স্বাধীনতার মাস মার্চ। প্রতিবছর মার্চ এলেই আমাদের চেতনায় আসে মুক্তিযুদ্ধ। মনে পড়ে অগণিত শহীদ স্বজনদের কথা। স্মৃতির এ্যালবামে ভাসে হারানো মুখচ্ছবি। প্রিয়জন হারানোর অব্যক্ত বেদনায় কারও কারও চিত্ত হয় দলিত-মথিত। চলে দিবস পালনের তোড়জোড়। দু-একটি বিশেষ দিনে শহীদদের স্মরণ করে সারা বছর ভুলে থাকার গ্লানির অবসান ঘটাই আমরা। কিন্তু স্বাধীনতার দীর্ঘ ছেচল্লিশ বছরেও আমরা কি একাত্তরের সব গণহত্যার ইতিহাস উদ্ধার করতে পেরেছি? জাতীয় পর্যায়ে পরিচিত কয়েকজন বুদ্ধিজীবীকে হত্যার নারকীয় ইতিহাস হয়ত অনেকের জানা। কিন্তু পাক-হানাদার ও তাদের দোসররা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেসব গণহত্যা সংঘটিত করেছিলÑ তার সঠিক চিত্র আজও অপ্রকাশিত। ফলে বিস্মৃতির অতলে চাপা পড়ে যাচ্ছে অনেক হত্যাযজ্ঞের করুণ ইতিহাস।
একাত্তরের কলুষিত এ ইতিহাস থেকে মুক্ত নয় নেত্রকোনাও। পাক হানাদার ও ঘাতক-দালালদের নির্মম হত্যাযজ্ঞে নেত্রকোনাবাসীও হারিয়েছিল অন্যায়ের প্রতিবাদী অথচ নিরীহ অনেক মুক্তিকামী মানুষকে। এখানে হানাদারদের প্রথম নারকীয় হত্যার শিকার হন মোক্তারপাড়া নিবাসী ডা. মিহির সেন ও তাঁর শ্যালক সংস্কৃতিকর্মী সিদ্ধার্থ সেন। ডা. মিহির সেন ছিলেন বর্তমান সদর উপজেলার ঠাকুড়াকোনা হাসপাতালের সরকারী চিকিৎসক। আর তাঁর শ্যালক সিদ্ধার্থ সেন ছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতিথযশা শিল্পী। ৭১-এর ২৫ এপ্রিল নেত্রকোনা শহরে প্রথম পাকবাহিনী আসে। ওই দিনই ডা. মিহির ও সিদ্ধার্থ সেন বাসার খোঁজখবর নিতে গ্রামের বাড়ি থেকে শহরে আসেন। হাঁটতে হাঁটতে পুরাতন জজকোর্টের সামনে এসে পাকবাহিনীর গাড়ির সামনে পড়েন তারা। গাড়িটি পাকিস্তানী আর্মি ক্যাপ্টেনের। তার নির্দেশে পাক সেনারা দু’জনকেই গাড়িতে উঠিয়ে নেয়। এরপর রাতেই পূর্বধলা-নেত্রকোনা সড়কের ত্রিমোহনী সেতুর ওপর নিয়ে গুলি করে হত্যা করে।
ডা. মিহির ও সংস্কৃতিকর্মী সিদ্ধার্থকে হত্যার পর পাকিস্তানী দোসররা ওই একই পরিবারের দুই বিশিষ্ট আইনজীবী অখিল সেন ও হেম সেনকে হত্যার নীলনকশা করে। শহরের পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে দু’জনই তখন মনকান্দিয়া গ্রামের বাড়িতে পালিয়েছিলেন। কয়েক দালাল শহরের পরিস্থিতি ভালো জানিয়ে তাঁদের শহরে ফিরে আসতে খবর পাঠায়। খবর পেয়ে তাঁরাও গ্রাম থেকে সপরিবারে শহরে ফিরে আসেন। কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতেই ২১ শ্রাবণ (ইংরেজী তারিখটি তাদের পরিবারের জানা নেই) রাজাকার-দালালরা দু’জনকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর তুলে দেয় পাক-সেনাদের হাতে। পরে পাকসেনারা মোক্তারপাড়া সেতুর ওপর নিয়ে গুলি করে তাঁদের হত্যা করে। অখিল সেন ছিলেন শহীদ ডা. মিহির সেনের বাবা। একই পরিবারের আরেক সদস্য শংকর সেনও পাকবাহিনীর গুলিতে আহত হয়েছিলেন। মূলত গোটা পরিবারটি নিশ্চিহ্ন করে দেয়াই ছিল দালাল-রাজাকারদের লক্ষ্য। বৈধব্য আর স্বজন হারানোর অব্যক্ত যন্ত্রণা নিয়ে আজও টিকে আছে পরিবারটি। কিন্তু দেশ স্বাধীন হলেও ওই শহীদ পরিবারটির তেমন একটা খোঁজ নেয়নি কেউ।
Ñসঞ্জয় সরকার, নেত্রকোনা থেকে
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: