ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সুলতানা শাহরিয়া পিউ

সংগ্রামী কাঁথার আত্মকথা

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ১০ মার্চ ২০১৭

সংগ্রামী কাঁথার আত্মকথা

(৮ মার্চের জন্য) শহরে তোমরা নবেম্বরেও এসির বাতাস ভুলতে পারছ না। তাই আপাতত এ মুহূর্তে আমাকে তোমাদের প্রয়োজন নেই! সে জন্যই আলমারির তাকে ন্যাপথলিন ঘিরে রয়েছে আমায়। অথচ ওই যারা এখন ঘরপোড়া গরু-খোলা আকাশের নিচে ঠাঁই ওদের বড় প্রয়োজন আমাকে এখন। এই আমি, যে একটা শত বছরের কাঁথা। আমার নাম দেয়া হয়েছিল সংগ্রামী কাঁথা। কারণটা তোমাকে আর তোমার বন্ধুদের একটু জানাতে চাই। ১৯১০ সালের কথা। সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিন ৮ মার্চকে নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা দেন। আর ২০১০ সালে ওই দিনটির এক শ’ বছর পূর্তির বছর ছিল। ওইদিন আমার আবার জন্মদিন। আমার মতো একটা বিশেষ কাঁথার বিশেষ দিন। বিশেষ কেন? কারণ আমি কাঁথা যেনতেন সেই কাঁথা নই। আমার ওপর সুই-সুতার কাজ যেমন, নতুন ও পুরনো কাপড়ের ব্যবহারও তেমন। তবে আমার ওপর লেখার জন্য কালি-কলমের বদলে সুই-সুতা আর অক্ষরের বদলে নানা ধরনের চিত্র ব্যবহৃত হয়েছে। এই আমি কাঁথার মাধ্যমেই নারী সংগ্রামের কথা প্রকাশের চেষ্টা হয়েছে। এখানেই আমার বিশেষত্ব। আমাকে সৃষ্টির কাজে বাংলাদেশের লেখাপড়া জানা বা না-জানা অনেক নারীই অনেক কষ্ট করেছে। আমার ওপর তারা ফুল, লতাপাতা, এমন কি মায়ের ছবি এঁকে প্রকৃতির সঙ্গে তাদের আত্মার যে যোগ আছে তা প্রকাশ করেছে। এই সুযোগে একসঙ্গে অনেকে বসে সেলাই করতে গিয়ে তাদের মধ্যে একটা সংহতিও গড়ে উঠেছে। যে সংহতি তোমাদের শহরের মানুষের মধ্যে খুবই কম! অথচ দেখ সাঁওতালপল্লীর মানুষগুলোকে? আন্তর্জাতিক নারী দিবসের এক শ’ বছর পূর্তি উপলক্ষে আমাকে অর্থাৎ শত বছরের কাঁথা তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। দেশের প্রতি জেলা থেকে শত টুকরা কাঁথা তৈরি করে ঢাকায় আনা হয়। আমার শরীরের ওই শত টুকরা অংশ জোড়া দিয়ে আমাকে তৈরি করা হয়। আমার একটা অংশ জোড়া দেয়ার সময় কৃষক দিবা দাওয়া ও নমিতা দেবনাথ স্মৃতি হাতড়ে মনে করার চেষ্টা করছিল- ‘আগে ঘরে ঘরে ভোর রাতে ঢেঁকিতে ধান ভানার ধাপুর ধুপুর শব্দ শোনা যেত যা এখন আর শোনা যায় না’-ঢেঁকির ছবি সেলাই করতে করতে বলে নমিতা। নারী নেত্রী বেগম রোকেয়ার ছবি সেলাই করতে গিয়ে নারীকে সুশিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত করে তোলার জন্য তাঁর সংগ্রামী জীবনের কথা তাদের মনে পড়তে থাকে। আরেকদিন আমার এক অংশ জমা দেয়ার দুদিন পর আবার ফেরত চাওয়া হয়। কারণ তার এক কোনে লেখা ‘উইমেন ফর উইমেনু’এর ‘ফর’-এর ’র’-এর ফোটা বাদ পড়েছিল। তুমিই বল এই যে এত বিশ্বস্ততা, এত আত্মনিবেদন এর থেকে কি তোমাদের কিছুই নেয়ার নেই? বলছিলাম কি, তোমাদের এই দেশে যখন আমেরিকার তখনকার ফার্স্টলেডি হিলারি ক্লিনটন এসেছিলেন তাঁকে তোমরা গ্রামীণ চেক কাপড় উপহার দিয়েছিলে। কিন্তু আজ তোমাদের বিশেষ অনুরোধ, এরপর কোন দিন সেদেশের রাষ্ট্রপ্রধান মিস্টার ট্রাম্প আসলেও দোহাই তোমরা সুভিনিয়র হিসেবে আমাকে বা আমার মতো আর কোন কাঁথা উপহার দিও না। যে যেটার মর্যাদা রাখে তাঁকে তাই দিও। অনুগ্রহ করি আমাদের ওই খোলা আকাশের নিচে মানবেতর দিন অতিবাহিত করা মাথার ওপর শিশিরে জর্জর সাঁওতালগুলোর কাছে তোমার বন্ধুর মাধ্যমে পৌঁছে দাও। আমাদের বড্ড দরকার ওদের এখন। আমাদের সংগ্রাম আর ওদের সংগ্রাম যে এক সুতায় গাঁথা। আমাদের বুকেই যে লেখা ওদের জীবন সংগ্রামের কথা!
×