠ করতে পারে। এ ধরনের রোগীর জন্য খুবই আশাব্যঞ্জক খবর। কিন্তু যারা নিজেদের মনের গভীরের কথা গোপন রাখতে চান তাদের জন্য রীতিমতো অস্বস্তির ব্যাপার। যৌক্তিক নির্মমতা : ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত ‘লিট্ল লস্ট রোবোট’-এ বিজ্ঞানীর একটা রোবোট রিসার্ট এ্যাসিস্টেন্ট ছিল। একবার কোন এক ব্যাপারে নাকাল হয়ে তিনি সেই রোবোটকে বলে ওঠেন ‘ভাগ এখান থেকে ব্যাটা অকর্মা ইলেকট্রনিক জঞ্জাল কোথাকার।’ রোবোটটি ছিল যুক্তিবাদী ও অনুগত। মনিবের কথামতো সে সেই কাজটাই করে বসল। সে বড় ধরনের সিকিউরিটি এ্যালার্ট বাজিয়ে দিল। এটা হলো সেই কাহিনী যেখানে যুক্তি ও বিচার বুদ্ধিকে বড় করে দেখানো হয়। আজকের গবেষকরাও অনেক ক্ষেত্রে এই একই সমস্যার সম্মুখীন। তারা হয়ত স্বয়ংচালিত গাড়ির ক্ষেত্রে এমন প্রোগ্রাম করেছেন। যাতে সে কোন বস্তুর সঙ্গে ধাক্কা না লাগায়। কিন্তু কখনও কখনও সংঘর্ষটা অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। হয়ত রাস্তায় একটা শিশু ও একজন বৃদ্ধ দাঁড়ান। সংঘর্ষ অনিবার্য হলে তাদের দু’জনের একজনকে আঘাত করতে হবে। কাকে করতে হবে সেটাই তখন নিতান্তই এক যৌক্তিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় এবং সেই সিদ্ধান্তটা বড়ই নির্মম হয়ে দাঁড়াতে পারে। রোবোটই যদি সবকিছু করে তবে : দুষ্টবুদ্ধির রোবোটদের হাতে মানুষরা দাসত্বের বন্ধনে আবদ্ধ এমন এক অন্ধকার ভবিষ্যতও দেখিয়েছেন আসিমভ তার গল্প কাহিনীতে। তবে তিনি এ ব্যাপারেও সন্ধান থেকেছেন যে ব্যাপারটা অত সহজ হবে না। ১৯৪১ সালে প্রকাশিত তার ‘বিজন’ নামের কাহিনীতে ত্রাণকর্তার কমপ্লেক্সে ভুগা একটা রোবোট তার মানব প্রভুকে বলছে’ ‘আপনারা নিবৃষ্টতর প্রাণী। আপনাদের যুক্তি ও বিচারবুদ্ধি কম। কিন্তু তর পরও আপনার প্রতি এক ধরনের মমতা আমি অনুভব করি। এখন যেহেতু আপনার কাজ শেষ হয়ে গেছে আপনি সম্ভবত বেশি দিন বাঁচবেন না। তবে যতদিন বাঁচবেন আপনাকে খাবার, কাপড় চোপড় ও আশ্রয় দেয়া হবে।’ এই একটি প্যারাগ্রাফেই আসিমভ একবিংশ শতাব্দীর পাশ্চাত্যের সামনে যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি এসে দাঁড়িয়েছে সেদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছিলেন : ‘রোবোট ও কৃত্রিম বুদ্ধিই যদি সব কাজের দায়িত্ব নেয় তাহলে মানুষের কি হবে?’ অনুবাদ ॥ এনামুল হক
×