ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আবারও দল ভাঙ্গার গুঞ্জন

দলের ভাঙ্গন ঠেকাতে তৎপর বিএনপি হাইকমান্ড

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১১ মার্চ ২০১৭

দলের ভাঙ্গন ঠেকাতে তৎপর বিএনপি হাইকমান্ড

শরীফুল ইসলাম ॥ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপিতে আবারও দল ভাঙ্গার গুঞ্জন শুরু হয়েছে। তবে দলের ভাঙ্গন ঠেকাতে তৎপর বিএনপি হাইকমান্ড। ইতোমধ্যেই সন্দেহভাজন নেতাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ শুরু হয়েছে। সেই সঙ্গে নিষ্ক্রিয় নেতাদের দলীয় কর্মকা-ে সক্রিয় করে সর্বস্তরে গতি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। সূত্র মতে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে এবং এ নির্বাচনের আগে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ বেশ কজন সিনিয়র নেতা মামলার কারণে নির্বাচনে অযোগ্য হলে দল চরম বৈরী অবস্থার মুখে পড়বে এমন আগাম চিন্তা করে ক্ষমতালোভী কিছু নেতা সরকারী দলের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চান। এমন সুযোগ সন্ধানী কিছু বিএনপি নেতা ভেতরে ভেতরে সংগঠিত হয়ে দল ভেঙ্গে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে চায়। এমন একটি আভাস পেয়ে বিএনপি হাইকমান্ড তৎপর হয়েছে। জানা যায়, দল ভাঙ্গার গুঞ্জন চললেও প্রথমে বিএনপি হাইকমান্ড তা আমলে নেয়নি। কিন্তু সম্প্রতি সরকারী দলের সিনিয়র নেতারা বার বার একটি কথা জোর দিয়ে উচ্চারণ করছেÑ আর তা হলো একাদশ জাতীয় সংসদে বিএনপি অবশ্যই অংশ নেবে। সরকারী দলের নেতাদের মুখে এ ধরনের কথা শুনে বিএনপি হাইকমান্ডের সন্দেহ বেড়ে যায়। এ জন্য দলের ভাঙ্গন ঠেকাতে ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি শুরু করে। দলের ভাঙ্গন ঠেকানোর অংশ হিসেবেই সম্প্রতি বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া সংস্কারপন্থী নেতাদের দলে ফিরিয়ে আনার কৌশল নেন। এরই অংশ হিসেবে তিনি ২ জন প্রভাবশালী সংস্কারপন্থী নেতার সঙ্গে বৈঠকও করেন। অন্যান্য সংস্কারপন্থী নেতার সঙ্গেও তিনি পর্যায়ক্রমে বৈঠক করবেন বলে কর্মপরিকল্পনা ঠিক করে রেখেছেন। সম্প্রতি দলীয় এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা জয়নুল আবেদীন ফারুক বলেন, সরকার বিএনপিকে ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র করছে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি নির্বাচনে যেতে বাধ্য। ওবায়দুল কাদের সাহেব কি করে আমার ঘরের কথা জানেন? বিএনপি নির্বাচনে যাবে কি যাবে না এটা দলীয় সিদ্ধান্তের ব্যাপার। তবে সরকারী দলের নেতাদের এমন বক্তব্যে মনে হচ্ছে বিএনপি ভাঙ্গার চেষ্টা করা হচ্ছে। এদিকে বিএনপির যেসব নেতা দল ভাঙ্গনের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে তাদের প্রত্যেকের পেছনে দলীয় হাইকমান্ড লোক ঠিক করে দিয়েছেন বলে জানা গেছে। এভাবে সন্দেহভাজন এসব নেতারা কোথায় যান এবং কি করেন সে ব্যাপারে খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। বিশেষ করে ওয়ান-ইলেভেনের সময় যারা গোপনে দলে দুই কূল রক্ষা করে চলেছেন তাদের বিষয়ে নজরদারি জোরদার করা হচ্ছে। সন্দেহভাজন এমন দু’একজনকে পরোক্ষভাবে সতর্কও করা হয়েছে বলে জানা গেছে। উল্লেখ্য, বিএনপির সংস্কারপন্থী যেসব নেতারা এখনও দলের বাইরে রয়েছেন তারাই ছিল এক সময় দলের মূল শক্তি। দলীয় যে কোন কর্মকা-ে তাদের সরব উপস্থিতি বিএনপির এগিয়ে চলার পথে সাহস যোগাত। তাই দলের দুর্দিনে আবার তাদের ফিরিয়ে আনতে বিএনপি হাইকমান্ড চেষ্টা করছেন। তবে সংস্কারপন্থীদের প্রতি দলের সাধারণ নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশের ক্ষোভ থাকায় একটি কৌশল প্রয়োগ করে তাদের দলে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। আর এ কৌশলের অংশ হিসেবেই সংস্কারপন্থীদের দলে ফিরে পদ-পদবি পেতে হলে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে অতীত কর্মকা-ের জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে হবে। জানা যায়, দল ভাঙ্গার গুঞ্জন শুরুর পর বিএনপিকে গতিশীল রাখার জন্য চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও দলের থিঙ্কট্যাংক বলে পরিচিত কিছু বুদ্ধিজীবী বিভিন্নভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। দলের আরও কিছু সিনিয়র নেতাও সঙ্কট উত্তরণে খালেদা জিয়াকে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসছেন না। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের পর যে ধরনের সঙ্কটের মুখে পড়ে বিএনপি আর যাতে সে রকম পরিস্থিতি না হয় সে জন্যই তাদের যত চেষ্টা। বিশেষ করে যদি খালেদা জিয়াসহ দলের কিছু সিনিয়র নেতাকে কারাবরণও করতে হয় তারপরও যেন দল ঐক্যবদ্ধ থাকে সে ভাবনা থেকেই ভবিষ্যত পরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে। প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালে টানা ৯২ দিন আন্দোলন চলাকালে গাড়ি পোড়ানো ও মানুষ হত্যা মামলা এবং জিয়া চ্যারিটেবল ও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলাসহ বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে বিএনপিকে বড় ধরনের সঙ্কটের মুখে ফেলেছেন চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দলের অন্য নেতারাও গাড়ি পোড়ানোসহ বিভিন্ন মামলার আসামি। বেশ ক’জন নেতা কারাগারেও রয়েছেন। শীঘ্রই এসব মামলার চূড়ান্ত রায় হয়ে যাবে বলে সরকারী দলের নেতারা বলে আসছেন। আর তা হলে খালেদা জিয়াসহ দলের আরও কজন সিনিয়র নেতা গ্রেফতার হতে পারেন। মামলার কারণে কারাগারে যেতে হলে তারা আপাতত রাজনীতিও করতে পারবেন না। খালেদা জিয়া গ্রেফতার হলে তার ছেলে লন্ডন প্রবাসী তারেক রহমানও একাধিক মামলার ফেরারি আসামি হওয়ায় দেশে আসতে চাইবেন না। কেউ কেউ তারেক রহমানের স্ত্রী ডাঃ জোবাইদা রহমানকে রাজনীতিতে আনার চেষ্টা করলেও ডাঃ জোবাইদার এ ব্যাপারে কোন আগ্রহ নেই বলে জানা গেছে। তাই চলমান পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে না পারলে ভবিষ্যতে বিএনপিকে আরও কঠিন সময় অতিক্রম করতে হবে। তাই সে বিষয়গুলো মাথায় রেখেই বিএনপি হাইকমান্ড ভবিষ্যত পরিকল্পনা করছেন বলে জানা গেছে। বর্তমান পরিস্থিতিকে মাথায় রেখে দলের ত্যাগী কিন্তু এখন নিষ্ক্রিয় এমন নেতাদের আবার সক্রিয় করার চেষ্টা করছেন বিএনপি হাইকমান্ড। ইতোমধ্যেই এসব নেতাদের দলে সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। এমন ক’জন নেতা ইদানীং দলীয় বিভিন্ন কর্মকা-ে অংশ নিতে শুরু করেছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর বিএনপি ক্ষমতা ছাড়ার আগে থেকেই দলের কিছু নেতা সংস্কারের পক্ষে সংগঠিত হতে থাকে। বিশেষ করে দলের হাইকমান্ডের একগুয়েমির কারণে যখন জাতীয় সংসংদ নির্বাচন যথাসময়ে হলো না এবং এ নিয়ে সঙ্কট দেখা দেয়ায় দেশে ওয়ান-ইলেভেন আসে। আর ওয়ান-ইলেভেনের পর বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া এবং সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানসহ দলের শতাধিক নেতা খালেদা জিয়ার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে সংস্কারপন্থী বিএনপি গঠন করে দলে ভাঙ্গন সৃষ্টি করে। এরপর চলতে থাকে সংস্কারপন্থী বিএনপি ও খালেদাপন্থী বিএনপির পাল্টা পাল্টি কর্মসূচী। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ বিএনপির বেশ কজন সিনিয়র নেতা কারাবন্দী থাকায় একপর্যায়ে বিএনপির রাজনীতিতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে সংস্কারপন্থীরা। ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়া জেল থেকে মুক্ত হলে এবং তারেক রহমান চিকিৎসার জন্য লন্ডন চলে গেলে সংস্কারপন্থী নেতাদের তৎপরতা আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে যায়। ২০০৮ সালের ২৯ নবেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সংস্কারপন্থী বিএনপির বেশ কজন নেতা খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রেখে ঘরে ফিরে আসে।
×