ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

১৯ বাংলাদেশী দালাল চক্র সুদান হয়ে লোক পাঠাচ্ছে লিবিয়ায়

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১১ মার্চ ২০১৭

১৯ বাংলাদেশী দালাল চক্র সুদান হয়ে লোক পাঠাচ্ছে লিবিয়ায়

তৌহিদুর রহমান ॥ লিবিয়ার চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটের ফলে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি পাঠানোর বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও একটি শক্তিশালী দালাল চক্র সুদান হয়ে সে দেশে লোক নিচ্ছে। সেখানে বাংলাদেশীদের আটক করে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনাও অব্যাহত রয়েছে। লিবিয়ায় বাংলাদেশীদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়কারীদের অন্যতম হোতা জহির শাহের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দেয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছে সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাস। এছাড়া ১৯ বাংলাদেশীর একটি শক্তিশালী দালাল চক্র সুদান থেকে লিবিয়ায় অবৈধভাবে লোক নিচ্ছে। তিন দফায় বিবৃতি দিয়ে লিবিয়ায় যেতে নিষেধ করেছে বাংলাদেশ সরকার। লিবিয়া ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার ফলে সেখানে শ্রমিক পাঠানোর বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করে সরকার। লিবিয়া পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত সেখানে শ্রমিকদের যেতে নিষেধও করা হয়। তবে নিষেধাজ্ঞা না মেনে লিবিয়ায় লোক পাঠানো অব্যাহত রয়েছে। সূত্র জানায়, সুদান হয়ে মানবপাচারকারীদের সহায়তায় বাংলাদেশীরা অবৈধভাবে লিবিয়ায় প্রবেশ করছে। তারা লিবিয়ায় প্রবেশের পর আজদাবিয়ায় সংঘবদ্ধ বাংলাদেশী দালাল চক্রের হাতে জিম্মি হচ্ছে। মুক্তিপণের জন্য ওপর চালানো হচ্ছে নির্মম তাদের নির্যাতন। এই নির্যাতন এড়াতে পরিবারের কাছ হতে দালালদের অর্থ দিতে বাধ্য হচ্ছে। কোন কোন ক্ষেত্রে অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে নির্মম নির্যাতনের শিকার হচ্ছে এরা। এ বিষয়ে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশীদের জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়কারীদের অন্যতম হোতা জহির শাহের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য চেয়ে একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস। মুক্তিপণ আদায়, নির্যাতন ও হত্যাচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে একটি দালাল চক্র। লিবিয়ায় আজদাবিয়ার বাংলাদেশী দালালদের সংঘবদ্ধ এই চক্রের অপতৎপরতা বন্ধের জন্য লিবিয়ার দূতাবাস থেকে কয়েক দফায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এসব দালাল সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দূতাবাসকে জানাতেও বলা হয়। এছাড়া গত ২৭ ফেব্রুয়ারি লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে মুক্তিপণ আদায়কারী জহির শাহের বিস্তারিত তথ্য চাওয়া হয়। গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে দূতাবাস থেকে জানানো হয়, জহির শাহ বাংলাদেশী কর্মীদের অপহরণ করে নির্মম নির্যাতনের ছবি ভিডিও করে স্বজনদের কাছে পাঠিয়ে মুক্তিপণ আদায় করছে। বিশেষ করে সেলিম মিয়া ও শাহ আলম নামে দুই প্রবাসীকে আটকের পর মুক্তিপণ আদায় করেও তাদের মুক্তি না দিয়ে আরও টাকা আদায়ের চেষ্টা করছে। এই মুহূর্তে জহির শাহের অধীনে ১২ বাংলাদেশী কর্মী অপহৃত রয়েছে। এসব ব্যক্তির ভিডিও তাদের আত্মীয়দের দেখিয়ে অর্থ চাওয়া হয়েছে। জহির শাহের বিষয়ে প্রবাসীদের কাছে বিস্তারিত তথ্য চেয়েছে লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস। লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস প্রতারিতদের অভিযোগের ভিত্তিতে ইতোমধ্যেই দেশের বিভিন্ন এলাকার ১৯ জনের একটি তালিকাও প্রকাশ করা হয়েছে। এরা হলো- কুমিল্লার সবুজ, আনোয়ার, নাসির, অঞ্জন, যশোরের মুরাদ, ফেনীর কানা আনোয়ার, ফরিদপুরের নাসির, ঝিনাইদহের আলী, টাঙ্গাইলের লাল মিয়া, মুন্সীগঞ্জের জালাল, রাজীব, সজীব, চাঁদপুরের নাসির, বরিশালের সবুজ, রফিক, মিরাজ, নরসিংদীর বাসেদ, আলমগীর, গাজীপুরের রাজীব। এসব দালালরা সুদান থেকে লিবিয়ায় অবৈধভাবে বাংলাদেশীদের নিয়ে যাচ্ছেন। এদের বিরুদ্ধে তদন্তও চলছে। গত বছর মার্চের প্রথমদিকে দালালরা লিবিয়ার বেনগাজীতে এক ব্যক্তিকে আটকে রেখে টাকা-পয়সা দাবি করে। পরে দূতাবাসের মাধ্যমে তাকে উদ্ধার করা হয়। ওই ঘটনায় জড়িত থাকায় সাতজনকে আটক করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে মানবপাচার আইনে মামলা হয়। এছাড়া চলতি বছর ৮ মার্চ লিবিয়া থেকে ২৭ বাংলাদেশীকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। এসব বাংলাদেশী দীর্ঘ ছয় মাস ধরে সেখানকার গারিয়ান ডিটেনশন সেন্টারে আটক ছিলেন। অবশেষে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সহযোগিতায় তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হয়। এসব বাংলাদেশীকে ইতালি নেয়ার জন্য দালালচক্র সেখানে নিয়ে গিয়েছিল। পরে লিবিয়া সরকার তাদের আটক করে ডিটেনশন সেন্টারে রাখে। বাংলাদেশ সরকার থেকে লিবিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলেও সে দেশে বিভিন্নভাবে শ্রমিক যাচ্ছিলেন। তবে সেসব শ্রমিক লিবিয়া যাচ্ছিলেন ইউরোপে যাওয়ার উদ্দেশে। লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর হয়ে এসব শ্রমিক ইউরোপে পাড়ি জমিয়ে থাকে। কারণ, মুয়াম্মার আল গাদ্দাফির পতনের পর গৃহযুদ্ধ বিধ্বস্ত লিবিয়া এখন ইউরোপমুখী মানবপাচারের অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের ৩১ মে থেকে লিবিয়া সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশী শ্রমিকদের লিবিয়ায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। দেশটির অভিযোগ লিবিয়ার কোম্পানিতে বাংলাদেশীরা চাকরি নিয়ে আসে। তারপর অবৈধপথে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করে। অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে লিবিয়া সরকারের অনুরোধে বাংলাদেশ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ২০১১ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরুর পর লিবিয়া থেকে ৩৬ হাজার বাংলাদেশীকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। তবে অনেকেই সঙ্কটের মধ্যেও দেশটিতে থেকে যান। পরবর্তী সময়ে দেশটির অচলাবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে বাংলাদেশ থেকে কর্মী পাঠানো শুরু হয়। তারপর বাংলাদেশ থেকে কিছু কিছু শ্রমিক লিবিয়া গেলেও দেশটির পরিস্থিতি গত বছর থেকে আরও বেশি অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের ৩১ মে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রথম লিবিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এরপর একই বছরের ১৪ জুলাই বাংলাদেশীদের লিবিয়ায় না যেতে সতর্ক করা হয়। সর্বশেষ ২০১৫ সালের বছর ৮ অক্টোবর বাংলাদেশীদের লিবিয়ায় যেতে আবারও নিষেধ করা হয়। তবে এই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই দালাল চক্র সুদান হয়ে লিবিয়ায় লোক পাঠাচ্ছে।
×