ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

চার হাজারের বেশি অটোরিক্সায় বাড়তি জমা আদায়

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ১১ মার্চ ২০১৭

চার হাজারের বেশি অটোরিক্সায় বাড়তি জমা আদায়

রাজন ভট্টাচার্য ॥ রাজধানীর মাদারটেক এলাকার আব্দুল আজিজ স্কুলের পেছনে মোঃ জামালের অটোরিক্সার গ্যারেজ। সরকারী নিয়ম অনুযায়ী প্রতি অটোরিক্সার জমা ৯০০ টাকা। অথচ দুই শিফটে প্রতি গাড়ি থেকে আদায় করা হচ্ছে এক হাজার ৩০০ টাকা। এরমধ্যে সকাল ৬টা থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত সকালের শিফটে ৭০০ টাকা। বিকেল থেকে রাত অবধি ৬০০ টাকা! এই মালিকের মোট ৬০ গাড়ির প্রতিটি থেকে দিনে ৪০০ টাকা করে বাড়তি অর্থ আদায় করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। নগরীর আরেকটি গেরেজের ঠিকানা মীরহাজীরবাগের সিও অফিসের গলি। মালিক মোঃ জয়নাল। তার রয়েছে ১০২ অটোরিক্সা। দুই শিফটে প্রতি গাড়ি থেকে দিনে জমা নেয়া হচ্ছে এক হাজার ৯০০ টাকা পর্যন্ত। অর্থাৎ প্রতি গাড়ি থেকে দিতে বাড়তি এক হাজার টাকা বেশি নেয়া হচ্ছে। মেরুল বাড্ডা এলাকার আনন্দ নগর ঝিলপাড়ে মাস্টার সেলিম মিয়ার অটোরিক্সার গ্যারেজ। ২০ গাড়ির প্রতিটি থেকে দিনে জমা নেয়া হয় এক হাজার ৬৬০ টাকা পর্যন্ত! বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) বলছে, রাজধানীতে তালিকাভুক্ত অটোরিক্সার সংখ্যা ১৩ হাজার। মালিক সমিতির নেতারা বলছেন, এরমধ্যে সর্বোচ্চ ছয় থেকে সাত হাজার গাড়ি চলাচল করছে। বাস্তবতা হলো, যে পরিমাণই গাড়ি চলুক না কেন এগুলোর মধ্যে চার হাজার ২৪৩ অটোরিক্সা থেকে বাড়তি জমা নেয়ার অভিযোগ মিলেছে। নগরীর ৯৯ গ্যারেজ মালিকের অধীনে রয়েছে এই গাড়িগুলো। সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা পর্যন্ত জমা নেয়ার অভিযোগ রয়েছে মালিকদের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে বিআরটিএ সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের কাছে বাড়তি জমা রাখা অটোরিক্সা মালিকদের তালিকা পাঠানো হয়েছে। একটি শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে করা তালিকায় গ্যারেজ মালিকের নাম, ঠিকানা মোবাইল নম্বরসহ জমার পরিমাণও যুক্ত করা হয়েছে। অপরদিকে অটোরিক্সা চালকের বিরুদ্ধে রয়েছে বাড়তি ভাড়া নেয়ার বিস্তর অভিযোগ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৯০ ভাগ গাড়িচালক যাত্রীদের থেকে বাড়তি ভাড়া আদায় করছেন। ৯৪ ভাগ গাড়ি মিটারে চলে না। অর্থাৎ চুক্তিতে গাড়ি চলান। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ধোঁকা দিতে যাত্রী থাকা অবস্থায় সচল রাখা হয় মিটার। এক্ষেত্রে যাত্রীরা অসহায়। প্রতিবাদ করেও কোন লাভ না হওয়ার কথা জানান তারা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএ সচিব শওকত আলী জনকণ্ঠকে বলেন, লিখিত অভিযোগ বড় বিষয় নয়। আমরা গোটা অনিয়মের বিরুদ্ধে কাজ করছি। মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। মালিক শ্রমিক যারাই অপরাধ করুক কেউ আইনের উর্ধে নয়। তিনি বলেন, এখন অটোরিক্সার বিভিন্ন গ্যারেজেও মোবাইল কোর্ট করা হচ্ছে। মোবাইল কোর্ট, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা আরও বাড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার লক্ষে ২০১৫ সালের ১ নবেম্বর থেকে সিএনজিচালিত অটোরক্সিার ভাড়া ও জমা পুনর্নির্ধারণ করে সরকার। মালিকদের জমা বাড়িয়ে ৬০০ টাকার স্থলে করা হয় ৯০০ টাকা। নতুন ভাড়া অনুযায়ী প্রথম দুই কিলোমিটারে ভাড়া ২৫ টাকার স্থলে ৪০ টাকা করা হয়েছে। সর্বনিম্ন ভাড়াও তাই। পরবর্তী প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া সাত টাকা ৬৪ পয়সার স্থলে ১২ টাকা করা হয়। যানজট বা অন্য কোন কারণে রাস্তায় বিরতিকালে প্রতি মিনিটের ভাড়া এক টাকা ৪০ পয়সার স্থলে ২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর আগে ২০১১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা ও চট্টগ্রামে গণপরিবহনে ভাড়া বাড়ানো হয়েছিল। বাস্তত চিত্র হলো যতবার ভাড়া বাড়ানো হয়েছে ততবারই স্বার্থ রক্ষা হয়েছে অটোরিক্সা মালিক ও চালকদের। তার পরও যাত্রীদের নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি গুনতে হয়েছে। এখন হচ্ছে। পরিবহন সেক্টরের একটি ছোট্ট খাত অটোরিক্সা। অথচ এই সেক্টরের ভাড়া ও জমা নৈরাজ্য রোধে কার্যকর কোন ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত করা সম্ভব হলো না। অটোরিক্সা মালিক শ্রমিকরা এজন্য অবশ্য একে অপরের ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করেন। এটাই দায় এড়ানোর সংস্কৃতি। মালিকদের বক্তব্য হলো, জমা ঠিক নেয়া হলেও চালকরা বাড়তি ভাড়া আদায় করেন। চালকদের বক্তব্য, মালিকদের জমা শোষণের কারণে বাড়তি ভাড়া নেয়া ছাড়া বিকল্প নেই। তাছাড়া নিয়ম ভেঙ্গে মালিকরা দুই শিফটে গাড়ি ভাড়া দিচ্ছেন। গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে সময়ের বাধ্যবাধকতা থাকায় বাড়তি ভাড়া নিতে হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অটোরিক্সা মালিক সমিতির সভাপতি বরকতউল্লাহ বুলু বলেন, আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি বাড়তি জমা ও ভাড়া নিয়ন্ত্রণের জন্য। তবে ঢালাও অনিয়মের অভিযোগ সঠিক নয় বলেও দাবি করেন তিনি। ঢাকা অটোরিক্সা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হানিফ খোকন বলেন, অটোরিক্সা মালিকরা বাড়তি জমা নেয়ার ক্ষেত্রে বেপরোয়া বলা চলে। এতে গোটা অটোরিক্সা সেক্টরে অরাজগতা তৈরি হয়েছে। মালিকরা বাড়তি জমা নেয়ার কারণে চালকরাও বাড়তি ভাড়া আদায় করছেন। বাড়তি ভাড়ার কারণে চালকদের বিরুদ্ধে মামলা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে গোড়াতেই গলদ থাকায় অটোরিক্সা নিয়ে মানুষের অভিযোগ কমছে না। মালিকদের দুই শিফটে গাড়ি চালানোর প্রবণতা কমাতে হবে পাশাপাশি সরকার নির্ধারিত জমা নেয়া নিশ্চিত হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে বলেও মনে করেন এই শ্রমিক নেতা। যাত্রী কল্যাণ সমিতি নামের একটি সংগঠনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৯৪ ভাগ অটোরিক্সাই মিটারে চলে না। দ্বিগুণের বেশি ভাড়া আদায় করে যাত্রীদের কাছ থেকে। সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক বলেন, ২০১৫ সালে সরকার বাস ভাড়া কিলোমিটারে ১০ পয়সা ভাড়া বাড়ানোর পর মালিকরা তা না মেনে কিলোমিটারে ৩০ থেকে ৪০ পয়সা পর্যন্ত বাড়ান। বর্তমানে যে ভাড়া নেয়া হয়, তা সরকার নির্ধারিত ভাড়ার প্রায় দ্বিগুণ। এ পরিস্থিতিতে আবারও ভাড়া বাড়ানো হলে, অতীতের মতোই নৈরাজ্য হবে। সরকার ১০ পয়সা ভাড়া বাড়ালে মালিকরা ২৫ থেকে ৩০ পয়সা বাড়াবেন। তাছাড়া অটোরিক্সার ক্ষেত্রে ভাড়া ও জমা নির্ধারিত হলেও কেউ তা মানে না। মালিকরা চালকদের জিম্মি করছেন। আর চালকদের কাছে জিম্মি সাধারণ যাত্রীরা। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য সরকারকে কঠোর হওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। নৌ সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক আশীষ কুমার দে বলেন, সামান্য কিছু পরিবহনের অরাজগতা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না এটা সত্যিই বিস্ময়কর খবর। অটোরিক্সার শুরু থেকেই মানুষের নানা অভিযোগ। এত বছরেই এই গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব হয়নি। এটা সত্যিই বেদনাদায়ক। তিনি বলেন, বিআরটিএ ও পুলিশ তৎপর হলেই পরিস্থিতি এক মাসের মধ্যে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।
×