ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সাগর বিশ্বাস

শিস দেয়া রাত ॥ অনুভবের অকপট উচ্চারণ

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ১০ মার্চ ২০১৭

শিস দেয়া রাত ॥ অনুভবের অকপট উচ্চারণ

কয়েক বছর আগে ‘শামসুর রাহমানের গল্প’ আলোচনা করতে গিয়ে তার ছোটগল্পের যে বৈশিষ্ট্যগুলো নজরে পড়েছিল তার মধ্যে বেশ মনে আছে শামসুরের নারী চরিত্রগুলোর বিশেষ দ্যুতিময় অবস্থান এবং কথাশিল্পে কবিতার অনুরণনের কথা। কবি শামসুরের কথাসাহিত্যে তা ছিল আমাদের সঙ্গত ও স্বাভাবিক প্রাপ্তি। সম্প্রতি বাংলাদেশের তরুণ গল্পকার নূর কামরুন নাহারের ‘শিস দেয়া রাত’ বইটি পাড়ি দিতে দিতে মনে হচ্ছে আমি অনুরূপ একটি অনুভবে ভাসমান। বাংলা সাহিত্যে, বয়সের বিচারে, ছোটগল্প কনিষ্ঠ পর্যায়ের হলেও ইতোমধ্যে সে তার বয়োজ্যেষ্ঠদের অতিক্রম করে প্রায় সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছে। তার নাতিদীর্ঘ পথপরিক্রমায় কী ভাষা, কী আঙ্গিক, কী বিষয়, কী দর্শনÑ সবকিছুতে ক্রমাগত ভাংচুর করতে করতে সে এখন ‘শাওন মাসের তমাল তরু’র মতো দৃশ্যমান। শুধু গল্পের জালিকা নয়, একটি সামান্য সাময়িক অনুভবও আজ একটি সার্থক ছোটগল্পের বিষয় হয়ে যেতে পারে। আর অনুভূতি যেখানে প্রাধান্য পায়, কবিতা কি সেখান থেকে বেশি দূরে থাকতে পারে? কামরুনের অনেক গল্পের মধ্যে সেই তীব্র অনুভূতির সঙ্গে কবিমনের এক অনিবার্য রসায়ন কাজ করে। এ-ও এক রকমের সংশ্লেষ, যা না ঘটলে সৃষ্টি পূর্ণতা পায় না (কামরুন কবিতাও লেখেন)। তার গল্পের কাহিনী উঠে আসে তার একান্ত পরিচিত পরিম-ল থেকে। যে জীবনবৃত্তে তার বেড়ে ওঠা, নিত্যবিচরণ, সেই নিজস্ব চেনাজানা বাঙালী সমাজের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত অংশেই তার গল্পের চাষবাস। সেখানকার দৈনন্দিন জীবনে যে প্রেম-অপ্রেম, মিলন-বিরহ, আসক্তি-অনীহা, আচার-ভ্রষ্টাচারের নিত্য টানাপোড়েন, কখনও বিদ্রোহী মনের শেকল ছেঁড়ার দুর্মর বাসনার বিচ্ছুরণ, সেই বিক্ষত যাপনের কথাই তার গল্পের মূল উপকরণ হয়ে আসে। যে গল্পটা এ বইয়ের নামকরণের মর্যাদা পেয়েছে সেই ‘শিস দেয়া রাত’-এর মধ্যে এক নারীর প্রাত্যহিকতায় দীর্ঘ নিশ্বাস পতনের শব্দ শোনা যায়। তার সুখী-সুখী দাম্পত্য জীবনের মাঝখানে অন্য নারীর অবস্থান এক আশ্চর্য মনস্তাত্ত্বিক বিভাজিকার সৃষ্টি করে দেয়। যে শীতকালের প্রেক্ষাপটে গল্পের সূত্রপাত, সে শীত আসলে অভ্যস্ত যাপিত জীবনে স্বামী-স্ত্রীর প্রত্যাশিত উষ্ণতার অন্তর্ধান। তথাপি শেষ পর্যন্ত স্বামীর পাশে বন্ধুর মতো দাঁড়িয়ে, বিক্ষুব্ধ নারীকে নিজেকে সমর্পণ করে। এই আত্মসমর্পণ ‘শো পিস’ গল্পের মধ্যে আরও পরিষ্কার হয়ে ওঠে। নারীকে আপন ভাগ্য জয় করার জন্য অনেক জোরালো যুক্তি উপস্থাপন করেও গল্পের রেবা স্থিতাবস্থার পক্ষে, পুরুষতন্ত্রের হাতে শো পিস হয়েই থেকে যায়। ‘বিনিময়’ গল্পেও দেখি, প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা সামান্য একটি ব্যক্তিগত সমস্যা মিটিয়ে দেয়ার প্রতিদানে যখন সুন্দরী মহিলা সুরাইয়া আক্তার শিলুর নিরাবরণ স্তনসৌন্দর্য দেখার জন্য লোলুপ হয়ে ওঠে, দৃশ্যত আত্মসচেতন সে নারীও কোন প্রতিবাদ জানায় না। তবে সেই সময়ে তা বড় ওই নেতাকে তার ‘হুলো বেড়ালের মতো লাগে’। এ রকম স্যাটায়ারধর্মী ভাষা এবং উপমার ব্যবহার তার অনেক গল্পের মধ্যে পাওয়া যায়। কিন্তু কামরুনের এই নারীরা অন্তর্জ্বালায় দগ্ধ হলেও শেষমেশ আপোসধর্মিতার চেনা রাস্তাতেই আশ্রয় খোঁজে। নতুন পথের উদ্ভাস দেখা গেলেও তাকে আবিষ্কার বা এক্সপ্লোর করার ঝুঁকি নিতে পারে না। সমাজ বাস্তবতার দিক থেকে তা অস্বাভাবিক না হলেও চরিত্রের দ্বান্দ্বিক উত্তরণ বাধা পেয়ে গল্পের চূড়ান্ত মীমাংসা ঘোষণা করে। কিন্তু ছোটগল্পের স্বভাবে তো মীমাংসার স্থান নেই, সে তো ‘শেষ হয়েও’ শেষ হওয়ার নয়। তাছাড়া জীবনের সত্য আর সাহিত্যের সত্য সব সময় হাতে হাত রেখে চলবে এমন প্রতিশ্রুতি দেয় না। তথাপি গল্পেরা গল্প হয়ে ওঠে তার সাবলীল বয়নে, অনুভবের অকপট উচ্চারণে। কামরুলের গল্পে বহু চরিত্রে সমাবেশ থাকে না! তুলনামূলকভাবে তার পুরুষ চরিত্রের চেয়ে নারীরা অনেক সপ্রতিভ। আধুনিক নারীবাদী আন্দোলনের প্রবক্তারা যে ইউটেরাসের স্বাধীনতার কথা বলেন, সে স্বাধীনতার স্পৃহার কোন রকম তীব্রতা তার সৃষ্ট নারী-চরিত্রের মধ্যে অনুপস্থিত। যেমন ‘শো পিস’ গল্পটি বর্ণনা ও উপস্থাপনে চমৎকারিত্বের দাবিদার কিন্তু গল্পের উচ্চবিত্ত নারী একসময় বিদ্রোহী হয়ে ওঠে, তারপর সেও আবার সমঝোতা করে, অবশ্য এটাই সমাজ জীবনের নিরেট বাস্তবতা। তবু ‘বর্গচোরা’ গল্পের জলি কিছু ব্যতিক্রম। তার শ্রমজীবী স্বামী পথদুর্ঘটনায় গুরুতর আহত, শয্যাশায়ী। ঠিকে কাজের বাড়ির ‘ভাইজান’ স্ত্রীর অনুপস্থিতির সুযোগে যখন তার দিকে হাত বাড়ায় সে আপত্তি করে না, বরং এক রকমের স্বাধীনতা উপভোগে আপ্লুত হয়। অথচ স্বামীকে জলি অসম্ভব ভালবাসে। তার অনুভবে, ‘আল্লাহর দুনিয়ায় এমন কে আছে যে দুইটা পুরুষ পছন্দ করে। দুটো পুরুষ কাছে আসলেই যার শরীর জেগে ওঠে। সুখে ভরে যায়। দুজনের লাইগ্যাই মন কান্দে’। সে নারীবাদ জানে না, নারী আন্দোলনের বিন্দুবিসর্গ সম্পর্কে তার কোন ধারণা নেই। তবুও শরীর, যা তার একান্ত আপন, তার সমস্ত অণু-পরমাণু নিয়ে সে অসঙ্কোচ উৎসবে শামিল হয়। গোপন অথচ নির্বাধ এই শরীরী উৎসব যুগ যুগ ধরে সমাজের উচ্চকোটি এবং নিম্নতম কোটির মধ্যে বহাল রয়েছে। নৈতিকতা বা ধর্মের অনুশাসন কেবল মধ্যবর্গের মানুষকেই প্রভাবিত করেছে। আবার, সেই মধ্যবর্গ থেকেই সারাবিশ্বে উঠে আসে নারীর সার্বিক অধিকার আন্দোলনের সেøাগান। এই বৈপরীত্যের মনস্তত্ত্ব কামরুনের মধ্যবর্গীয় নারী চরিত্রের আটপৌরে জীবনধারায় গুরুত্বপূর্ণ নয়। গল্প রচনায় বর্ণনাত্মক ভঙ্গির ব্যবহার কামরুনের অনেকটা সহজাত। এ বইয়ের মোট বারোটির মধ্যে বেশ কয়েকটি গল্পে এই রীতির চমৎকার প্রয়োগ দেখা যায়। যেমনÑ অবয়ব, ওম, বিছানার বাঁ পাশটা খালি ইত্যাদি। উত্তম পুরুষে লেখা ন্যারেটিভ গল্পে অনেক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়ার যে সম্ভাবনা থাকে তা খারিজ হয়ে যায় ভাষার লুসিডিটি (এ শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ মাথায় এলো না) এবং শব্দের গ্রহণযোগ্য ব্যবহারে যা কামরুন অনায়াসে করতে পারেন সহজ ঘরোয়া শব্দে তৈরি ছোট ছোট বাক্য লিখে। সামান্য দৃষ্টান্ত দেখানো যায়Ñ ‘আমি উঠি। জুয়াড়িতে চোখ রাখি। কয়েক পাতা পড়ি। নাহ, মনোযোগ আসছে না। কেমন একটা নিঝুম শূন্যতা। বারান্দায় দাঁড়াই। সামনের রাস্তা নির্জন হয়ে আসছে। আশপাশের বাসায় আলো কমে আসছে। রাত কত হলো। একটা। না শুয়ে পড়াই ভাল। বিছানায় আসি। শুই। চোখ বুজি। গুম আসে না। বিছানার বাঁ পাশটা খালি। বিছানাটা এত বড়, বেখাপ্পা। সাদা বেডকভার কাফনের কাপড়ের মতো চেয়ে থাকে। ভেতরে কাঁপন লাগে।’ (গল্প : বিছানার বাঁ পাশটা খালি)। এই ভাষা আপামর বাঙালীর একেবারে ঘরের ভাষা। এ রকম ভাষাকে বাহন করেই কামরুনের গল্প এগিয়ে যায়। ভাষার কৌলিণ্যের প্রশ্ন সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। এককালে, পাকিস্তান-আমলে বাঙালী লেখক বুদ্ধিজীবীদের একাংশ বাংলা ভাষায় বিদেশী শব্দ বিশেষত আরবী-ফারসি-উর্দুর ব্যাপক ব্যবহারের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সে আবেগ ব্যাপকতার হলেও সমাজজীবনের গহনে কোথাও যে অ্যান্টিথেসিস অন্তর্বাহী থাকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাও কখনো দৃশ্যমান হয়। সাহিত্য তা এড়াতে পারে কি না, পারলে কতটা পারে সে প্রশ্ন থেকেই যায়। সাহিত্য যদি সমাজের দর্পণ হয় তবে একজন লেখকের সেখানে বিশ্বস্ত থাকটাও জরুরি। বিশেষত কথাসাহিত্যিকের পক্ষে সমাজ-নিরপেক্ষ হওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। তাই কামরুনের গল্পের মধ্যে কিছু কিছু অ-বাংলা শব্দ স্বাভাবিকভাবেই স্থান পেয়ে যায়। কামরুন সচেতনভাবেই তার বিরুদ্ধাচরণ করেন না। পরিশেষে বলি, একজন লেখককে প্রতিনিয়ত নির্মাণ-বিনির্মাণের পথে ভাংচুর চালাতে হয়। ভাংচুর বিষয়, শৈল্পিক ও আঙ্গিকের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকেও। খুটিয়ে দেখলে কামরুনও উল্টো পথের পথিক নন। আমার সীমাবদ্ধতা এখানে সে আমি তার অন্যান্য গ্রন্থ পাঠের সুযোগ পাইনি। একটিমাত্র বইয়ের মধ্যে বিস্তর বৈচিত্র্যের সন্ধান করা অর্থহীন। তবে এ কথা নিঃসংশয়ে বলা যায়, কামরুন বাংলা সাহিত্যে প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন কথাশিল্পী আগামী দিনে তার হাত আর বলিষ্ঠ হবে এ প্রত্যাশা অনায়াসে রাখা যায়।
×