ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সাতক্ষীরার শব্দলপুর গ্রাম এখন কুঁচিয়াপল্লী ॥ কুঁচিয়া চাষে দারিদ্র্যমুক্তি

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ১১ মার্চ ২০১৭

সাতক্ষীরার শব্দলপুর গ্রাম এখন কুঁচিয়াপল্লী ॥ কুঁচিয়া চাষে দারিদ্র্যমুক্তি

আনোয়ার রোজেন, সাতক্ষীরার আশাশুনি থেকে ফিরে ॥ গ্রামের ভেতর দিয়ে চলে গেছে আঁকাবাঁকা পিচঢালা মসৃণ পথ। পথের ধারঘেঁষে ছোট-বড় অনেকগুলো ঘের। এ অঞ্চল চিংড়ির জন্য পরিচিত। তবে এ ঘেরগুলোতে চাষ হয় কুঁচিয়া মাছের! ঘেরগুলোর ফাঁকে ফাঁকে সরু মেঠোপথ। পথের মাথায় বাড়িগুলো সারিবেঁধে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। প্রতিটি বাড়ির সামনে বিশেষ ধরনের ছোট-বড় চৌবাচ্চা। কুঁচিয়ার চাষ হয় সেখানেও। সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার শব্দলপুর গ্রাম এখন কুঁচিয়াপল্লী নামেই পরিচিত। অনটনের সংসারে সচ্ছলতা আনার আশায় কুঁচিয়া চাষের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন গ্রামের গৃহবধূ গীতা সরকার (৪৫)। এরপর বাড়ির সামনের জলাশয়কে ঘের বানিয়ে কুঁচিয়ার চাষ শুরু করেন প্রাকৃতিক উপায়ে। আর অনুদানের ৫ হাজার টাকা ও নিজের সঞ্চয় মিলিয়ে ১০ হাজার টাকায় বসতভিটার সামনে বসান কুঁচিয়া চাষের চৌবাচ্চা। ব্যস, খরচ বলতে এটুকুই। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সচ্ছলতা আসে গীতার ছয় সদস্যের পরিবারে। কুঁচিয়া বিক্রি করে তার মাসিক আয় এখন ১০ হাজার টাকা। গীতার জীবন বদলে দিয়েছে কুঁচিয়া চাষ। তার মতো আরও ২২৫টি পরিবার কুঁচিয়া চাষকে করেছে জীবিকা নির্বাহের উপায়। ‘প্রাকৃতিক উপায়ে কুঁচিয়ার বংশ বিস্তারের সুযোগ ও পরিবারভিত্তিক কুঁচিয়া খামার স্থাপনের মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) কুঁচিয়া চাষ সহজীকরণ ও জনপ্রিয় করার চেষ্টা করছে। এরই অংশ হিসেবে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে সাতক্ষীরার আশাশুনি ও কালীগঞ্জ উপজেলার দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে দেয়া হচ্ছে কুঁচিয়া চাষের প্রশিক্ষণ, ঋণ ও অনুদান। এ দুটো উপজেলায় প্রকল্পের বাস্তবায়নকাজ করছে পিকেএসএফের সহযোগী সংস্থা উন্নয়ন। কুঁচিয়াবৃত্তান্ত ॥ কুঁচিয়ার শরীরটা বাইন মাছের মতো দেখতে হলেও মুখটা সাপের মতো। অনেকে সাপ মনে করে ভয়ও পান। নিরীহ এ মাছটির ত্বক মসৃণ, পিচ্ছিল ও আঁইশবিহীন। দেহ গাঢ় বাদামী রঙের। লম্বায় এটি ৬০ থেকে ৭০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। আমাদের দেশে কুঁচিয়া (গড়হড়ঢ়ঃবৎঁং পঁপযরধ) সাধারণত ‘মাইটা কুঁচিয়া’ (গঁফ ববষ) নামে পরিচিত। এটি একটি পুষ্টিকর ও সুস্বাদু মাছ। এর ঔষধি গুণও রয়েছে। অনেকে রোগ নিরাময়ের জন্য কুঁচিয়ার পিত্তথলি খেয়ে থাকেন। কুঁচিয়া প্রাকৃতিকভাবে অগভীর উন্মুক্ত জলাশয় যেমনÑ হাওড়-বাঁওড়, খাল-বিল, প্লাবনভূমি, পুকুর-ঘের, ধানক্ষেতের আইল এবং জলজ ঝোপঝাড়যুক্ত এলাকায় পাওয়া যায়। সাধারণত আদিবাসীরাই দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে কুঁচিয়া শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। বর্তমানে আদিবাসী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ কুঁচিয়া আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। কুঁচিয়া চাষে দারিদ্র্যমুক্তি ॥ সম্প্রতি সরেজমিন আশাশুনি উপজেলার সদর ইউনিয়ন ও শোভনালি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি বাড়ির সামনে রয়েছে কুঁচিয়া চাষের বিশেষ চৌবাচ্চা বা ডিচ। এসব চৌবাচ্চার বেশিরভাগের দৈর্ঘ্য সাড়ে নয় ফুট, প্রস্থ নয় ফুট এবং গভীরতা তিন ফুট। চৌবাচ্চার উপরের পানিতে ভাসছে কচুরিপানা। বাড়ির সামনেই রয়েছে পুকুর সাইজের ঘের। শব্দলপুর গ্রামের এমনই একটি বাড়ির সামনে কথা হয় হরিপদ ম-লের সঙ্গে। তিনি জানান, ছেড়ে দেয়া চিংড়ি ঘের থেকে অন্য মাছের পাশপাশি কুঁচিয়াও ধরেন। বড় কুঁচিয়া (৩০০ থেকে ৪০০ গ্রাম) স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে দেন আর ছোটগুলো ছেড়ে দেন চৌবাচ্চায়। কুঁচিয়া কষ্টসহিষ্ণু মাছ, যা অধিক মজুদ ঘনত্বে চাষ করা যায়। একটি চৌবাচ্চায় একসঙ্গে ২০-৩০ কেজি কুঁচিয়ার পোনা চাষ করা হয়। কুঁচিয়ার খাবার হিসেবে দেয়া হয় পাতি চিংড়ি, জলাশয়ে পাওয়া স্থানীয় তেলিয়া, বিরকুনিসহ বিভিন্ন ছোট জাতের মাছের পোনা। এছাড়া আর কোন খরচ নেই। কুঁচিয়া বড় হয় খুব দ্রুত। দুই থেকে আড়াই মাস পর এসব কুঁচিয়ার ওজন হয় ৫০-৬০ কেজি। একেকটি কুঁচিয়ার ওজন সর্বোচ্চ ৫০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে। স্থানীয় বাজারে এক কেজি কুঁচিয়া বিক্রি হয় ৮০ থেকে ১০০ টাকায়। হরিপদ জানান, গত বছর কেবল কুঁচিয়া বিক্রি করে প্রতি মাসে ১২ হাজার টাকা আয় করেছেন। বাড়ির সামনের ঘেরটিতে ২০০ কেজি কুঁচিয়া চাষ করেছিলেন। বিক্রি করেছেন প্রায় ৫০০ কেজি। কেবল টাকায় নয়, হরিপদের পরিবারের আমিষের চাহিদাও পূরণ করছে কুঁচিয়া। প্রতি ১০০ গ্রাম কুঁচিয়ায় উচ্চমানসম্পন্ন প্রোটিন থাকে ১৪ গ্রাম। একই পরিমাণ কুঁচিয়া থেকে ৩০৩ কিলোক্যালরি শক্তি পাওয়া যায়, যেখানে অন্যান্য সাধারণ মাছ হতে পাওয়া যায় মাত্র ১১০ কিলোক্যালরি। হরিপদ জানালেন, তার পরিবারে এখন আর কোন অভাব নেই। কুঁচিয়া চাষ করে একই ভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার কথা জানান গীতা সরকার, দিলীপ কুমার সরকার, সুকুমার মিস্ত্রী ও মিনতি রানী। পিকেএসএফের চেয়ারম্যান ও প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ সম্প্রতি শব্দলপুরে গিয়ে চৌবাচ্চায় কুঁচিয়া চাষ ও কুঁচিয়ার ঘের পরিদর্শন করে এসেছেন। তিনিই শব্দলপুরকে ‘কুঁচিয়া চাষের গ্রাম’ হিসেবে ঘোষণা করেন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জনকণ্ঠকে ড. খলীকুজ্জমান বলেন, স্থানীয় সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থান ও আয় বৃদ্ধি সম্ভব। এজন্য দরকার যথাযথ প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা। বহুমাত্রিক দারিদ্র্য বিমোচনের পাশাপাশি কুঁচিয়া আমাদের জন্য সম্পদও হতে পারে। চিংড়ি এবং কাঁকড়ার মতো কুঁচিয়ারও বিশাল রফতানি বাজার ও সম্ভাবনা রয়েছে। এটিকে কাজে লাগাতে হবে। কুঁচিয়া চাষে পরিবেশের ক্ষতি হয় না। কুঁচিয়া লবণসহিষ্ণু মাছ। উপকূলীয় এলাকায় খুব সহজেই এটি চাষ করা সম্ভব। পিকেএসএফের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (প্রশাসন) ড. মোঃ জসীম উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, প্রাকৃতিক উৎস থেকে প্রাপ্ত কুঁচিয়াই মূলত বিদেশে রফতানি করা হচ্ছে। নির্বিচারে কুঁচিয়া আহরণের ফলে প্রকৃতিতে এর পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে। আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ সীমিত। তবে এর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্যমুক্তি সম্ভব হবে। তাই কুঁচিয়া চাষের কোন বিকল্প নেই। পিকেএসএফ প্রাকৃতিক উপায়ে কুঁচিয়া চাষের পাশপাশি হ্যাচারিতে কুঁচিয়ার পোনা উৎপাদন ও বছরজুড়ে কুঁচিয়ার চাষ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা করছে। জানা গেছে, দেশীয় বাজারের পাশাপাশি বিদেশী বাজারেও কুঁচিয়ার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, পাবনাসহ প্রায় ১০-১২টি জেলা থেকে প্রচুর পরিমাণে কুঁচিয়া বিদেশে রফতানি করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, হংকং, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, চীন, তাইওয়ানসহ ১৫টি দেশে কুঁচিয়া রফতানি করা হচ্ছে। মৎস্যপণ্য ব্যবসায়ীদের কাছেও কুঁচিয়া একটি সম্ভাবনাময় রফতানিপণ্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। হিমায়িত রফতানিযোগ্য মৎস্যপণ্যের মধ্যে কুচিয়ার অবস্থান চতুর্থ। বাংলাদেশ রফতানি ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, গত পাঁচ বছরে কুঁচিয়া রফতানির পরিমাণ বেড়েছে প্রায় সাতগুণ। একই সঙ্গে এ খাতে রফতানি আয়ের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় পাঁচগুণ। ২০০৯-১০ অর্থবছরে কুঁচিয়া রফতানির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৭৮২ টন। এর পর প্রতি বছরই রফতানির পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। কুঁচিয়া চাষের সুবিধা ॥ কুঁচিয়া অত্যন্ত কষ্টসহিষ্ণু মাছ। এটি অল্প জায়গায় অধিক মজুদ ঘনত্বে চাষ করা যায়। কুঁচিয়ার প্রধান খাদ্য বিভিন্ন প্রজাতির ছোট মাছ, জলজ পোকা ও প্রাণী, যা প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকেই সংগ্রহ করা যায়। কুঁচিয়া পানি থেকে দ্রবীভূত অক্সিজেন এবং বাতাস থেকেও অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারে।
×