ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. আর এম দেবনাথ

ব্যাংক ব্যস্ত বড়দের সেবায়, নারী উদ্যোক্তারা ঋণ পাবে কোত্থেকে?

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ১০ মার্চ ২০১৭

ব্যাংক ব্যস্ত বড়দের সেবায়, নারী উদ্যোক্তারা ঋণ পাবে কোত্থেকে?

ব্যাংক ও ব্যাংকারদের ‘দুষের’ কোন অভাব নেই। ইদানীং তাদের আরেক ‘দুষের’ কথা ব্যাপকভাবে আলেচিত হচ্ছে। একে ‘দুষ’ না বলে অভিযোগ বলাই উচিত। কারণ, ‘দুষের’ কোন বিচার নেই, কিন্তু অভিযোগের বিচার আছে। বিচার আছে বলেই বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া দরকার। বলা হচ্ছে ব্যাংক নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে চায় না। চায় না বলাটা ঠিক হলো না। ব্যাংক নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ দেয় না। আগে এই সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া যেত না। এখন প্রচুর তথ্য। একটি দৈনিকে দু’য়েকদিন আগে একটি খবর ছাপা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে ‘ব্যাংক ঋণের এক শতাংশও পাননি নারীরা।’ সংশ্লিষ্ট খবরটিতে বলা হয়েছে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ৭ লাখ কোটি টাকারও বেশি। এর এক শতাংশও নারী উদ্যোক্তারা পাননি। ২০১৬ সালের শেষে মোট ৪১ হাজার ৬৭৫ জন নারী উদ্যোক্তা ঋণ পেয়েছেন মাত্র ৫ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট খবরটিতে মোট বকেয়া ঋণ (আউট স্ট্যান্ডিং ক্রেডিট) এর তথ্য দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা কত তার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে নারী উদ্যোক্তাদের প্রদত্ত মোট ঋণের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। হ্রাস পেয়েছে নারী-উদ্যোক্তার সংখ্যা। অবশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক একে তথ্য বিভ্রাট বলে দাবি করেছে। কোন একটি ব্যাংকের হিসাব নিয়েই এই তথ্য বিভ্রাটের জন্ম। সে যাই হোক, সংশ্লিষ্ট খবরটিকে আমলে নিয়ে বলাই যায় ব্যাংক নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ দিচ্ছেই না। দেশের বিশিষ্ট নারী উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীগণ একে ব্যাংকারদের মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা বলে অভিহিত করেছেন। তারা বলছেন নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে ব্যাংকাররা আন্তরিক নন। দেখা যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চেষ্টা করছে, অনেক ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ও নির্দেশের পর নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু ফল হচ্ছে শূন্য। নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকগুলোকে উৎসাহিতও করে। কিন্তু আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণেই অভিযোগ ক্রমেই ধূমায়িত হচ্ছে। এখন দেশে ‘নারী দিবস’ উদযাপিত হচ্ছে। এই উপলক্ষে বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আলোচিত হচ্ছে। নারী উদ্যোক্তারা ঋণ পায় না এ কথা যেমন সত্য তেমনি আরও অনেক সত্য আছেÑ যা ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে যায়। কী সরকারী, কী বেসরকারী ব্যাংক কেউ নারীদের যেমন ঋণ দিতে চায় না তেমনি তারা সমাজের অনেক শ্রেণী ও পেশার লোককেই ঋণ দিতে চায় না। এই যেমন ধরা যাক ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কথা। সরকারী হিসাবে এই মুহূর্তে দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুর সংখ্যা ১৬ কোটির মধ্যে ১০ শতাংশ। কারও কাছে ধর্মীয় ভিত্তিতে কোন হিসাব নেই। সংসদেও ধর্মীয় ভিত্তিতে ঋণের বিভাজন ভিত্তিক হিসাব নেই। থাকলে পরিষ্কার দেখা যেত ধর্মীয় সংখ্যালঘুরাও ঋণ পায় না। তাদের ঋণ দিতেও ব্যাংকগুলোর অনীহা আছে, অনেক ক্ষেত্রে আছে প্রতিরোধ। ক্ষুদ্রঋণ, এসএমই ঋণ, শিল্পঋণ, পাটঋণ, গৃহনির্মাণ ঋণ, চা শিল্পে ঋণ, চামড়া শিল্পে ঋণ, ব্যবসায়িক ঋণ (ট্রেড ক্রেডিট), কৃষি ঋণ থেকে শুরু করে সকল ধরনের ঋণের ক্ষেত্রেই ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা নারীদের মতোই উপেক্ষিত। এখানেও ব্যাংকারদের মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা প্রবল। সমস্যা রয়েছে আদিবাসীদের ক্ষেত্রে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকেরা ও উদ্যোক্তা ঋণ পায় না। ভারতের সংখ্যালঘুদের আর্থিক অবস্থা জানার জন্য ‘সাচার কমিটি’ বলে একটি কমিটি হয়েছিল। সেই কমিটির রিপোর্টে দেখা যায় তারাও আর্থিক দিক দিয়ে বঞ্চিত। সেই বঞ্চনা রোধে রাজ্যে রাজ্যে ‘সংখ্যালঘু উন্নয়ন বোর্ড’ গঠন করা হয়েছে। আমাদের দেশে এই উদ্যোগ এখনও গৃহীত হয়নি। অথচ হওয়া উচিত। শুধু নারী উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী নয়, সমাজের অনেক ছোট পেশার লোকেরাও ব্যাংক ঋণ পায় না। জায়গায় জায়গায় ব্যাংক শাখা আছে। সারাদেশে কমপক্ষে ১০ হাজার ব্যাংক শাখা আছে। এসব শাখার পাশেই যে ছোট ছোট দোকানদার আছে তারা কী ব্যাংক থেকে ঋণ পায়? ঋণ তো দূরের কথা, কোন ব্যাংকার কী তাদের কাছ থেকে ছোট ছোট আমানত সংগ্রহের চেষ্টা করেন? না, এটা হচ্ছে পরিষ্কার উত্তর। সারাদেশে মোটরসাইকেলে ভরে গেছে। গ্রামে-গঞ্জে যুবকরা এসব সাইকেল সংগ্রহ করে ভাড়ায় খাটে। পাঁচ কিলো, দশ-বিশ কিলো রাস্তা তারা যাত্রীদের নিয়ে যায়। বলা যায় ‘ডোর টু ডোর’ সার্ভিস দিচ্ছে তারা। বাসওয়ালারাও তাদের কাছে পরাস্ত। সেই মোটরসাইকেল নষ্ট হয়। তা মেরামতের ব্যবস্থা গ্রামেই আছে। মোটরসাইকেল কেনা, মেরামতি ব্যবসার টাকার জোগান দেয় ‘মহাজনরা’। তারা উচ্চ কিস্তিতে যুবকদের কাছে মোটরসাইকেল বিক্রি করে। ব্যাংকার সাহেবরা কী করেন? তারা কী কখনও এই শ্রেণীর ঋণগ্রহীতা ও উদ্যোক্তাদের কাছে যান। আমি নিশ্চিত তারা যান না। এ ছাড়া রয়েছে আঞ্চলিক বৈষম্য, ভীষণ বৈষম্য। ব্যাংকঋণ সব কেন্দ্রীভূত ঢাকা ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে। দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ব্যাংকঋণ পায় না। রাজশাহী, রংপুর, খুলনা, বরিশালের লোকেরা ঋণ পায় না। নেত্রকোনা, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর, নীলফামারী প্রভৃতি অঞ্চলের লোকেরা ঋণ পায় না। জেলাওয়ারি মাথাপিছু ব্যাংকঋণের তথ্য হিসেবে নিলেই আমার কথার সত্যতা মিলবে। গ্রামের মানুষ বাধ্য হয়ে সুদের ব্যবসায়ীর আশ্রয় নেয়। আশ্রয় নেয় ‘এনজিও’দের কাছে। কৈ ব্যাংকারদের তো এসব ব্যাপারে ভাবিত দেখছি না। আবার সমস্যা আছে ‘খাত’ (সেক্টর) নিয়েও। আমাদের ‘সুদক্ষ’, ‘প্রাণপ্রিয়’ ব্যাংকার ভাইয়েরা ‘ট্রেড ক্রেডিট’ ছাড়া কোন পথ দেখেন না। মোট বকেয়া ঋণের একটা বিরাট অংশই নিয়োজিত ব্যবসায়িক ঋণে। এখানেই তাদের লাভ বেশি। অতএব তারা ‘ট্রেড ক্রেডিট’ দিতেই ব্যস্ত। কত ধরনের ঋণ দেশে-বিদেশে আছে, তারা ওইসব ঋণে যেতে চায় না। শিল্প ঋণে তারা যায় না। আরও বড় অভিযোগ একটা আছে। ব্যাংকাররা পৃথিবীতে দুই ধরনের কাজ করে। প্রথমত ব্যাংকাররা যায় উন্নত অঞ্চলে। একটা অঞ্চল নানাভাবে উন্নত হয়ে পড়েছে। ব্যাংক সেখানেই যায়। ‘ব্যাংক ফলোজ ডেভেলপমেন্ট’। আবার প্রতিবেশী দেশসহ অনেক দেশেই ব্যাংক একটা অঞ্চলে গিয়ে সেই অঞ্চলকে উন্নত করছে এবং করেছে। উন্নয়নশীল দেশে এটাই আদর্শ ব্যাংকিং। হতভাগা বাংলাদেশে ব্যাংকাররা হচ্ছে সুদিনের বন্ধু। যে অঞ্চল ইতোমধ্যেই উন্নত সেই অঞ্চলেই ওরা গিয়ে ‘ব্রাঞ্চ’ খোলে। অথচ এটা করার কথা ছিল না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার ‘লাইসেন্স’ পলিসি এমনভাবে করেছে যাতে একটা ‘ব্রাঞ্চ’ শহরে করলে দুইটা-তিনটা ব্রাঞ্চ গ্রামে করতে হয়। নানা কায়দায় ব্যাংকগুলো এই রীতি লঙ্ঘন করে যেমন করে অন্যান্য ক্ষেত্রে। এভাবে দেখলে বোঝা যাবে ব্যাংকের বিরুদ্ধে অভিযোগের তালিকা খুবই বড়। আমাদের দেশের ব্যাংকগুলো পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো ধনীদের আবাসস্থলে পরিণত হয়েছে। তারা শুরুটা করেছিল ভালই। স্বাধীনতার পরপর বেশ কিছুদিন তারা উদ্যোক্তা উন্নয়নের কাজটা করেছে। নতুবা এত ‘গার্মেন্ট’স কারখানার মালিক সৃষ্টি হতো না। সৃষ্টি হতো না এত শত শত কারখানা ও শিল্প। বস্ত্র ও ওষুধ থেকে শুরু করে বিভিন্ন খাতে দেশে অনেক উদ্যোক্তার সৃষ্টি হয়েছে। এসবই ব্যাংকের অবদানÑ এ কথা বলতে আমাদের কোন দ্বিধা নেই। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে একটি। ব্যাংকারা এসব এখন ভুলে গেছে। তারা বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের ‘সেবাদাসে’ পরিণত হয়েছে। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা ৪৫-৪৬ বছরে ছোট থেকে বড় হয়েছে, বড় থেকে মহীরুহ হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় ব্যাংকাররাও বড়দের সেবায় ব্যাপৃত হয়ে পড়েছে। এখন বড় বড় ঋণ ছাড়া তারা আর কিছুই চিন্তা করতে পারে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই ‘লার্জ লোন’ নিয়ে খুবই দুুশ্চিন্তাগ্রস্ত। কিন্তু তাহলে কী হবে? ব্যাংকগুলো ছোট ও মাঝারিদের বাদ দিয়ে বড়দের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। অথচ এই বড়রা এখন ব্যাংকগুলোর জন্য ‘বিষফোঁড়ায়’ পরিণত হয়েছে। তাদের আগে পুনঃতফসিলের সুবিধা দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ তারা যাতে ঋণখেলাপী (ডিফল্টার) না হয় সেজন্য তাদের ঋণকে পুনঃতফসিল করা হয়েছে। একবার পুনঃতফসিল (রিসিডিউলিং) নয়, দুইবার নয়, তিনবার নয়, বার বার করা হয়েছে এই পুনঃতফসিল। সেই সুবিধার অপব্যবহারের কারণে ইদানীং পুনঃতফসিলের সুযোগ সীমিত করা হয়েছে। মোটে তিনবার রিসিডিউলিং করা যাবে। এতে হয়েছে বিপদ। সব আটকা পড়ার মতো অবস্থা। বুদ্ধি করা হয়েছে একটা। নতুন নামে রিসিডিউলিংকে পাকাপোক্ত করা হয়। নতুন নাম ‘রিস্ট্রাকচারিং অব লার্জ লোন’। পাঁচশত কোটি টাকার ওপরের ঋণের জন্য এই সুযোগ দেয়া হয়েছে। এতেও কাজ হচ্ছে না। এসব ঋণের বড় অংশ আবার ‘ডিফল্ট’ করছে। কাগজে খবর এসেছে যে, বড় ঋণ গ্রহীতারা ঋণ পরিশোধে আবার ব্যর্থ হচ্ছেন। এখন উপায়? আমি জানি না। যদি ব্যাংকগুলো ‘রিটেইল’ ব্যাংকিংটা ভাল করে করত তাহলে বড় বড় লোন নিয়ে আজ ব্যাংকগুলো যে বিপদে পড়েছে সেই বিপদে পড়ত না। সারা বিশ্বেই এই অবস্থা। নিয়ন্ত্রণহীন বাজার অর্থনীতির কবলে পড়ে ধনীরা ধনী হচ্ছে, গরিবরা গরিব। এই প্রক্রিয়াকে সাহায্য, সমর্থন ও সহযোগিতা জোগাচ্ছে ব্যাংকাররা এবং ব্যাংকের রাজনৈতিক মালিক-পরিচালকরা। সেজন্য বিশ্বব্যাপীই ব্যাংকাররা আজ বেশ নিন্দিত। এমতাবস্থায় নারী উদ্যোক্তা, ধর্মীয় সংখ্যালঘু উদ্যোক্তা, আদিবাসী উদ্যোক্তারা ঋণ পাবে কোত্থেকে? কোত্থেকে ঋণ পাবে বিভিন্ন অঞ্চলের লোকেরা। কোত্থেকে ঋণ পাবে স্বনিয়োজিত লোকেরা? কোত্থেকে ঋণ পাবে অর্থনীতির বিভিন্ন খাত। খুব সঠিকভাবেই বলা হচ্ছে ব্যাংকারদের রয়েছে মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা। কেনই বা হবে না? তাদের তো কোন জবাবদিহিতা নেই। বেসরকারী ব্যাংক সেবা করে মালিক ও মালিকদের বন্ধুদের। সরকারী ব্যাংকের গ্রাহকদের ঋণসুবিধা দিয়ে ব্যাংক তাদের নতুন ব্যাংকের পরিচালক হতে সাহায্য করে। অবসরের পর ব্যাংকাররা সেখানে উপদেষ্টা হন, চাকরি করেন। এ এক বৃহত্তর ‘পার্টনারশিপ’। ব্যাংক, ব্যাংকার ব্যাংক-পরিচালক মিলে একটা এ্যালায়েন্সে পরিণত হয়েছে। এমতাবস্থায় নারী উদ্যোক্তাদের জন্য প্রার্থনা করা ছাড়া আমি কোন উপায় দেখি না। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×