ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ১০ মার্চ ২০১৭

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

মোরসালিন মিজান ॥ শহর ঢাকার মুখ পোস্টারে ঢেকে গেছে। না, এটি কথার কথা নয়। একদম সত্যি। কোন কোন জায়গায় পোস্টার আছে? এই প্রশ্ন আজ অর্থহীন। কোথায় নেই? ঢাকার দুই মেয়রের পিঠে পোস্টার লাগানো হয়নি। এটি আশার কথা। বাকি সব জায়গায় পোস্টার। দেখে অভ্যস্ত অনেকেই। দেখছেন প্রতিদিন। কারও কিছু যাচ্ছে না। আসছেও না। শহরটিকে সুন্দর রাখার দায়িত্ব যাদের, তারা দর্শক গ্যালারিতে পপকর্ণ হাতে দেখে যাচ্ছেন। সচেতন নাগরিকদের মতে, কর্তা ব্যক্তিদের রুচির দুর্ভিক্ষ চলছে। নান্দনিকতার বোধ বলতে কিছু নেই। যদি থাকত তাহলে শহরকে সুন্দর করে বাঁচানোর চেষ্টা তারা করতেন। চারপাশের পরিবেশ এত শ্রীহীন হতো না। হ্যাঁ, পোস্টার নতুন কিছু নয়। আগেও ছিল। কিন্তু এখন অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি। বলা চলে মহামারি চলছে। শহরের প্রতিটি দেয়ালে পোস্টার সাঁটা। প্রধান প্রধান সড়কের পাশে যত দেয়াল, দখল হয়ে গেছে। কী যে নোংরা চেহারা! একটা অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। কিছু সুন্দর তো এই শহরের ছিল। দেখার কোন অবস্থা নেই। পোস্টারে সব আড়াল হয়ে গেছে। অফিস আদালত স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি বাসা বাড়ির সীমানা প্রাচীর গিলে খাচ্ছে পোস্টার। একেবারে নতুন সংযোজন ফ্লাইওভারগুলোর পিলার। বিশাল বিশাল পিলারের মসৃণ গায়ে পোস্টার লেপে দেয়া হয়েছে। ভাল উদাহরণ হতে পারে নবনির্মিত মগবাজার-মালিবাগ ফ্লাইওভার। অনেক পিলারের উপর দাঁড়িয়ে আছে। উঁচু ও প্রস্থ পিলার এত বেশি দৃশ্যমান যে, আলাদা করে সেদিকে তাকাতে হয় না। আপনি চোখ চলে যায় সেদিকে। আর এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে নিম্ন রুচির মানুষেরা। পায়ের উপর ভর দিয়ে সবে দাঁড়িয়েছে ফ্লাইওভারটি। তাতে কী? এ সময়ের মধ্যেই সবকটি পিলার পোস্টারে ঢেকে দেয়া হয়েছে। কাঁচা সিমেন্ট শুকোনোর অপেক্ষা কেউ করেননি। তার আগেই পোস্টার। রাজনীতির কোন লোকটি কত বড় নেতা হয়ে উঠেছেন তা পোস্টারে বর্ণনা করা হচ্ছে। কত রঙয়ের ঢঙয়ের ছবি! দেখে গা গুলিয়ে উঠে। মলম বিক্রির বিজ্ঞাপন আছে। সিনেমার যত উদ্ভট পোস্টার সেঁটে দেয়া হয়েছে। অশ্লীল অশৈল্পিক উপস্থাপনা। ছন্দজ্ঞানহীন নায়িকার পা রাস্তা দিয়ে নিত্য যাতায়াত করা মানুষের কপালের উপরে যেন ঝুলে আছে। কার গান শুনতে হবে, কোন শিল্পীর এ্যালবাম না কিনলে জীবন বৃথাÑ পোস্টারে তা বলা আছে। বর্ণনা করা হয়েছে কোচিং ব্যবসার ‘মাহাত্ম’। কে কাকে প্রাইভেট পড়াতে চান, ভুল বানানে লেখা আছে। দোকানের সাঁটার নষ্ট? বাসার গ্যাসের চুলায় সমস্যা? সব সমাধান পোস্টারে! কে কোন মেসে কার সঙ্গে থাকবেন, কত টাকায় নিরিবিলি পরিবেশ পাওয়া যাবে, পিলারের গায়ে বিস্তারিত লেখা আছে। অজস্র ফোন নাম্বার। বাসা ভাড়া হবে। যোগাযোগের জন্য দারোয়ানের নাম্বার দেয়া আছে। গাড়ির স্টার্ট নিচ্ছে না? কল করলেই মেকানিক। এভাবে সব সমস্যার সমাধান দিচ্ছে পোস্টার। ফ্লাইওভারের যে অংশটি এফডিসির দিকে চলে গেছে সেটিও পোস্টারের দখলে। রোদে বৃষ্টিতে বিধ্বস্ত হয়ে পুরনো পোস্টার খসে পড়ছে। নুয়ে পড়ছে। বাতাসে দোল খাচ্ছে। তার উপরই আঁঠা দিয়ে লাগানো হচ্ছে নতুন পোস্টার। পরোক্ষণেই আরেক দল এসে হাজির হচ্ছে। নতুন পোস্টারটি এক টানে যতটুকু ছেঁড়া যায়, ছিঁড়ছেন। তার পর নিজেদেরটি আঁঠা দিয়ে লাগিয়ে দিচ্ছেন। এভাবে প্রতিটি পিলার আবর্জনার স্তূপে পরিণত হয়েছে। যেন জঙ্গল। যেন ভাগার। সব দেখে মন খারাপ হয়ে যায়। নিজের কাছে নিজেকে ছোট মনে হয়। এমন কেন আমরা? এবার বিজিএমইএ ভবন প্রসঙ্গ। ঢাকার ফুসফুস হাতিরঝিলের উপর নির্মাণ করা ভবনটি দীর্ঘদিন ধরে আলোচনায়। এটি অবৈধভাবে নির্মাণ করা হয়েছেÑ এমন অভিযোগ পুরনো। শহরের সচেতন নাগরিকেরা পরিবেশবিদরা রাজপথে থেকে প্রতিবাদ করেছেন। তার পর আদালতে। সেখানেও দীর্ঘ লড়াই। এবং অতঃপর ঝিলের জলের স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ করে নির্মিত অবৈধ ভবন ভেঙ্গে ফেরার আদেশ। ৯০ দিনের মধ্যে ভাঙ্গতে হবে। হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে গত ২ জুন করা বিজিএমইএয়ের আপীলও খারিজ হয়ে যায়। রায়ে বলা হয়, বিজিএমইএ তাদের ভবন না ভাঙলে রাজউককে উদ্যোগ নিতে হবে। রায়ের অনুলিপি পাওয়ার ৯০ দিন শেষ হয়েছে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু কোন পক্ষ থেকেই ভবন ভাঙ্গার উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এ অবস্থায় রাজউক চেয়ারম্যান বরাবরে আইনী নোটিস পাঠিয়েছেন একজন আইনজীবী। আগামী ৭ দিনের মধ্যে রাজউক ভবন ভাঙ্গার কার্যক্রম শুরু না করলে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আপীল বিভাগে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হবে বলে চিঠিতে জানিয়েছেন তিনি। সব মিলিয়ে আলোচনায় বিজিএমইএ ভবন। নগরবসীর অনেকেই বিষয়টি নিয়ে কথা বলছেন। তাদের মতে, এবার ভবনটি ভাঙতেই হবে। আর কোন বিকল্প নেই। যদি তাই হয় বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলির শহর ঢাকার জন্য এটি হবে খুব ভাল বিষয়। সন্দেহ নেই।
×