ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

৭ মার্চ ও একটি বিশ্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ

প্রকাশিত: ০৩:৫৫, ১০ মার্চ ২০১৭

৭ মার্চ ও একটি বিশ্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ

(গত বুধবারের পর) অসহযোগ আন্দোলনের সময় এ দেশের জনগণ যাতে কোন রকম বঞ্চনার শিকার না হয় এবং খাদ্য অর্থকষ্টে বিপর্যস্থ হয়ে না পড়েন তার জন্য বলেছিলেন, ’এর পরে যদি বেতন দেওয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের উপর আমার অনুরোধ রইল : প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তা নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দেবার না-ও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না। সরকারি কর্মচারীদের বলি : আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এ দেশের মুক্তি না হবে খাজনা, ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হল। কেউ দেবে না। শোনেনÑমনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-নন-বেঙলি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপরে, আমাদের উপরে, আমাদের যেন বদনাম না হয়’। রণকৌশল এবং রণনীতি কী হবে এবং কিভাবে বাঙালী জাতি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা পালন করবে তাও বঙ্গবন্ধু নির্দেশনা দেন এভাবে - ‘প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব- এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম-এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। বঙ্গবন্ধুর শ্রেষ্ঠত্ব - তিনি শুধু বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের একজন স্বপ্নদ্রষ্টাই ছিলেন না, অনন্যসাধারণ এক ঐক্যের বন্ধনে বাঙালী জাতিকে একতাবদ্ধ করে হাজার বছরের বাঙালী জাতির স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আগে ও পরে বহু খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ এসেছেন কিন্তু এমন করে কেউ বাঙ্গালীকে জাগাতে পারেননি। তাই বঙ্গবন্ধুকে প্রতিষ্ঠার জন্য শক্তি প্রয়োগের যেমন প্রয়োজন পড়ে না, তেমনি তাঁকে ইতিহাস থেকে নির্বাসিত করাও অসম্ভব। ভারতের মহাত্মা গান্ধী, যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন, চীনের মাও সেতুং, ভিয়েতনামের হো চি মিন, কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রো, ঘানার পেট্রিস লুসাম্বা ও কওমী নক্রুমা, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, সোভিয়েত ইউনিয়নের লেনিন, যুগোস্লাভিয়ার মার্শাল টিটোর মতো বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তাঁর অবদানের জন্য বিশ্ব-ইতিহাসের এক অনিবার্য স্থান যথার্থই দখল করে আছেন। এটিও সত্য যে, ইন্দোনেশিয়ায় স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য ড. আদম মালিক নয়, মহান স্বাধীনতার সংগঠনের জন্য জাতির পিতা হিসেবে সুকর্ণই প্রতিষ্ঠিত। বঙ্গবন্ধুকে স্বীকৃতি দিতে গিয়ে ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট লন্ডনের ’দি ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস’ উচ্চারণ করেছিল, ‘এই করুণ মৃত্যুই যদি মুজিবের ভাগ্যে অবধারিত ছিল তাহলে বাংলাদেশের জন্মের মোটেই প্রয়োজন ছিল না’। ১৯৭৫-এর ২৮ আগস্ট তারিখে লন্ডনের ’দি লিসনার’ পত্রিকায় বিবিসির সংবাদদাতা ব্রায়ান ব্যারন এর ভবিষ্যদ্বাণী - “বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের হৃদয়ে উচ্চতর আসনেই অবস্থান করবেন। তাঁর বুলেট-বিক্ষত বাসগৃহটি গুরুত্বপূর্ণ ‘স্মারক-চিহ্ন’ এবং কবরস্থানটি ‘পুণ্যতীর্থে’ পরিণত হবে” আজ সত্যবাণীতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের সর্বজনশ্রদ্ধেয় প্রগতিশীল সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী আবুল ফজলের ভাষায়, “বাংলাদেশের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ও সর্বাধিক উচ্চারিত নাম : শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের ইতিহাসের তিনি শুধু নির্মাতা নন, তাঁর প্রধান নায়কও। ঘটনাপ্রবাহ ও নিয়তি তাঁকে বার বার এ নায়কের আসনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। বলা যায়, যেন হাত ধরে টেনে নিয়ে গেছে। শত চেষ্টা করেও তাঁর নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যাবে না। ইতিহাস দেয়না তেমন কিছু করতে। ইতিহাস নিজের অঙ্গ করে না ছেদন। শেখ মুজিব ইতিহাসের তেমন এক অচ্ছেদ্য অঙ্গ। বাংলাদেশের শুধু নয়, বিশ্ব-ইতিহাসেরও”। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, সেটি ঐতিহাসিক বক্তৃতা বলা হলে যথেষ্ট হবে না। সেই বক্তৃতা ছিল পৃথিবীতে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক বক্তৃতা। ভাষার শক্তিতে, আবেগের স্ফুরণে এবং বক্তব্যের শাণিত ক্ষুরধারে ৭ মার্চের বক্তৃতা ছিল অসাধারণ এবং অদ্বিতীয়। পৃথিবীর আর কোন দেশে কোন রাজনীতিবিদ বা গণনায়ক কখনও এমন বলিষ্ঠ ভঙ্গিতে, তেজোদ্দীপ্ত ভাষায় এবং সময়োপযোগী করে বক্তৃতা দিয়েছেন, তার উদাহরণ নেই। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের মার্টিন লুথার কিং ১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন, তার সংজ্ঞা অংশ ছিল ‘ও যধাব ধ ফৎবধস’ উক্ত বক্তৃতার একটি অংশ ছিল নিম্নরূপ : “ও যধাব ধ ফৎবধস ঃযধঃ ড়হব ফধু ঃযরং হধঃরড়হ রিষষ ৎরংব ঁঢ় ধহফ ষরাব ড়ঁঃ ঃযব ঃৎঁব সবধহরহম ড়ভ রঃং পৎববফ. ডব যড়ষফ ঃযবংব ঃৎঁঃযং ঃড় নব ংবষভ বারফবহঃ ঃযধঃ ধষষ সবহ ধৎব পৎবধঃবফ বয়ঁধষ, ও যধাব ধ ফৎবধস ঃযধঃ সু ভড়ঁৎ পযরষফৎবহ রিষষ ড়হব ফধু ষরাব রহ ধ হধঃরড়হ যিবৎব ঃযবু রিষষ হড়ঃ নব লঁফমবফ নু ঃযব পড়ষড়ঁৎ ড়ভ ঃযবরৎ ংশরহ, নঁঃ নু ঃযব পড়হঃবহঃ ড়ভ ঃযবরৎ পযধৎধপঃবৎ”. উল্লেখ্য যে, স্বল্প পরিসরের এই নিবন্ধনটি চট্টগ্রামের দৈনিক পূর্বকোণের ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৪ বিশেষ সংখ্যায় মুদ্রিত হলেও কতিপয় ¯েœহভাজন ছাত্র, বন্ধু ও গবেষকদের বিশেষ অনুরোধে জাতীয় পর্যায়ে প্রকাশের জন্য পুনঃউপস্থাপন করা হলো। কারণ হিসেবে বলা যায়, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে সকল ধর্ম, বর্ণ, শ্রমিক, ছাত্র, ধনী গরিব নির্বিশেষে বাঙালী সকল জনগোষ্ঠীর জন্য এক অসাধারণ পথ প্রদর্শন ও দিক নির্দেশনা যার মধ্যে সকল শ্রেণী-পেশার বাঙালী পরবর্তীতে একটি ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত, শোষণমুক্ত অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্নকে ধারণ করতে পেরেছে এবং তার বাস্তবায়নে তাঁরই সুযোগ্য গণতন্ত্রের মানসকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নিরলস সংগ্রামে সমগ্র জাতি আজ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সমাপ্ত... লেখক : শিক্ষাবিদ, উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
×