ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

রোজার আগেই ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়াতে তৎপর ব্যবসায়ীরা

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১১ মার্চ ২০১৭

রোজার আগেই ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়াতে তৎপর ব্যবসায়ীরা

এম শাহজাহান ॥ তিন মাস আগেই রোজার ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে ব্যবসায়ীরা। যদিও আমদানি পরিস্থিতি গতবারের চেয়ে বেশি এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম নিম্নমুখী ধারায় রয়েছে। এরই মধ্যে বেড়ে গেছে ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা এবং ডালের দাম। উৎপাদন মৌসুম হওয়ার কারণে পেঁয়াজে কিছুটা স্বস্তি থাকলেও রসুনের দাম নিয়ন্ত্রণহীন। প্রথমবারের মতো গরুর মাংসের দাম নিয়ে ভোক্তাদের যন্ত্রণা পোহাতে হচ্ছে। রমজানে গরু ও খাসির মাংসের দামের পারদ কোথায় উঠে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন সাধারণ ভোক্তারা। তবে রোজায় অতি অত্যাবশ্যকীয় এই ছয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থানে থাকবে সরকার। ইতোমধ্যে নতুন করে বাজার মনিটরিং কমিটি করা হয়েছে। সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থা টিসিবি বরাবরের মতো এবারও রমজানে ভর্তুকি দিয়ে পণ্য বিক্রি কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে। চিনি আমদানিতে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। পণ্যটির দাম নাগালের বাইরে চলে গেলে তা নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনে শুল্ক প্রত্যাহর করা হতে পারে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পণ্যমূল্য নিয়ে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের কারসাজি বন্ধ করা গেলে ভোগ্যপণ্যের দাম স্বাভাবিক থাকবে আগামী রমজানে। জানা গেছে, ব্যবসায়ীদের কারসাজি ও সিন্ডিকেশনের কারণে আমদানি বেশি হওয়ার পরও ভোগ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে দাম বাড়বে না বলে ব্যবসায়ীরা সরকারকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা আর রক্ষা হয়নি। মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে অবশেষে ওয়াদা ভঙ্গ করছেন ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায়ীরা। দুর্বল বাজার তদারকি এবং যথাযথ আইন প্রয়োগের অভাবের কারণে তারা অতিরিক্ত মুনাফা করার সুযোগ পাচ্ছে। এদিকে, ভোক্তাদের স্বার্থ বিচেবনায় নিয়ে ১৭টি পণ্যকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার। পণ্যগুলোকে অত্যাবশ্যকীয় করার উদ্দেশ্য হচ্ছে, ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা। কিন্তু রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে ও গত এক বছরের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ইতোমধ্যে ডজনখানিক পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছেÑ সয়াবিন তেল, পাম তেল, রসুন, মসুর ডাল, ছোলা, চিনি, ধনিয়া, জিরা, আদা, হলুদ, রসুন, তেজপাতা ও খাদ্য লবণ। জানা গেছে, দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই বৈঠকে ব্যবসায়ীদের ভোজ্যতেল, লবণ এবং চিনির দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করা হয়। ট্যারিফ কমিশনের পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে। তবে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বরাবরই বলে আসছেন, ভোক্তাবান্ধব সরকার ভোগ্যপণ্যের দাম স্বাভাবিক রাখতে সব ধরনের কর্মসূচী গ্রহণ করবে। আর রমজানে জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কোন সুযোগ নেই। কিন্তু মন্ত্রীর এই বক্তব্যকে সরকারী ভাষ্য উল্লেখ করে ভোগ্যপণ্য খাতের একজন ব্যবসায়ী জনকণ্ঠকে বলেন, জিনিসপত্রের দাম বাড়ে আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভর করে। বিশ্ব বাজারে দাম বেশি হলে দেশেও পণ্য মূল্য বাড়বে। তিনি বলেন, মুসলিম বিশ্বের বড় ধর্মীয় এই মাস সামনে রেখে পণ্যের দাম বাড়াতে শুধু দেশী ব্যবসায়ীরা জড়িত নয়, এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী শিল্পগোষ্ঠীও বড় নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করে। আগে তাদের চিহ্নিত করা প্রয়োজন। রোজা সামনে রেখে আমদানি পরিস্থিতি ॥ রমজান মাস সামনে খাদ্যশস্যসহ ভোগ্যপণ্যের আমদানি বেড়েছে। চলতি মার্চ থেকে আগামী মে মাসে রোজা শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত ভোগ্যপণ্যের আমদানি বাড়ার ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আভাস দিয়েছেন আমদানিকারকরা। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) সামগ্রিক আমদানি বেড়েছে ১২ শতাংশের বেশি। ইতোমদ্যে খাদ্যদ্রব্য আমদানিতে এলসি খোলা বেড়েছে। বর্তমান অভ্যন্তরীণ বাজারে প্রতি কেজি চিনি ৬৮-৭০, প্রতি লিটার ভোজ্যতেল খোলা ৮৬-৮৮, প্রতি কেজি মসুর ডাল নেপালী ১৪৫-১৫০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। বাড়তি দামে এসব পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আমদানিবিষয়ক সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য ব্যাংকগুলোতে ২ হাজার ৭৪৬ কোটি ডলারের এলসি খুলেছেন আমদানিকারকরা। যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১২ দশমিক ৩২ শতাংশ বেশি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে ব্যাংকগুলোতে ২ হাজার ৪৪৫ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়। সাধারণত এলসি খোলার ৯০ দিনের মধ্যে পণ্য দেশে আসে। অনেক ক্ষেত্রে এলসি বাতিলের ঘটনাও ঘটে। আমদানি মূল্য পরিশোধ হলে তাকে এলসি নিষ্পত্তি বলা হয়। তবে এলসি নিষ্পত্তিও আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে। গত জুলাই-জানুয়ারি সময়ে ২ হাজার ৬৫৫ কোটি ডলারের এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে। যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১২ দশমিক ২৪ শতাংশ বেশি। ওই সময়ে ২ হাজার ৩৬৫ কোটি ডলারের এলসি নিষ্পত্তি হয়। অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নবেম্বর) সামগ্রিক আমদানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ। ছয় মাসে সামগ্রিক ৯ দশমিক ৩০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়। এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক প্রথম সহসভাপতি আবুল কাশেম আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, দেশের অর্থনীতি ইতিবাচক ধারায় এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা মধ্যম আয়ের দেশের দ্বারপ্রান্তে। সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচীর ফলে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা ও চাহিদা বাড়ছে। ফলে আমদানি বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। এছাড়া সামনে রমজান আসছে। এ কারণে রমজানে প্রয়োজন এসব পণ্যের আমদানি বেড়েছে। তিনি বলেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর কারণে রমজানে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। এসব ব্যবসায়ীরা যাতে সুযোগ না নিতে পারে সেদিকে সরকারের নজর দেয়া প্রয়োজন। জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে গম, ডাল, চিনি, দুগ্ধজাত খাবার ও শুকনো ফল আমদানিতে এলসি খোলা সবচেয়ে বেশি হারে বেড়েছে। তবে দেশে উৎপাদন ভালো হওয়ায় চাল ও পেঁয়াজের আমদানিতে এলসি খোলা কমেছে। দাম বাড়লেও ভোজ্যতেলের এলসি খোলাও কমেছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন ধরনের ডাল আমদানিতে এলসি খোলা হয়েছে ৩৭ কোটি ডলারের, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ৮৫ শতাংশ বেশি। চিনি আমদানিতে ৭১ শতাংশ বেশি এলসি খোলা হয়েছে। গত সাত মাসে চিনি আমদানির জন্য ব্যাংকগুলোতে ৫৪ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৩২ কোটি ডলার। শুকনো ফল আমদানির জন্য ২০ কোটি ডলারের এলসি খুলেছেন ব্যবসায়ীরা। যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেশি। এদিকে, ভোগ্যপণ্যের বাজারে প্রতি কেজি ছোলার খুচরা দাম হচ্ছেÑ ৮০-৯০ টাকা। গত এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ৭০-৭৫ টাকায়। পণ্যটির আমদানি খরচ, আন্তর্জাতিক মূল্য এবং অভ্যন্তরীণ বাজার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, পাইকারি থেকে খুচরা পর্যায়ের সব খরচ মিলিয়ে এ পণ্যটির সর্বোচ্চ বিক্রি মূল্য হওয়ার কথা প্রায় ৫৫ টাকা। অর্থাৎ এই এক পণ্যেই প্রতি কেজিতে প্রায় ২৫-৩০ টাকা অতিরিক্ত হাতিয়ে নিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ী চক্র। রমজানের তিন মাস আগেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য থেকে অযৌক্তিক মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্বভোগীরা। একইভাবে ভোজ্যতেল, মসুর ডাল, মটর ডাল এবং চিনিতে অতিরিক্ত লাভ আদায় করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। বাজার বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি অসাধু ব্যবসায়ী চক্রের কৌশল। কনজ্যুমার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণে রমজান সামনে রেখে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাচ্ছে। সরকারের উচিত হবে মূল্য কারসাজির সঙ্গে জড়িত কিংবা অবৈধ মুনাফাকারী ওইসব ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি করা। নতুবা দাম বৃদ্ধির এ প্রতিযোগিতা নতুন নতুন কৌশল চলতেই থাকবে। রমজান সামনে রেখে টিসিবির প্রস্তুতি ॥ রমজান উপলক্ষে সারাদেশের ১৭৪টি পয়েন্টে টিসিবি ট্রাক বসাবে। যেখানে চিনি, মসুর ডাল, ছোলা, সয়াবিন তেল ও খেজুর সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি হবে। রাজধানী ঢাকার ২৫টি পয়েন্টে, চট্টগ্রামের ১০টি, অন্য বিভাগীয় শহরে ৫টি করে ট্রাক বসবে। এছাড়া জেলা শহরে দু’টি করে মোট ১৭৪টি স্থানে অস্থায়ীভাবে ট্রাক বসিয়ে স্থানীয় বাজারের তুলনায় কিছুটা কম দামে পাঁচটি পণ্য বিক্রি করা হবে বলে জানিয়েছেন টিসিবি’র এক কর্মকর্তা। রমজান উপলক্ষে ৫০০ মেট্রিক টন সয়াবিল তেল, ১ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন ছোলা খোলা বাজারে ছাড়া হবে। এ প্রসঙ্গে টিসিবির চেয়ারম্যান ব্রি জে আবু সালেহ মোহাম্মদ গোলাম আম্বিয়া বলেন, আসন্ন রমজান সামনে রেখে টিসিবির বিক্রয়যোগ্য পণ্যের বিপুল পরিমাণ মজুদ গড়ে তোলা হচ্ছে। গত নবেম্বর থেকেই সে মজুদের কেনাকাটার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, খুব শীঘ্রই সেই বাফার মজুদ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। কোন অসাধু চক্র বাজার যাতে অস্থিতিশীল করতে না পারে, এ লক্ষ্যে টিসিবির মজুদ সরবরাহের মাধ্যমে স্থিতিশীল করার সর্বাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। টিসিবির তথ্য কর্মকর্তা হুমায়ূন কবির জনকণ্ঠকে বলেন, রোজার জন্য আমরা ছোলা, মসুর ডাল, খেজুর, সয়াবিন তেল এবং চিনি সংগ্রহের জন্য টেন্ডার দিয়েছিলাম। ইতোমধ্যে ২ হাজার টন ছোলার জন্য কন্ট্রাক হয়ে গেছে। মসুর ডালও মজুত রয়েছে। চিনি স্থানীয় সুগার কর্পোরেশন থেকে সংগ্রহ করা হবে। সয়াবিন তেলের বড় অংশ ইতোমধ্যে সংগ্রহ করা হয়েছে। আরও সংগ্রহ করার জন্য জাতীয় পর্যায়ে টেন্ডার আহ্বান করা হবে। এছাড়া খেজুর সংগ্রহের জন্য ইন্টারন্যাশনাল টেন্ডার দেয়া হয়েছিল, কিন্তু সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান পাওয়া যায়নি। এর ফলে এখন জাতীয় পর্যায়ে টেন্ডার দিয়ে খেজুর সংগ্রহ করা হবে।
×