ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গী ছিনতাই বিষয়ে খোদ তদন্ত রিপোর্টেই তথ্য

২৯৪ পুলিশ ও ১১ কারা রক্ষীর বিরুদ্ধে জঙ্গীদের সহায়তার অভিযোগ

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ৯ মার্চ ২০১৭

২৯৪ পুলিশ ও ১১ কারা রক্ষীর বিরুদ্ধে জঙ্গীদের সহায়তার অভিযোগ

শংকর কুমার দে ॥ জঙ্গীরা আবারও সক্রিয়। যে কোন দিন কারাগার থেকে আদালতে আনা-নেয়ার সময়ে জঙ্গী হামলা ও দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটতে পারে। কারাগার থেকে আদালতে আসামি আনা-নেয়ার ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময়ই প্রিজনভ্যানগুলো থাকে নিরাপত্তাহীন। অভিযোগ রয়েছে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ও ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের কারাগার থেকে আদালতে হাজিরা দিতে নেয়ার সময় নানাভাবে অবৈধ সুযোগ করে দেয় অসাধু পুলিশ ও কারারক্ষীরা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ ও কারা অধিদফতরের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত একটি তদন্ত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে ২৯৪ পুলিশ ও ১১ কারারক্ষীর বিরুদ্ধে আসামিদের অবৈধ সুযোগ করে দেয়ার প্রমাণ পাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই তদন্ত কমিটি ১৮ দফা সুপারিশ করেছে চিহ্নিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জঙ্গী ও দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীদের আনা-নেয়ার সময়ে প্রিজনভ্যানের নিরাপত্তা বাড়ানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কাশিমপুর কারাগারের এক কর্মকর্তা বলেন, কোন আসামিকে আদালতে পাঠানোর আগে জেলা পুলিশ সুপারের কাছে আসামির অপরাধের বিবরণ, মামলার সংখ্যা, সাজার পরিমাণসহ সবকিছু উল্লেখ করে চিঠি পাঠানো হয়। সেই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ সুপার অপরাধীদের আদালতে আনা-নেয়ার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে থাকেন। কারা কর্তৃপক্ষ পুলিশের কাছে আসামি বুঝিয়ে দেয়ার পর তাদের আর কিছুই করার থাকে না। এরপর সব দায়িত্বই পালন করে পুলিশ সদস্যরা। বাস্তবে পুলিশী নিরাপত্তার নামে যা দেয়া হচ্ছে, তাতে নিরাপত্তা যথাযথ না হওয়ায় ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, কারা কর্তৃপক্ষ সঠিকভাবে অপরাধীদের বর্ণনা জানালে পুলিশ কর্তৃপক্ষ সেই ধরনের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তদন্তে দেখা গেছে, কারাগার কর্তৃপক্ষ চিঠি দিয়ে আসামিদের নিরাপত্তা দেয়ার কথা বলে অপরাধীর ধরন উল্লেখও করেন। তবু বেশির ভাগ সময়েই নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয় সাধারণ অপরাধীদের নিরাপত্তার মতোই, যা রুটিন ওয়ার্ক। এতে জঙ্গী ও দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী নিরাপত্তার জন্য ঘাটতি থাকার প্রমাণ রয়েছে বলে তদন্তে উঠে এসেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (পুলিশ-১) নুরুল ইসলামকে কমিটির আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এই তদন্ত কমিটির অপর দুই সদস্য হচ্ছেনÑ পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি আবু কালাম সিদ্দিক ও কারা অধিদফতরের ঢাকা বিভাগের ডিআইজি তৌহিদুল ইসলাম। গত নবেম্বরে গঠিত তদন্ত কমিটির দুর্ধর্ষ ও ধনাঢ্য আসামিদের সুযোগ করে দেয়ার তদন্ত করতে গিয়ে ২৯৪ পুলিশ ও ১১ কারারক্ষীকে চিহ্নিত করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ ও কারা অধিদফতরের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত একটি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে কারাবন্দী দুর্ধর্ষ অপরাধীদের অবৈধ সুযোগ-সুবিধা বন্ধে ১৮ দফা সুপারিশ করা হয়েছে, যাতে কারাগার থেকে আদালতে হাজিরা দিতে নেয়ার সময় দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ও ধনাঢ্য বন্দীদের নানাভাবে অবৈধ সুযোগ করে দিচ্ছে অসাধু পুলিশ ও কারারক্ষীরা। প্রিজনভ্যানের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা একশ্রেণীর পুলিশ সদস্য আসামিদের বাসায় যাওয়ার বা স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। পাশাপাশি কারাগারের ভেতরে ধনাঢ্য ও দুর্র্ধর্ষ বন্দীদের আয়েশি জীবনযাপনেরও সুযোগ করে দিচ্ছে কারারক্ষীরা। তদন্ত কমিটি এ ধরনের অবৈধ সুযোগ দেয়ার একটি ঘটনায় ২৯৪ পুলিশ সদস্য ও ১১ কারারক্ষীর জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে। তাদের চিহ্নিত করে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশও করা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে। মোটা অঙ্কের বিনিময়ে এ সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে এক শ্রেণীর কারারক্ষী ও পুলিশ সদস্য। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ ধরনের কারারক্ষী ও পুলিশের অপরাধ এবং অপরাধীর কর্মকা- দমনে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক তদারকির মারাত্মক অভাব রয়েছে। তিন সদস্যের তদন্ত প্রতিবেদনে প্রিজনভ্যানে আসামি আনা-নেয়ার বিষয়ে বলা হয়েছে, দুর্ধর্ষ বন্দীদের অবৈধ সুযোগ-সুবিধা রোধে আসামি বহনকারী প্রতিটি প্রিজনভ্যানের নিরাপত্তা দিতে ব্যাকআপ হিসেবে অন্য একটি পুলিশ টিম রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। পুলিশের আলাদা ওই টিম আসামির প্রিজনভ্যানকে অনুসরণ করবে। কমিটি তাদের ১৮ দফা সুপারিশে বলেছে, প্রিজনভ্যানের দরজার চাবি ব্যাকআপ টিমের ইনচার্জের কাছে থাকবে। এতে কারাগারে আসামির সংস্পর্শে কাজের সময় সব কারা কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং আসামি পরিবহনের সময় নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যের মোবাইল ফোন নম্বর নিয়মিত ট্র্যাকিংয়েরও সুপারিশ রয়েছে। সুপারিশে বলা হয়, বন্দীদের স্থানান্তর সংক্রান্তে একটি সেন্ট্রাল কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা যেতে পারে। কারাগার এবং আদালত থেকে আসামি পরিবহনের পথে সব ধরনের সমস্যা বা প্রতিবন্ধকতা দূর করতে প্রিজনভ্যান বা ব্যাকআপ টিমের অফিসার ইনচার্জ নিয়মিত তার অবস্থান কন্ট্রোল রুমকে অবহিত করবেন। এতে কন্ট্রোল রুমের ইনচার্জ পথে সংশ্লিষ্ট থানাগুলোর অফিসার ইনচার্জকে সতর্ক করবেন। ওসি প্রয়োজনে থানার টহল দল দিয়ে প্রটেকশন দিয়ে আসামিবাহী প্রিজনভ্যানকে নিজের এলাকা দিয়ে অতিক্রম করানোর ব্যবস্থা নেবে। স্পর্শকাতর ও দুর্ধর্ষ আসামিদের হাজিরার বিষয়টি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সম্পন্ন করা, প্রিজনভ্যানের সামনে-পেছনে ও দরজায় সিসিটিভি স্থাপন এবং কারাগারে আসামিকে প্রিজনভ্যানে তোলার ও আদালতে নামানোর স্থানেও উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সিসিটিভি স্থাপনের সুপারিশ করা হয়েছে। তাছাড়া অবৈধ পন্থায় চিরকুটের মাধ্যমে বন্দীর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধে কারা ফটক, আদালত এবং বিচারিক আদালতের কাঠগড়ায় উঠানোর সময় এবং ফেরত আনার সময় দুর্ধর্ষ বন্দীর ধারের কাছে যেন কেউ ঘেঁষতে না পারে সে ব্যবস্থা নিতেও প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, কারাগার থেকে আদালতে জঙ্গী, দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী আসামিদের আনা-নেয়ার সময়ে নিরাপত্তা জোরদার করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার ফাঁসির আসামি হুজির প্রধান মুফতি হান্নানসহ ২১ আসামিকে ছিনিয়ে নেয়ার বিষয়ে থানা-পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা তদন্ত করা হচ্ছে। যে কোন সময়ে জঙ্গী ও দুর্ধর্ষ আসামি ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ঘটাতে পারে বলে যে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তার প্রতিরোধ হিসেবেই প্রিজনভ্যান, কারাগার, আদালতের নিরাপত্তা বাড়ানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জানান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা। নিজস্ব সংবাদদাতা নরসিংদী থেকে জানান, মুফতি হান্নানের প্রিজনভ্যানে বোমা হামলাকারী মোস্তফা কামাল ইমানের সহযোগী মিনহাজুল ইসলাম (১৯) নামে অপর জঙ্গীকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। বুধবার বিকেলে গাজীপুরের জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-৪ এর বিচারক সবুজের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। নরসিংদী জেলা পুলিশের সহযোগিতায় টঙ্গী থানা-পুলিশ মঙ্গলবার রাতে তাকে নরসিংদীর ম্যানচেস্টারখ্যাত শেখেরচর বাবুরহাট সংলগ্ন জামিয়া ইমদাদিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করে। সে এ মাদ্রাসার কামেল শ্রেণীর ছাত্র । মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আশরাফ আলী জানান, ধৃত মিনহাজুল ইসলামের বাড়ি মনোহরদী উপজেলার কাচিকাটা গ্রামে। তার পিতার নাম রতন মিয়া। নরসিংদীর এসপি আমেনা বেগমের নির্দেশে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ ও টঙ্গী থানা-পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে।
×