ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গণহত্যা স্মরণ দিবস পালন কেন জরুরী

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ১১ মার্চ ২০১৭

গণহত্যা স্মরণ দিবস পালন কেন জরুরী

গণহত্যা স্মরণ দিবস পালন কেন জরুরী হয়ে উঠছে, ৭ মার্চ সেটি আবার বোঝা গেল পাকিস্তানের প্রক্সি পার্টি [পিপিপি : একদিকে তাদেরই উত্তরসূরি] বা বাঙালী বংশোদ্ভূত পাকিস্তানীদের দল বিএনপি নেতাদের বক্তব্যে। তারা বলছেন, যার মর্মার্থ এই যে ৭ মার্চ কী এমন হয়েছিল। একটি বক্তৃতা হয়েছিল যে বক্তৃতায় এমন কোন দিক নির্দেশনা ছিল না। তাদের পিতা বলে তারা যাকে স্বীকার করেন, সেই জেনারেল জিয়াউর রহমান পর্যন্ত ৭ মার্চের বক্তৃতায় দিক নির্দেশনা পেয়েছিলেন আর তার পুত্ররা কোন নির্দেশনা পায় না। কেমন পুত্র এরা? রাজনীতির এত নিম্নমান দেখে অধিকাংশ মানুষ এ থেকে দূরে থাকতে চাইছে। আসলে আইয়ুব খান যে এত জারজপুত্রের সৃষ্টি করেছিলেন কে জানত। ৭ মার্চেরই যখন বিকৃতায়ন হয় তখন স্বাভাবিকভাবে ২৫ ও ২৬ মার্চেরও বিকৃতায়ন হবে। আওয়ামী রাজনীতি এখন দক্ষিণপন্থীদের হাতে। সে কারণে, মুক্তিযুদ্ধের আরও বিকৃতায়ন হবে। এখন আর সে সব কারণে চিন্তিত নই। চিন্তিত, একটি জাতির উত্থান ও পতন দুটিই দেখে যেতে হবে। ২৫ মার্চ নানা ডামাডোলে গুরুত্ব না পাওয়ায় আজ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চায় যেমন তার সাম্যহীনতার সৃষ্টি হচ্ছে, তেমনি ইতিহাস দুমড়েমুচড়ে আইয়ুবের জারজপুত্ররা রাজনীতিতে বিতর্ক-বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। সে জন্য আমরা ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা স্মরণ দিবস পালনের আন্দোলন করেছি। ধেড়েরা যখন ৭ মার্চ কি হয়েছিল জানে না, তখন নেংটিদের জ্ঞানের বহরের কথা চিন্তা করুন! আমাদের অবিমৃশ্যকারিতা, আমাদের জনপ্রতিনিধিদের খালি আধিপত্য ও অর্থের চিন্তা, আমলাতন্ত্রের আইয়ুব-মোনায়েমদের প্রতি এখনও চিন চিনে ভালবাসা ৭, ২৫ ও ২৬ মার্চের গুরুত্ব, গুরুত্বহীন করে তুলছে। এটি বাঙালী পাকিস্তানীদের দূরদৃষ্টির প্রমাণ। তারা তাদের নীলনক্সা বাস্তবায়িত করার জন্য সরকারের চেষ্টায় ঐক্যবদ্ধ। এবং এ কারণে রাজনীতিতে অন্ধতা, মূর্খতা আনতেও তারা রাজি। বিএনপির ধেড়েদের ৭ মার্চ সম্পর্কে মন্তব্য এর প্রমাণ। রাজনীতি যে ক্রমেই একশ্রেণীর হাতে পড়ে বিকৃত, রুচিহীনতায় পরিণত হচ্ছে এটি তারও প্রমাণ। আর এসব প্রতিরোধেই আমরা ২৫ ও ২৬ মার্চ, সংবিধান ও মুক্তিযোদ্ধা দিবস প্রভৃতি যাতে জাতীয়ভাবে পালিত হয় তার আন্দোলন করছি। একইভাবে শুধু বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নভাবে বিচার করলে, গুরুত্ব দিলে তার অপমান হবে, গুরুত্ব হ্রাস পাবে। সামগ্রিকভাবেই, অন্যান্য বিষয়কেও মর্যাদা দিয়ে তাকে তার সঙ্গে স্থাপন করলেই তিনিই যথাযথ সম্মান পাবেন। ধেড়ে বা নেংটিদের নিয়ে আর তেমন চিন্তা করতে হবে না। অবশেষে সরকার হয়ত বিষয়টি খানিকটা অনুধাবন করছে। আমি, ২৫ মার্চ দিবসটি পালন কেন জরুরী, এখানে শুধু সেটিই বিবৃত করব। অবশেষে সরকারীভাবে ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা স্মরণ দিবস’ পালিত হবে। গত ২৫ বছর একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এ দিনটি পালন করে আসছে। সরকারীভাবে না হলেও ঢাকার বাইরে ২৫ মার্চ পালিত হচ্ছে। নির্মূল কমিটি ২৫ মার্চ ঢাকায় কেন্দ্রীয়ভাবে শহীদ মিনারে গণহত্যা দিবস পালনের সূচনা করে সন্ধ্যায়। তারপর আলোর মিছিল জগন্নাথ হল বধ্যভূমিতে গিয়ে শেষ হয়। নির্মূল কমিটির পক্ষে শাহরিয়ার কবির উদ্যোগ নেন সারাদেশে দিবসটি পালনের। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বিভিন্নস্তরে শাহরিয়ার আলোচনা করেছিলেন। আমরা চাইছিলাম, ২১ ফেব্রুয়ারির মতো ২৫ মার্চও আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে পালিত হোক। কিন্তু যখনই ব্যক্তি বা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে এই উদ্যোগ নিয়েছি তখনই প্রশ্ন উঠেছে, ‘আপনাদের সরকার কি তা জাতীয়ভাবে পালন করে’? এর উত্তর দেয়া যায়নি। এ ছাড়া, আন্তর্জাতিকীকরণের জন্য প্রস্তাব পাঠাতে হয় সরকারের পক্ষ থেকে। সরকারী পর্যায়েও কথা বলেছি। কিন্তু, সরকার খুব প্রয়োজন না হলে বা বিপাকে না পড়লে আমাদের পাত্তা দেয় নাÑ এটি বাস্তব সত্য। কিন্তু, আমরা আমাদের কাজে ক্ষান্ত হইনি। এখন আমরা দাবি জানিয়েছিলামÑ ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা স্মরণ দিবস হিসেবে পালিত হোক। কারণ, ইতোমধ্যে জাতিসংঘ ৯ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। গণহত্যা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশনের ঘোষণা ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর গৃহীত হয়। আমরা সতর্ক এবং আগ্রহী হলে ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হতে পারত। এবং বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও অনেক সুবিধা পেত। ফিরে আসি পুরনো প্রসঙ্গে। গত ২৫ বছর এই দিন যাপনে বিএনপি-জামায়াত ও তথাকথিত ‘ইসলামী দল’ বা ধর্মব্যবসায়ীদের দলের নেতাদের বাদে শহীদ মিনারে ২৫ মার্চ পালনে আমরা সবদলের নীতিনির্ধারক, মুক্তিযোদ্ধাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছি। সরকারী দলের নীতিনির্ধারক, মন্ত্রী, মুক্তিযোদ্ধা, সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ আমাদের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়েছেন। কিন্তু সরকার থেকে কোন সাড়া পাইনি। আমরা সংবিধান দিবসও পালন করি। সরকারের কাছে এই দিবসটি পালনেরও অনুরোধ জানিয়েছি মন্ত্রীদের মাধ্যমে, তারা কেউ মন্ত্রিসভায় বা সংসদে সেটি বলেননি। ১ ডিসেম্বর যেহেতু বিজয়ের মাসের শুরু, সেজন্য ওই তারিখটিও মুক্তিযোদ্ধা দিবস হিসেবে ঘোষণার দাবি আমরা করেছি। নীতিনির্ধারকরা তাতেও সাড়া দেননি। আসলে নীতিনির্ধারক বা সরকার যে দিবসটি/গুলো জাতীয়ভাবে পালন করতে চায় না, তা নয়। আসলে কেউ বিষয়গুলোর গুরুত্ব তুলে ধরে সংসদ বা মন্ত্রিসভায় আলোচনা করেননি। গত ২৫ বছর তারা আমাদের কার্যক্রমে অংশ নিয়েছেন, ফিরে গেছেন, ফেরার পথে মন থেকে তা মুছে গেছে। কিন্তু, অবশেষে আমাদের ধৈর্য পুরস্কৃত হয়েছে। আসলে, অনেক সময় সামান্য অনেক ঘটনাও বড় ধরনের সংকল্প গ্রহণে প্রভাব ফেলে। ২০১৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর, আমাদের বিজয় দিবসে পাকিস্তান সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় একটি বই প্রকাশিত হয়। নামÑ‘ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ : মিথস এক্সপ্লোডেড’। বইটি আমাদের হাতে এলে দেখি তা মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা সম্পর্কিত মিথ্যা তথ্যের একটি গুদামবিশেষ। এ কারণে ২৫ মার্চ গণহত্যা স্মরণ দিবস ঘোষণা ও এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য নির্মূল কমিটি একটি আলোচনা সভার আয়োজন করে। আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন মুুক্তিযোদ্ধা তোফায়েল আহমেদ, যিনি আমাদের বাণিজ্যমন্ত্রীও। সভায় শাহরিয়ার বিষয়টি তুলে ধরলে, সেøায়ান ও জুলিয়ান ফ্রানসিস এর গুরুত্ব তুলে ধরেন। আমি শুধু বলেছিলাম, আমরা আন্তর্জাতিক হাতধোয়া [ টয়লেট সম্পর্কিত] দিবস পালন করি কিন্তু গণহত্যা দিবস পালন করতে চাই না। আমরা সেনাবাহিনী দিবস পালন করি জাঁকজমক করে, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা দিবস পালন করি না। কী এ্যাবসার্ড অবস্থা। আরও অনুরোধ জানিয়েছিলাম এই বলে যে, মন্ত্রী যখন সংসদে যাবেন, এ প্রসঙ্গটি সংসদে পারলে যেন তোলেন। প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই এতে সম্মতি দেবেন। সে বিশ্বাস থেকেই একথা বলছি। তোফায়েল আহমেদ খুবই আন্তরিকভাবে উত্তর দিয়েছিলেন। আমিও তো মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু আমি কেন বিষয়টি এভাবে দেখিনি। আমি লজ্জিত। আমি সংসদে এ কথা তুলব বলে কথা দিচ্ছি। তোফায়েল আহমেদ কথা রেখেছিলেন। সংসদে বক্তৃতা দিতে গিয়ে এত আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন যে, অনেকে ভেবেছিলেন তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবেন। জুনায়েদ আহমদের বইয়ের প্রসঙ্গটিও তিনি এনেছিলেন এবং তার বইটি সংসদে দেখিয়েছিলেন। শাহরিয়ারের কাছে যে একটি কপি ছিল তা তিনি মন্ত্রীকে দিয়েছিলেন সংসদে প্রদর্শনের জন্য। এরপর স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী আধঘণ্টার এক আবেগাপ্লুত বক্তব্য রাখলেন এবং ঘোষণা দিলেন, অবশ্যই ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস হিসেবে পালিত হবে। সংসদে একটি দিনও নির্ধারিত হয় বিশেষ আলোচনার জন্য। সংসদ সদস্যরাও সম্মতি জানান। আর একটি ঘটনার উল্লেখ করে এ প্রসঙ্গ শেষ করব। আমাদের ইতিহাস চর্চায় আমরা গণহত্যা-নির্যাতনকে গুরুত্ব দিইনি। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে আমার মনে হয়েছে, এতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চায় ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হচ্ছে। সে প্রসঙ্গে পরে আলোচনা করব। তাই আমার গবেষণায় এ বিষয়ে গুরুত্বারোপ করি। খুলনায় এ কারণে ডাঃ শেখ বাহারুল আলম ও আমার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় দেশের প্রথম গণহত্যা নির্যাতন বিষয়ক আর্কাইড ও জাদুঘর। শিল্পী হাসেম খান, শাহরিয়ার কবির, তারিক সুজাতও এটি গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখেন। এক পর্যায়ে আমরা একটি পরিত্যক্ত ভবনের জন্য আবেদন করি। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে খুলনার দুই কমিশনার এক্ষেত্রে (মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের হিসেবে সরকার কর্তৃক সমাদ্রিত ও প্রমোশন প্রাপ্ত) প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছেন, মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও আগ্রহ দেখাননি। ঘুরে ঘুরে এখন আমি ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের’ জাহির করা আমলাদের কার্যকলাপ দেখে বিরক্ত ও ক্লান্ত, তখন এই তোফায়েল আহমেদ ও পূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেনের হস্তক্ষেপে ফাইল প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রেরিত হয়। বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, কোন তদ্বির ছাড়া প্রধানমন্ত্রী কয়েক দিনের মধ্যে সে ফাইল অনুমোদন করে ফেরত পাঠান। জনস্বার্থে দেয়া এসব ভবনের নামমাত্র মূল্য ধরা হয়। চলবে...
×