ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধে প্রথম শহীদ

প্রকাশিত: ০৬:২০, ১১ মার্চ ২০১৭

মুক্তিযুদ্ধে প্রথম শহীদ

হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে রংপুর সড়ক দিয়ে বগুড়ায় ঢোকার পথে বাধা পায়। তারা ভাবতেও পারেনি বগুড়ার মানুষ বঙ্গবন্ধুর ডাকে এত দ্রুত সংঘবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধে নেমে পড়ব। ওইদিন মধ্যরাতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া কনভয় বগুড়া ঢোকার খবর পাওয়া মাত্র রাতের ঘুমন্ত শহর জেগে ওঠে। সর্বস্তরের মানুষ যেভাবে পারে কুড়াল দিয়ে বড় বড় গাছ কেটে মহাসড়কে ফেলে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ভারি অস্ত্রের যানবাহন শহর থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার উত্তরে গোকুল এলাকায় আটকে যায়। সকালে গোকুলের ঠেঙ্গামারা গ্রামের রিক্সাচালক তোতা মিয়া কুড়াল হাতে দৌড়ে এগিয়ে যায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর দিকে। হতবাক সেনা অফিসার কিছু বুঝে ওঠার আগেই তোতা মিয়া কুড়াল উঁচিয়ে ধরতেই অপর সেনা গুলি চালায়। এই দৃশ্য দেখে আরেক রিক্সাচালক রমজান আলী কুড়াল হাতে ছুটে যেতেই তার ওপর ব্রাশ ফায়ার করে সেনারা। এ খবর শহরে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে এলাকায় যাদের বন্দুক ছিল তারা বন্দুক তুলে দেয় তরুণদের হাতে। কেউ নিজে বন্দুক নিয়ে এগিয়ে যায়। এরই মধ্যে বন্দুকের দোকান ভেঙ্গে তরুণরা অস্ত্র ও গুলি সংগ্রহ করে সমুখ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। থানার তৎকালীন ওসি পুলিশের সকল সদস্য নিয়ে প্রতিরোধে এগিয়ে যায়। স্টেশন থেকে মালগাড়ি ঠেলে ব্লক করে দেয়া হয় তিনটি রেলগেট। ঝাউতলা ও বড়গোলায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গুলি ও মর্টার শেলে নিহত হয় আজাদ, টিটু, হিটলু ও ছুনু। শেষের দুজনকে হানাদাররা মৃত্যুর পরও বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে পৈশাচিক উল্লাস করে। দুই দিন অবরুদ্ধ থাকার পর হানাদার পাকিস্তানী সেনারা পিছু হটে ফিরে যায়। ২১ এপ্রিল পর্যন্ত বগুড়া মুক্ত থাকার পর ২২ এপ্রিল দুপুরে পাকিস্তানী সেনারা ভারি অস্ত্র নিয়ে উত্তর ও দক্ষিণ দিক থেকে একযোগে আঘাত হানে। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর দুটি স্যাবার জেট বিমান বোমা ফেলতে থাকে। এ সময় কত লোক নিহত হয়, তার হিসাব মেলেনি। হানাদার ও তাদের দোসর ফান্ডামেন্টালিস্ট জামায়াত ও তৎকালীন ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতাকর্মী এবং অবাঙালীরা লাশ সরিয়ে ফেলে। ২৫ মার্চ থেকে এপ্রিল মে পর্যন্ত যাদের মেরে ফেলা হয় তাদের কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনী শহরে ঢুকেই বাঙালী নিধন শুরু করে। এক পর্যায়ে শিববাটিতে রহমান কুটিরে ঢুকে গ্যামনস লিমিটেডের কন্ট্রাক্টর হাফিজার রহমান, তাঁর স্ত্রী খোদেজা খাতুন, তাঁদের বড় ছেলে প্রকৌশলী বদরুল করিম, ছোট ছেলে টুটুল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে বেড়াতে আসা হাফিজার রহমানের বেয়াই সিকান্দার চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রীকে গুলি করে হানাদাররা হত্যা করে। এ সময় তাদের সঙ্গে ছিল জামায়াতের কর্মী ও অবাঙালীরা। আশপাশের গ্রাম থেকে রাজাকাররা প্রতিদিন বাঙালী ধরে এনে তুলে দিত হানাদারদের কাছে। পাকিস্তানী সেনারা ছিল অবাঙালীর মালিকানাধীন বগুড়ায় জামিল ফ্যাক্টরির ভেতরে রেস্ট হাউসে। বিকৃত উল্লাসে হানাদাররা নির্যাতন করে ফ্যাক্টরির বয়লারে ফেলে দিত বাঙালীদের লাশ। কখনও যন্ত্রের মধ্যে দেহ ঢুকিয়ে হত্যার পর ফ্যাক্টরি চত্বরেই লাশ পুঁতে ফেলত। জামিলের রিয়েল এস্টেট নির্মাণের সময় মাটির নিচ থেকে বহু হাড়গোড় বেরিয়ে আসে। পরে তা এক জায়গায় এনে কবর খুঁড়ে পুঁতে রাখা হয়। বহু বছর পর অনেকের সন্ধান মেলে। যাদের নাম পাওয়া যায়, তা সংরক্ষণ করা হয়। ফলকে নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে লেখা আছে নাম। ১. শহীদ হাফেজ ২. শহীদ মনসুর রহমান মুক্তিযোদ্ধা সাজাপুর ৩. শহীদ মোখলেছুর রহমান মুক্তিযোদ্ধা ৪. শহীদ আলাল উদ্দিন ৫. শহীদ তারাপদ ও ৬. শহীদ নজরুল। এপ্রিল মাসের শেষের দিকে চেলাপাড়া নারুলী এলাকায় দুপুরে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও দোসর রাজাকাররা বাঙালীদের ধরে এনে জড়ো করে মনিন্দ্রনাথের শান্তি নার্সারির তালগাছের নিচে। সেখানে ১৩ জনকে হত্যা করে মাটি চাপা দেয়া হয়। হানাদারের গুলিতে নিহতরা হলেন ইসমাইল হোসেন বুলু, শরীফ উদ্দিন, গোফফরা প্রামাণিক, বেলায়েত হোসেন, ইসরাইল হোসেন খন্দকার, শেখ শরাফত জামাল, শেখ ছবের, জসিমুদ্দিন, হাবিবুর রহমান, মারোস উদ্দিন, সামাদ প্রামাণিক, মোকাম প্রামাণিক, কালু শেখ ও মোজাম প্রামাণিক। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর এদেশী রাজাকাররা প্রতিদিন বাঙালী নিধন করেছে। এমন কোন পরিবার নেই যে পরিবারের কেউ হত্যা বা নির্যাতিত হয়নি। শুধু হানাদারদের দোসর রাজাকার ও অবাঙালীরা ছিল নিরাপদে। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর এই অবাঙালীরা আজও পাকিস্তানী প্রীতিতে সৈয়দপুরে মাঝে মধ্যেই পাকিস্তানী পতাকা তোলার ঔদ্ধত্য পায়। Ñসমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×