ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বই ॥ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে চার পর্ব

প্রকাশিত: ০৬:১৭, ১০ মার্চ ২০১৭

বই ॥ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে চার পর্ব

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সামগ্রিক জীবন ধারার বিশ্লেষণধর্মী আলোচনার পূর্ণাঙ্গ রূপ হিসেবে প্রকাশ পায় ‘বাঙলার স্থপতি’ গ্রন্থটি। চার খ-ে প্রকাশিত বইটি বের হয় ১৯১৬ সালের মার্চ মাসে। ১৯১৭ সালের বইমেলাতে চার খ-ের এই বৃহদাকার গ্রন্থটির প্রথম সংস্করণ বের হয়। জাহিদ লতিফের প্রচ্ছদে ঐশী পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত বইটিতে বিস্তারিতভাবে বিধৃত হয়ে আছে জাতির জনকের জীবনাচরণ, তার সংগ্রামী ঐতিহ্য এবং স্বাধিকার আন্দোলনের অকুতভয় সেনানি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যয়ী এবং বর্ণাঢ্য কর্মপ্রবাহ। প্রথম অধ্যায়টি শুরু করা হয় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিশিষ্টজনের অভিমত সম্পর্কে কিছু বাণী প্রকাশের মাধ্যমে। পরবর্তীতে লেখক চলে যান বিষয়বস্তুর একেবারে গভীরে। শেকড় থেকে গড়ে ওঠা এক স্থপতির নিজেকে তৈরি করার অভিনব এবং চমকপ্রদ কাহিনীর যথার্থ অনুসন্ধানে। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের এক অচেনা, নিভৃত গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেয়া এই মহান কিংবদন্তি কিভাবে সাধারণ এক বালক থেকে অনন্য সাধারণ শেখ মুজিব হওয়ার সংগ্রামী পথপরিক্রমায় এক অপরাজিত লড়াকুর ভূমিকায় নিজেকে বিনির্মাণ করেন। প্রসঙ্গক্রমে, গ্রন্থকার তুলে আনেন ঊনবিংশ শতাব্দীর ক্রান্তিলগ্নে এবং বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশক পর্যন্ত অবিভক্ত বাংলায় যে অগ্নিঝরা কালপর্বের সূচনা হয় যা ক্রমান্বয়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গে রূপ নিয়ে অধিকার অর্জনের পথচলায় যুগান্তকারী ভূমিকা রাখে। স্বদেশী আন্দোলনের রক্তক্ষয়ী উন্মাদনায় কিভাবে অসংখ্য তাজা সম্ভাবনাময় তরুণ নিজেদের জীবন বাজি রাখে। শুধু তাই নয়, উদীয়মান অনেক নতুন প্রজন্ম ব্রিটিশ রাজশক্তির ভয়ঙ্কর অবিচারেরও শিকার হয়। এসব যুগের হাওয়ায় উষ্ণ পরশ বঙ্গবন্ধুকে অতি বাল্যকাল থেকে তাড়িত করে। যা তাকে অদম্য সাহসী এবং নির্ভীক যোদ্ধা হিসেবে গড়ে উঠতে অনবদ্য ভূমিকা রাখে। স্কুল জীবন থেকেই দাবি আদায়ের প্রতি বঙ্গবন্ধুর যে অনমনীয় দৃঢ় চিত্ত তা তৎকালীন রাজনীতিবিদদের মুগ্ধ করে। বিশেষ করে হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী শেখ মুজিবের দেশাত্মবোধ, তেজস্বিতা, মানসিক দৃঢ়তা এবং মানুষের প্রতি সীমাহীন দরদ প্রত্যক্ষ করে ভবিষ্যতদ্বাণীও করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর আগাম নেতৃত্বের ব্যাপারে। শুধু তাই নয় বিভিন্ন বিষয় এবং সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে এই কিংবদন্তি রাজনীতিবিদ বঙ্গবন্ধুর ওপর আস্থা এবং নির্ভরতা প্রকাশ করতেন। সোহ্রাওয়ার্দীর হাত ধরে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক অঙ্গনে যে পথচলা শুরু হয় সেটাই এ দেশের ভাষা, সংস্কৃতি এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ বপন করে। ২য় খ-ে সেই ’৪৭-এর দেশ বিভাগের নেতিবাচক পরিণতিতে বাঙালী যে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন এবং অর্থনৈতিক দুর্বিপাকে পড়ে তারই একটি বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা করেছেন গ্রন্থের রূপকার। সঙ্গত কারণেই উঠে আসে ৪৮ সালে জিন্নাহর উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা ঘোষণার বিপক্ষে বঙ্গবন্ধুর যৌক্তিক আবেদন থেকে শুরু করে ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের অশান্ত ঢেউয়ের চরম আস্ফালন। একদিকে শাসক শ্রেণীর রক্তচক্ষুকে অবজ্ঞা, উপেক্ষা করে বাংলার দামাল ছেলেদের রাজপথে নেমে আসা আর অন্যদিকে চলে ত্রাসের সঞ্চার করে আন্দোলনকারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নির্মম ইতিহাস তৈরি করা। যা বঙ্গবন্ধুকে সংগ্রামী চেতনায় নানা মাত্রিকে উদ্দীপ্ত করে। সময়ই শেখ মুজিবকে দেশের যোগ্য নেতা এবং উত্তরসূরি হিসেবে তৈরি করে নেয়। তৃতীয় খ-ে লেখক অত্যন্ত যুক্তিনিষ্ঠ আলোচনায় ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধু আপোসহীন লড়াইয়ের যে ভিন্ন মাত্রার দিগন্ত পাঠকের সামনে তুলে ধরেন সেটাই ধরে নেয়া যেতে পারে শেখ মুজিবের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় এবং সুবর্ণকাল। মাত্র এই এক দশকেই প্রয়োজনীয় এবং অপরিহার্য রাজনৈতিক কর্মযজ্ঞ তাকে নেতৃত্বের সর্বশ্রেষ্ঠ আসনে বসিয়ে দেয়। যদিও এর ঐতিহাসিক পটভূমি উপেক্ষা করা যাবে না। ’৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬ সালের ছয় দফা কর্মসূচী, ’৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সর্বশেষে ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান যা বঙ্গবন্ধু এবং বাঙালীর জীবন সংগ্রামের এক বিশিষ্ট মাইলফলক। এরই পরিণতিতেই তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’র মতো এত বড় জাতীয় সম্মানে অভিষিক্ত করা হয়। এর পরবর্তী ইতিহাস একেবারে বীরদর্পে সামনে এগিয়ে যাওয়ার গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। ’৭০-এর নির্বাচন এবং ’৭১-এর সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের মতো সমরাভিযানে অবতীর্ণ হওয়া বাঙালীর স্বাধীনতা অর্জনের এক বিস্ময়কর এবং অনন্য ঐতিহ্য। সুশৃঙ্খল এবং ধারাবাহিকভাবে ঐতিহাসিক ঘটনা পরম্পরাকে যৌক্তিক বিশ্লেষণে উপস্থাপন করা লেখকের বিশেষ কৃতিত্ব। এই জন্য তাকে আন্তরিক অভিনন্দন। সর্বশেষ অর্থাৎ চতুর্থ খ-ে পূর্বাপর সমস্ত ঘটনাকে মাথায় রেখে ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা, মুজিব নগর প্রতিষ্ঠা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সার্বিক এবং আন্তরিক সহযোগিতা, বুদ্ধিজীবী হত্যার মতো নারকীয় জিঘাংসা, মিত্র বাহিনীর হাতে পাকিস্তানী পরাজিত সৈন্য বাহিনীর আত্মসমর্পণÑ সব মিলিয়ে চতুর্থ খ-টিও মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটি বিশিষ্ট এবং সুসংবদ্ধ আলোচনা। চার খ-ে লিখিত এ গ্রন্থে শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ঐতিহ্য কিংবা আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বকেই পাঠকের সামনে তুলে ধরবে না পাশাপাশি পাঠকরা সমৃদ্ধ হবে তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার একটি স্বচ্ছ এবং পরিপূর্ণ অবয়বের সঙ্গে পরিচিত হয়ে। বাংলা, বাঙালী এবং বঙ্গবন্ধু এক অবিচ্ছিন্ন সুতায় বাঁধা যার সমন্বিত রূপই আজকের বাংলাদেশ। লেখক সাবলীল ভাষায় যেভাবে শেখ মুজিবুর রহমান এবং সমকালীন সমাজকে বিশ্লেষণ করেছেন তা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। তবুও যে কোন মননশীল রচনা ত্রুটিবিচ্যুতির উর্ধে নয়। লেখকও তার ব্যতিক্রম নন। শব্দচয়নের এত সাড়ম্বরতা এবং বাহুল্য বিষয়ের গভীরতার অঙ্গহানি ঘটাতে পারে। এখানেও তাই হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। বঙ্গবন্ধু শব্দটিই অনেক বিশেষণের সমন্বয়ে বাঙালী জাতির অহঙ্কার। তাঁর নিজের নামটাই গৌরবোজ্জল, উদ্দীপ্ত এবং মহিমান্বিত। এসব ব্যাপারে সতর্ক থাকা প্রত্যেক চিন্তাশীল লেখকের অন্যতম দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। তার পরেও গ্রন্থগুলো পাঠক সমাজে আদৃত হবে এবং এই আশা ব্যক্ত করে গ্রন্থটির সার্বিক সফলতা কামনা করছি। নাজনীন বেগম
×