ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা

মীরসরাই-সীতাকুণ্ডে জঙ্গী-সন্ত্রাসীদের নতুন আস্তানা

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১০ মার্চ ২০১৭

মীরসরাই-সীতাকুণ্ডে জঙ্গী-সন্ত্রাসীদের নতুন আস্তানা

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রামে জামায়াত-শিবির ও বিএনপি অধ্যুষিত হিসেবে পরিচিত সীতাকু--মীরসরাই বেল্টে জঙ্গী সন্ত্রাসীদের নবরূপে উত্থান ঘটেছে। অভিযোগ রয়েছে, এসব জঙ্গী সন্ত্রাসী বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের ব্যানারে মাথাছাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টায় রয়েছে। গত বুধবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে মীরসরাইতে জঙ্গীদের যে আস্তানা এবং গ্রেনেড, পাওয়ার জেল, কার্বন স্টীলবল, বোমা তৈরির সরঞ্জাম, আইএসের পোশাক ও ব্যানার উদ্ধারের ঘটনায় তাই প্রমাণ করছে। ধারণা করা হচ্ছে, তারা কিছুটা শক্তিও সঞ্চয় করেছে। উল্লেখ্য, গত মঙ্গলবার কুমিল্লার চান্দিনায় একটি চেকপোস্টে বাস তল্লাশিকালে পুলিশের ওপর জঙ্গী হামলার ঘটনার পর পুলিশ দু’জনকে আটক করে। পরে তাদের স্বীকারোক্তি মতে একযোগে অভিযান চলে মীরসরাই, সীতাকু-, পটিয়া এবং লোহাগাড়ায়। অভিযানে মীরসরাইয়ের জঙ্গী আস্তানাটি বেরিয়ে আসে। এ আস্তানা থেকে উদ্ধার হয় ২৯টি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন গ্রেনেড, ৯টি চাপাতি, ৪০টি পাওয়ার জেল, ২৮০ প্যাকেট কার্বন স্টীলবল, ১১ কেজি বোমা তৈরির সরঞ্জাম এবং আইএসের কালো রঙের পোশাক ও ব্যানার। যে বাড়ি থেকে এসব বিস্ফোরক ও সরঞ্জাম উদ্ধার হয়েছে সেটি মূলত মীরসরাই পৌর এলাকার বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রিদওয়ানুল হকের মালিকানার, যা রিদওয়ান মঞ্জিল নামে পরিচিত। দোতলা বিশিষ্ট ওই ভবনের নিচতলার বাসাটি ভাড়া নিয়েছিল মাহমুদ হাসান নামের এক জঙ্গী। ভাড়া নেয়ার পর চলতি মাসের ১ তারিখে ভাড়াটিয়া হিসেবে উঠে জঙ্গী মাহমুদের বোন ও তার ভগ্নিপতি। অভিযানের পর পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে জঙ্গী সন্ত্রাসী তৎপরতা চালানোর জন্যই তারা সেখানে ঘাঁটি গেঁড়ে বসেছিল। এ ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সূত্রে বলা হচ্ছে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর দেশব্যাপী যে সহিংস ঘটনাবলী ঘটে তার নেপথ্যে ছিল জামায়াত-বিএনপির ক্যাডার বাহিনী। এরপর দেশজুড়ে নতুনরূপে আবির্ভূত হয় জঙ্গী সন্ত্রাস। ওই সময় বিভিন্নস্থানে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ থেকে শুরু করে যানবাহন জ্বালাও-পোড়াও, দেশী -বিদেশী মানুষ হত্যা শুরু করে দিনের পর দিন ব্যাপক রক্তক্ষয়ী সহিংসতার ঘটনা ঘটে। পরবর্তীতে সরকার এসব ঘটনা কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়। জামায়াত-শিবির গা-ঢাকা দেয়। বিএনপির ক্যাডাররাও মাঠে নামা থেকে বিরত থাকে। কিন্তু বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের ব্যানারে মানুষ হত্যা শুরু হয়। বিশেষ করে মুক্তমনা বুদ্ধিজীবী ও ব্লগারদের হত্যা দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। এ বিষয়টিও সরকার কঠোরভাবে দমনে সক্ষম হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক দেশের বিভিন্নস্থানে আবারও জঙ্গী সন্ত্রাসের ঘটনা শুরু হয়েছে। সর্বশেষ কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার কুটুম্বপুর এলাকায় হাইওয়ে পুলিশের তল্লাশি চালানোর সময় আটক হয় ২ জঙ্গী। এ সময় জঙ্গীরা পুলিশের ওপর হামলাও চালায়। এ ঘটনা কেন্দ্র করে পুলিশ, র‌্যাব ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত সরকারের বিভিন্ন সংস্থার নজর এখন চট্টগ্রামের মীরসরাই-সীতাকু- বেল্টের দিকে। সীতাকু-ের কুমিরায় বিশাল এলাকাজুড়ে বহু আগে প্রতিষ্ঠা হয়েছে জামায়াত নিয়ন্ত্রিত একটি বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সংলগ্ন ওই এলাকায় এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে প্রচার মাধ্যমে বিভিন্ন তথ্য প্রকাশিত হয়। কিন্তু নীতিনির্ধারক মহল তা নিয়ে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর মীরসরাই-সীতাকু- বেল্টজুড়ে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মী ও ক্যাডার বাহিনীর বিরুদ্ধে শতাধিক মামলাও হয়েছে। জামায়াত-বিএনপি শিবিরের সহিংসতার ঘটনা দমন হওয়ার পর এবার মাথাচাড়া দিয়েছে জঙ্গী সন্ত্রাস। পুলিশ সূত্রে জানানো হয়েছে, সীতাকু--মীরসরাই বেল্টটি জনবহুল এলাকা। এছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানবাহন চলাচলের একমাত্র রুট এই স্থান দিয়ে। পুলিশ ধারণা করছে, বিএনপি-জামায়াত রাজনীতির মাঠে সুবিধা করতে না পেরে এদের ক্যাডার বাহিনীর বড় একটি অংশ বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের ব্যানারে সংযুক্ত হয়েছে। এরাই এখন এ অপকর্মে লিপ্ত। অতীতে এ রুটে শত শত যানবাহন জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কায়দায়। সাধারণ মানুষ মরেছে, রক্ত ঝরেছে। এরপর দীর্ঘদিন এরা নির্লিপ্ত অবস্থানে চলে যায়। ভেতরে ভেতরে আবার শক্তি সঞ্চয় করেছে বলে ধারণা দিচ্ছে পুলিশ। চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সূত্রে জানানো হয়েছে মীরসরাই, সীতাকু-, সাতকানিয়া, পটিয়া, লোহাগাড়া, হাটহাজারী, ফটিকছড়িসহ বিভিন্ন উপজেলায় ইতোমধ্যে নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে। পুলিশী তৎপরতা সর্বক্ষণিক। বিশেষ করে মীরসরাই-সীতাকু- বেল্টকে জঙ্গী সন্ত্রাসীরা যেমন বেছে নিয়েছে তেমনি পুলিশও এখন এ বেল্টকে টার্গেট করে তাদের শেকড় উৎখাতের তৎপরতা চালাচ্ছে। ওই এলাকাজুড়ে বিশেষ করে সীতাকু- এলাকার বিএনপি নেতা আসলাম চৌধুরী ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ কানেকশনে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে রয়েছে। তার অনুগত ক্যাডার বাহিনীর সদস্যদের সহায়তায় জঙ্গী সন্ত্রাসীরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে বলে পুলিশ ধারণা পেয়েছে। নেপথ্যে জামায়াত-শিবিরের সশস্ত্র ক্যাডাররা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করছে। সরকারকে সর্বক্ষণিক বেকায়দায় রাখতে এদের এ তৎপরতা বলে পুলিশ মনে করে। পুলিশের সঙ্গে জঙ্গী সন্ত্রাসের শেকড় উৎপাটনে র‌্যাব, কাউন্টার টেররিজম ইউনিটসহ বিভিন্ন সংস্থা সম্মিলিতভাবে কর্মকা- শুরু করেছে। সরকার পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই সিএমপি, পুলিশের রেঞ্জ ডিআইজি, এসপি এবং র‌্যাব সেভেনকে আরও সতর্ক ও দ্রুত পদক্ষেপে কাজ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, সিএমপি এলাকায় এদের প্রকাশ্য তৎপরতা নেই। তবে অবস্থান রয়েছে। ঘাঁটি গেঁড়েছে জামায়াত-শিবির অধ্যুষিত এলাকাসমূহে। যে কারণে পুলিশ গত মঙ্গলবার রাত থেকে মীরসরাই, সীতাকু-, পটিয়া, লোহাগাড়া ও সাতকানিয়ায় অভিযান পরিচালনা করে। তারা হাটহাজারী, ফটিকছড়িতেও জঙ্গী সন্ত্রাসীদের অবস্থান থাকতে পারে বলে ধারণা করছে। গত বুধবার মীরসরাইতে জঙ্গী আস্তানা খুঁজে পাওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিশ্চিত হয়েছেÑ এ বেল্টে শক্তি সঞ্চয়ের জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘাঁটি গেঁড়েছে। যেহেতু ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এ এলাকার সীতাকু--মীরসরাই বেল্টে সহিংসতা ঘটাতে পারলে বাণিজ্যনগরী চট্টগ্রাম থেকে পণ্য পরিবহন ও যাত্রী চলাচলে দুর্ভোগ নেমে আসে সে কারণেই ওই স্থান তারা বেছে নিয়েছে। পুলিশের দায়িত্বশীল একটি সূত্র বলেছে, তারা এ বেল্টজুড়ে সাঁড়াশি অভিযান চালানোর চিন্তা-ভাবনা করছে। বিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলোচনার জন্য সিএমপি ও চট্টগ্রাম রেঞ্জ পুলিশের কয়েক কর্মকর্তা ইতোমধ্যে ঢাকায় গেছেন। প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলে ওই সূত্র জানায়।
×