ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সাঁওতালদের ঘরে আগুন

দুই পুলিশের নাম উল্লেখ করে হাইকোর্টে প্রতিবেদন

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১০ মার্চ ২০১৭

দুই পুলিশের নাম উল্লেখ করে হাইকোর্টে প্রতিবেদন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ গোবিন্দগঞ্জে চিনিকলের বিরোধপূর্ণ জমি থেকে উচ্ছেদের সময় সাঁওতালদের ঘরে আগুন দেয়ার ঘটনায় এসআই মাহবুবুর রহমান ও কনস্টেবল মোঃ সাজ্জাদ হোসেনের নাম উল্লেখ করে হাইকোর্টে প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ। আদালতে দাখিল করা প্রতিবেদনে জানানো হয়, দুই পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এছাড়া গাইবান্ধার পুলিশ সুপার (এসপি) আশরাফুল ইসলামকে খাগড়াছড়িতে বদলি করা হয়েছে। আর প্রত্যাহার করা হয়েছে ঘটনার দিন দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ৫৮ সদস্যকে। বৃহস্পতিবার বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণ দেবনাথের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চে এই প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। এছাড়া এই ঘটনায় গণমাধ্যমের ভূমিকায় সন্তোষ প্রকাশ করেছে হাইকোর্ট। পুলিশ প্রশাসনের প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপন করেন ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু। উপস্থাপনের পরে প্রতিবেদন নথিভুক্ত করেছে আদালত। বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য তাদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে বলে পুলিশের রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক তার প্রতিবেদনে জানিয়েছেন । অন্য প্রতিবেদনটি দিয়েছেন পুলিশের অনুসন্ধান কমিটির সভাপতি রংপুর রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির। দুই প্রতিবেদনেই বলা হয়, এসআই মাহবুব ও কনস্টেবল সাজ্জাদ ছাড়াও পুলিশ বা বাইরের লোকজন ওই ঘটনায় জড়িত ছিলেন বলে তদন্ত কমিটির কাছে প্রতীয়মান হয়েছে; কিন্তু তাদের চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, ঘটনার দিনই দায়িত্বরত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ৫৮ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়। একই সঙ্গে গাইবান্ধার সে সময়ের পুলিশ সুপার (এসপি) আশরাফুল ইসলামকে খাগড়াছড়িতে বদলি করা হয়। বৃহস্পতিবার আদালতের নির্ধারিত দিনে রংপুর বিভাগের পুলিশের ডিআইজির পক্ষ থেকে প্রতিবেদন দাখিল করার পর এই তথ্য জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়, সাঁওতালপল্লীতে আগুন দিয়েছেন গাইবান্ধা পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) এসআই মাহবুবুর রহমান ও গাইবান্ধা পুলিশ লাইনসের কনস্টেবল সাজ্জাদ হোসেন। গত বছরের ৬ নবেম্বর গোবিন্দগঞ্জের রংপুর চিনিকলের জমি থেকে সাঁওতালদের উচ্ছেদ অভিযানে যায় পুলিশ। পূর্বপুরুষদের জমি দাবি করে সেখানে ঘর তুলেছিল তারা। অভিযান চলাকালে পুলিশ ও চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষ হয়। এক পর্যায়ে সাঁওতালপল্লীতে আগুন দেয়ার ঘটনাও ঘটে। পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে এক পুলিশ সদস্যের একটি বাড়িতে আগুন দেয়ার ছবি প্রকাশ হয়। এ নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে পুলিশের রংপুর রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি চৌধুরী মঞ্জুরুল কবিরের নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। ওই তদন্তেই দুইজনের নাম ওঠে এসেছে। সাঁওতালপল্লীতে আগুন দেয়ার ঘটনায় গত ৭ ফেব্রুয়ারি গাইবান্ধার পুলিশ সুপারকে (এসপি) অবিলম্বে প্রত্যাহারের নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। একই সঙ্গে চামগাড়ীতে দায়িত্বরত সকল পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহারেরও নির্দেশ দেয় আদালত। আদেশ বাস্তবায়ন হয়েছে কিনা এ বিষয়ে চার সপ্তাহের মধ্যে স্বরাষ্ট্র সচিব, জনপ্রশাসন সচিব, আইজিপি এবং রংপুর বিভাগের ডিআইজিকে প্রতিবেদন দিতে বলে আদালত। একই সঙ্গে বৃহস্পতিবার ৯ মার্চ শুনানির জন্য দিন নির্ধারণ করেছিল আদালত। গত ৭ ফেব্রুয়ারি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্য সরাসরি জড়িত মর্মে হাইকোর্টে প্রতিবেদন দাখিল করে গাইবান্ধার মুখ্য বিচারিক হাকিম মোঃ শহিদুল্লাহ। এফিডেভিট আকারে হাইকোর্টে ৬৫ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনে আগুন দেয়ার ঘটনায় কিছু পুলিশ সদস্য জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, সাঁওতালদের বাড়িঘরে আগুন লাগানোর ঘটনার জন্য স্থানীয় কতিপয় ব্যক্তি এবং উক্ত ঘটনার সময়ে দায়িত্বরত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দায়ী। এই আগুন লাগানোর ঘটনায় দুই পুলিশ সদস্য ও গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) একজন সদস্য সক্রিয়ভাবে জড়িত। বিদেশী টেলিভিশন চ্যানেল ‘আল জাজিরা’য় প্রদর্শিত ভিডিও ক্লিপ পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে, কিছু পুলিশ সদস্য এবং দুই জন সাদা পোশাকধারী সাঁওতালদের বাড়িঘরে আগুন দিচ্ছেন। আরও কিছু পুলিশ সদস্য কিছুটা দূরে দাঁড়িয়েছিলেন যারা আগুন লাগানোয় সক্রিয় অংশগ্রহণ করেননি। তবে তারা আগুন নেভানোর চেষ্টাও করেননি। ঘটনার বিবরণ দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, চামগাড়ী বিল ও কুয়ারমারা এলাকায় আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটে সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটা থেকে ছয়টার মধ্যে। সাহেবগঞ্জ ও হরিণমারী এলাকায় আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটে সন্ধ্যা আনুমানিক ৭টার পরে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে এবং হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতি দেখে বসতি স্থাপনকারীরা আতঙ্কিত হয়ে প্রাণ বাঁচাতে আগেই ঘটনাস্থল ছেড়ে মাদরপুর ও জয়পুর গ্রাম এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় আশ্রয় নিয়েছিল। ফলে সাক্ষীরা স্থানীয় অপরাধীদের সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করতে পারেননি। তাছাড়া কোন কোন সাক্ষী তাদের জবানবন্দীতে আগুন লাগানোর ঘটনায় বিভিন্ন ব্যক্তির নাম উল্লেখ করলেও তাদের উপস্থিতির বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা পোশাক পরা থাকায় তাদের সম্পৃক্ত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
×