ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কোর্টের নির্দেশের পরও হাজারীবাগ ট্যানারিতে কর্মব্যস্ততা

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ৯ মার্চ ২০১৭

কোর্টের নির্দেশের পরও হাজারীবাগ ট্যানারিতে কর্মব্যস্ততা

আরাফাত মুন্না ॥ হাজারীবাগের সব ট্যানারি বন্ধ করে গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে আদালতের আদেশ আসার তৃতীয় দিনেও কারখানাগুলোতে দেখা গেছে স্বাভাবিক কাজের ব্যস্ততা। ট্যানারি মালিকরা বলছেন, আদালতের আদেশের কপি পেলে তারা আপীল করবেন। আগের মতো পালা করে কারখানার কাজকর্ম চালিয়ে গেলেও শ্রমিকরা বলেছেন তাদের ভবিষ্যত শঙ্কার কথা। বুধবার হাজারীবাগে গিয়ে দেখা যায়, কারখানাগুলোতে স্বাভাবিক কাজকর্ম চলছে। কোন ট্যানারির গ্যাস বা বিদ্যুতের লাইনও কাটা পড়েনি। সকালে সূচী অনুযায়ী কাজে যোগ দেয়ার পর বেলা ১১টার দিকে নাস্তার বিরতিতে বের হন শ্রমিকরা। লেক্সকো লিমিটেড নামের একটি কারখানার নিরাপত্তাকর্মী মহিউদ্দিন বলেন, বিভিন্ন সময় সরকারের বিভিন্ন দফতরের লোকজন কারখানায় আসেন। তবে নতুন করে গ্যাস-বিদ্যুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কোন পদক্ষেপ চোখে পড়েনি, কেউ নোটিসও দেয়নি। আগের মতোই কারখানা চলছে এবং শ্রমিকরা পালা করে কাজ করছেন বলে জানান তিনি। পাশের আরেকটি কারখানার শ্রমিক রাজিব মিয়া বলেন, কাজ চালিয়ে গেলেও দুশ্চিন্তা হচ্ছে আমাদের। তিনি বলেন, আমরা এইখানে থাকি অনেক দিন হয়। কারখানা সাভারে গেলে চাকরি থাকবে কি না, থাকলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা কী হবে, এইখানে আগের বাসায় থাকলে যাওয়া-আসা কীভাবে করবÑ এসব তো ঠিক নাই। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) এক আবেদনের শুনানি নিয়ে সোমবার হাজারীবাগের সব ট্যানারি অবিলম্বে বন্ধের নির্দেশ দেয় হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ। সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে কারখানা সরিয়ে নিতে দফায় দফায় সময় দেয়ার পরও তা না করায় এবং আদালতের অনুমতি না নিয়েই সরকার নতুন করে ট্যানারি মালিকদের ৩১ মার্চ পর্যন্ত সময় দেয়ায় হাইকোর্টের এই আদেশ আসে। ঢাকার হাজারীবাগ থেকে চামড়া শিল্প কারখানাগুলো সাভারে স্থানান্তর করতে ট্যানারি মালিকদের সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন দফতরের আলোচনা চলছে গত তিন দশক ধরে। আদালত থেকে বারবার তাগাদা আসায় কিছু কারখানা সাভারে স্থানান্তর হলেও বড় অংশ রয়ে গেছে আগের স্থানেই। চামড়া শিল্প মালিকদের গড়িমসির কারণে গতবছর এক আদেশে ট্যানারিগুলোকে পরিবেশের ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রতিদিন ১০ হাজার টাকা করে সরকারের কোষাগারে জমা দিতে বলেছে সর্বোচ্চ আদালত। সোমবার হাইকোর্টের সর্বশেষ আদেশে হাজারীবাগের ট্যানারি কারখানাগুলোর বিদ্যুত, গ্যাস ও পানির সংযোগও বিচ্ছিন্ন করতে বলা হয়েছে। নির্দেশনা বাস্তবায়ন করে পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালককে ৬ এপ্রিলের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এর আগে বাংলাদেশ সরকার ১ হাজার ৯৮৬ সালে ৯০৩টি শিল্প কারখানা পরিবেশ দূষণকারী হিসেবে চিহ্নিত করে। এর মধ্যে হাজারীবাগের চামড়া কারখানাগুলো ছিল। এরপর কারখানার পরিবেশ দূষণরোধে নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে ১৯৯৪ সালে রিট করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)। মামলার নথি সূত্রে জানা গেছে, এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০১ সালে ট্যানারি শিল্প হাজারীবাগ থেকে সরিয়ে নিতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। ওই আদেশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় ২০১০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্প অন্যত্র সরিয়ে নিতে ২০০৯ সালের ২৩ জুন হাইকোর্ট ফের নির্দেশ দেন। সরকারপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই সময়সীমা কয়েক দফা বাড়িয়ে ২০১১ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত করা হয়। এরপরও ওই এলাকা থেকে ট্যানারি শিল্প কারখানা সরিয়ে নেয়া হয়নি। সর্বশেষ শিল্প মন্ত্রণালয় হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তরের সময়সীমা চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। এই সিদ্ধান্তের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে গত ৩ জানুয়ারি হাইকোর্টে আবেদন করে বেলা। ওই আবেদনে শিল্প সচিবের সময়সীমা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণার পাশাপাশি হাইকোর্টের আদেশ অনুযায়ী পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ৪(৩) ও ৪(ক) ধারা অনুসরণ করে পরিবেশ অধিদফতরকে হাজারীবাগের ট্যানারি বন্ধের নির্দেশনা প্রদানের আবেদন জানানো হয়। সোমবার ওই আবেদনের ওপর শুনানি শেষে আদেশ দেন হাইকোর্র্ট। হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সরাতে বারবার সময় দেয়ার পরও তা আমল না করায় ২০১৬ সালের ১৬ জুন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ১৫৪টি ট্যানারি কারখানাকে প্রতিদিন ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা দিতে আদেশ দেন। পরে ১৮ জুলাই তা কমিয়ে ১০ হাজার টাকা নির্ধারণ করে দেন আপীল বিভাগ। গত ২ মার্চ হাজারীবাগের ১৫৪টি ট্যানারি প্রতিষ্ঠানের কাছে জরিমানা বাবদ পাওয়ানা ৩০ কোটি ৮৫ লাখ টাকা আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেয়ার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ট্যানারি মালিকদের আরও সময় চাওয়ার বিষয়ে বলেন, ট্যানারি মালিকদের অনেক সুযোগ দেয়া হয়েছে। এখন তাদের আরও সুযোগ দেয়া হলে সেটা হবে দুঃখজনক। ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, হাজারীবাগে চামড়া শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৩০ হাজার শ্রমিক জড়িত। এখনও শতাধিক কারখানা এখানে চালু রয়েছে, যার মধ্যে ২০ কারখানা আকারে বড়। তিনি আরও বলেন, সব শ্রমিকই এখানে কাজ করছে। সাভারে গিয়েছে মাত্র ৫০০ বা তার কিছু বেশি শ্রমিক। শ্রমিক ইউনিয়নের এই নেতা বলেন, কারখানা স্থানান্তরের চেয়ে তাদের বেশি চিন্তা সাভারে শ্রমিকদের থাকার ব্যবস্থা নিয়ে। সেখানে শ্রমিকদের জন্য বাসস্থান, হাসপাতাল, শিশুদের জন্য স্কুল করার আশ্বাস দেয়া হলেও এখনও তার কিছুই হয়নি বলে জানান আজাদ। তাই স্থানান্তর প্রক্রিয়া চলার পাশাপাশি এসব সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। আদালতের নির্দেশের পরও হাজারীবাগে কারখানা চালু রাখার বিষয়ে বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার এ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ মাহিন বলেন, ট্যানারি মালিকরা আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী চলবেন। তবে আদেশের কপি এখনও হাতে আসেনি। কপি পেলে মালিকরা বসে আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবেন। মহিউদ্দিন বলেন, সুযোগ থাকলে তারা আপীল করবেন। তা না হলে আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নে সহযোগিতা করতে হবে তাদের। তার দাবি, ফেব্রুয়ারির শুরু থেকে হাজারীবাগে কোন কাঁচা চামড়া ঢুকছে না। ফলে পরিবেশ দূষণ ৭৫ শতাংশ কমে গেছে। ডাইং ও ফিনিশিংয়ের যে কাজ এখন চলছে তা স্থানান্তর হয়ে গেলে শতভাগ দূষণমুক্ত হয়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি।
×