ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

সিলেটে বেঙ্গলের বর্ণাঢ্য আয়োজন

প্রকাশিত: ০৫:০২, ৯ মার্চ ২০১৭

সিলেটে বেঙ্গলের বর্ণাঢ্য আয়োজন

মানবিক সাধনায় বেঙ্গল সাংস্কৃতিক উৎসব সিলেট ২০১৭ বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরা ও প্রবহমান সাংস্কৃতিক ধারাকে নবীন দৃষ্টিভঙ্গিতে সঞ্জীবিত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ ২০১৭ পর্যন্ত দশ দিনব্যাপী সিলেটে আয়োজিত হলো মানবিক সাধনায় বেঙ্গল সাংস্কৃতিক উৎসব ২০১৭। ঢাকার বাইরে এবারই প্রথম সিলেটে আয়োজিত হলো এই সর্বকালের বৃহৎ সাংস্কৃতিক উৎসব। এতবড় সাংস্কৃতিক উৎসব এর আগে সিলেটে কখনও হয়নি। তাই উৎসব ঘিরে জেলার সব জায়গায় অন্যরকম এক আবহের সৃষ্টি হয়েছিল। এই উৎসব উৎসর্গ করা হয়েছিল জাতীয় অধ্যাপক জ্ঞানতাপস অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের স্মৃতির প্রতি। চোখ-ধাঁধানোর অনুভূতি! চারদিকে এত আয়োজন; তাতে বৈচিত্র্যতায় ভরা। সব আয়োজন বাঙালী ও বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতিকেন্দ্রিক। নৃত্য, গীত, আলোচনা, চলচ্চিত্র ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রদর্শনী মিলে বিশাল আয়োজন। উৎসবে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, খায়রুল আনাম শাকিল, অদিতি মহসিন, চন্দনা মজুমদার, জলের গান, কুদ্দুস বয়াতিসহ বাংলাদেশের ৩৮৩ জন সঙ্গীতশিল্পী-নৃত্যশিল্পী-চিত্রকর-নাট্যকুশলী-লেখক-কবি অংশগ্রহণ করেন। অনুষ্ঠানে মূল আকর্ষণ ছিলেন ভারতীয় শিল্পী হৈমন্তী শুকলা, শ্রীকান্ত আচার্য, মনোময় ভট্টাচার্য, জয়তী চক্রবর্তী ও পার্বতী বাউল। তা ছাড়া বিশিষ্ট চিত্রকর রফিকুন নবী, মনিরুল ইসলাম, শহিদ কবির, রোকেয়া সুলতানা, জামাল আহমেদ, শিশির ভট্টাচার্য, তৈয়বা লিপিসহ ২৭ জন শিল্পী উৎসব চলাকালীন ‘সুবীর চৌধুরী আর্ট ক্যাম্পে’ অংশগ্রহণ করেন। অনুষ্ঠানের প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শক উপভোগ করেন শিল্পীদের পরিবেশনা। সমাজ ও ঐতিহ্যচেতনায়, প্রজ্ঞায় ও সৃজনী-উৎকর্ষে অমর হয়ে আছেন সিলেট অঞ্চলের অগণিত মানুষ। এমন কয়েকজন মহান ব্যক্তির নামানুসারে উৎসবস্থলের চত্বর ও মঞ্চগুলোর নামকরণ করা হয়েছিল। অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা যায় আবুল মাল আবদুল মুহিত ক্রীড়া কমপ্লেক্সের মাঠে প্রধান মঞ্চটি অসামান্য মরমী কবি দেওয়ান হাছন রাজার নামে ‘হাছন রাজা মঞ্চ’ হিসেবে অভিহিত করা হয় । মাঠের প্রধান চত্বর যেখানে বাদ্যযন্ত্র ও সিলেট অঞ্চলের লোকগানের ইতিহাস নিয়ে প্রদর্শনী করা হয়েছে, সেটি বাউল গানের কিংবদন্তি শিল্পী শাহ আবদুল করিমের নামানুসারে নামকরণ করে। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ঔপন্যাসিক, ছোট গল্পকার, অনুবাদক ও রম্য রচয়িতা সৈয়দ মুজতবা আলী স্মরণে জিমনেসিয়ামের ভেতরে সাহিত্যসভা, মঞ্চনাটক ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জন্য যে মঞ্চটি করা হয়েছে তার নাম রাখা হয়েছিল ‘সৈয়দ মুজতবা আলী মঞ্চ’। অনুষ্ঠানের সপ্তম, অষ্টম, নবম, দশম দিনে মানুষের উপস্থিতি ছিল চোখে পরার মতো। হাজার হাজার দর্শক লাইন দিয়ে অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণে প্রবেশ করেন হৈমন্তী শুকলা, শ্রীকান্ত আচার্য, মনোময় ভট্টাচার্য, জয়তী চক্রবর্তী ও পার্বতী বাউলের পরিবেশনা দেখার জন্য ওইদিন পুলিশকে বেশ বেগ সামলাতে বেঙ্গল সাংস্কৃতিক উৎসবে শিশু, তরুণ, বৃদ্ধ সবারই দেখা পাওয়া গিয়েছে। তিন বছরের ছোট্ট শিশু সপ্তক। এসেছে তার মা অর্পিতা গুপ্তের হাত ধরে। সপ্তক বায়োস্কোপের সামনে গিয়ে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। অর্পিতা বলেন- ‘আমার ছেলে তো নয়ই, আমি নিজেও কোনদিন বায়োস্কোপ দেখিনি। এ উৎসবে মা-ছেলে মিলে জীবনের প্রথমবারের মতো বায়োস্কোপ দেখলাম।’ সংস্কৃতিকর্মী বিমান তালুকদার বলেন, কেবল শুনতাম ‘বেঙ্গল ফাউন্ডেশন’ নাম কিন্তু ঢাকায় গিয়ে তাদের আয়োজন দেখার ভাগ্য হয়নি। সিলেটে আয়োজনের ফলে অনেক কিছু শিখতে পেরেছি। আর আয়োজনটা ছিল বিশাল। উপভোগ করার মতো। বিশেষ করে শিল্পী নির্বাচন অনেক ভাল ছিল। যেমন- শ্রীকান্ত, হৈমন্তী শুক্লা, জয়তী চক্রবর্তী, কৃষ্ণকলি, মনোময় ভট্টাচার্য, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, ফেরদৌসি আরা, পার্বতী বাউল। আর আমাদের বাংলার এই সংস্কৃতিকে তোলে ধরে অনেক অজানাকে আমরা জেনেছি। এইটা আমাদের জন্য এক বিশাল পাওয়া। সৃজন দাস যুক্ত আছেন সাংস্কৃতিক সংগঠন শ্রুতি-সিলেটের সঙ্গে তিনি বলেন- শুরুর দিন থেকেই আছি বেঙ্গলের সঙ্গে দেশের ও বিদেশী সকল জনপ্রিয় শিল্পীদের পরিবেশনা, যা আমাদের সিলেটবাসীর কাছে অপূরণীয় পাওনা, কারণ তাদের আগে টিভিতে দেখতাম, এখন নিজের চোখের সামনে দেখছি, এর পুরো কৃতিত্বই বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের। আমরা চাই প্রতিবছরই একরকম আয়োজন সিলেটের মাটিতে হোক। কার কার গান ভাল লেগেছে জানতে চাইলে সৃজন বলেন হয়- বেঙ্গল প্রথম দিন অদিতি মহসিন ও জলের গানের পরিবেশনা ছিল অনবদ্ধ। তারপর অপার বাংলা প্রখ্যাত শিল্পী মনোময়ের কণ্ঠে ‘সৃজনও ছন্দে আনন্দ’ এই গানটি অনবদ্ধ ছিল। তারপর ৭ম দিন শ্রীকান্ত আচার্যের কণ্ঠে ‘ভাল আছি ভাল থেকে জয়তী চক্রবর্তীর কণ্ঠে ‘তুমি যে আমার ‘ও শ্রদ্ধেয় ময়না আপার কণ্ঠে ‘হৃদি পদ্মে চরণও রাখো, এই গানগুলো অনবদ্ধ ছিল, তা ছাড়াও চন্দনা মজুমদার, শামা রহমান, বুলবুল ইসলাম, প্রিয়াঙ্কা গোপসহ সকল শিল্পীর পরিবেশনা অতি মুগ্ধকর, যা আমার মন ছুঁয়ে গেছে। তবে এতসব কিছুর মাঝে কিছু ত্রুটিও লক্ষ্য করা গেছে। অনুষ্ঠানটি সকল শ্রেণীর দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত ছিল। সিলেটে অনুষ্ঠান হবার পরেও সিলেটের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো ছিল উপেক্ষিত। অনেকে আবার আমন্ত্রণপত্রই পাননি। তাছাড়া উৎসব অঙ্গনে খাবারের দাম ছিল অতিরিক্ত। কেবল শুনতাম ‘বেঙ্গল ফাউন্ডেশন’ শুনতাম এজন্য যে, আমার দাদা বেঙ্গল ফাউন্ডেশন ঢাকাতে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানগুলোর একজন গুণমুগ্ধ দর্শক। যতবারই ওখানে অনুষ্ঠান হয়, ততবারই ওকে আটকানোর সাধ্য কারও থাকে না। সে যাবেই যাবে। তা দিনব্যাপীই হোক অথবা রাতব্যাপী। সিলেট আমার জন্মভিটে। এখানে বেঙ্গল অনুষ্ঠান করবে আর বাসায় বসে থাকব, তা কী করে হয়..?? যথারীতি অনলাইন রেজিস্ট্রেশন করে টিকেট যোগাড় করে ফেললাম। পছন্দের শিল্পীদের অমিয়সুধা শোনার প্রহরের অপেক্ষায় উন্মূখ হয়েই থাকলাম। অনুষ্ঠান শুরুর দিনদুয়েকের মধ্যে অপ্রীতিকর একটা পরিস্থিতির জন্য মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল, উৎকণ্ঠা ভিড় করল, সিলেট কী তবে বঞ্চিত হবে নান্দনিক অনুষ্ঠানমালা থেকে..? এটা সিলেটবাসীর অপমান না সম্মান সে আরেক তর্ক। সম্মান কতটুকু ঝুলিতে পুরল জানি না তবে সামগ্রিক বিবেচনায় ব্যক্তিগতভাবে আমি খুব লজ্জিত। আমাদের সিলেটবাসীর উদার ইতিহাস আবার খোঁয়াড়ে আরষ্ট হয়েই থাকল। গেলাম প্রিয় সাংস্কৃতিক জন শ্রীকান্ত আচার্যের গান শুনতে। ভারত থেকে আগত দীর্ঘকায়, হাস্যময় এ শিল্পী বরাবরই আমার প্রিয় তালিকার একজন। নির্দিষ্ট দিনে প্রবেশ করে মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। আমরা কী গান শুনতে আসছি, না ঘুরে বেড়াতে আসছি। হাজার হাজার মানুষ কেবল এদিক-ওদিক ছোটাছুটিতে ব্যস্ত। তাঁতশিল্প, পাঞ্জাবির দোকান, গলা কানের দুলের দোকানে বায়োস্কোপ ইত্যাদি দোকানে উপচেপড়া ভিড়। পাশে জটলা দেখে, কেন জিজ্ঞেস করলে বুঝলাম ওখানটার রয়েছে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সুস্বাদু সব রান্না করা তরকারি আর ভাত। আরেক দিকে রয়েছে নামী-দামী সব মিষ্টির পসরা। দাম শুনলে একটু আৎকে উঠা ছাড়া আর গতি নেই। সবাই উৎসুক হয়ে আছেন শ্রীকান্তজী শুরু করবেন। রাত প্রায় ১০টায় অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে তিনি শুরু করলেন, একেকটা গান শেষ হয় করতালিতে কেঁপে ওঠে গোটা চত্বর। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে খেয়াল করলাম, গানের প্রতি আমাদের অনেক অনেক বিবাগ রয়ে গেছে। যারা অতিশয় আবেগী হয়ে শ্রীকান্তজীর গান শুনতে গেছেন, তারাই দেখলাম তখন বায়োস্কোপে চোখ রেখে সিরাজউদ্দৌলা আর নবাবী আমলের শায়েস্তা খানের বাংলা দেখছেন। প্রশ্ন উঠতে পারে, আমি কিভাবে তা দেখলাম, অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে প্রকৃতির আহ্বানে যখন অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে বের হলাম, তখন ব্যাপারগুলো দৃষ্টিগোচর হলো। শ্রীকান্তজীর গান শুনে কানে তার রেশ রয়ে যেতে যেতেই বাসায় ফিরি। চোখ রাখি ফেসবুকে, তাজ্জব হয়ে খেয়াল করি, সেসব অদ্ভুত গানপাগল মানুষদের যারা ছিল বায়োস্কোপ দেখায় মশগুল, যারা ছিল ঘুরে ঘুরে এটাসেটা খেতে বদ্ধপরিকর। তারাই শ্রীকান্তজীর ছবি আর গানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এত শংসাবচন মনে প্রশ্ন জাগে, দেখার জন্য গানের অনুষ্ঠানে যাচ্ছি, না শোনার জন্য যাচ্ছি। গান কী তাহলে দেখার বস্তু হয়ে গেছে। কাউকে কাউকে তার সঙ্গে সেলফি তুলে পোস্ট দিতেও দেখলাম। দিন শেষে মনে হলো, বেঙ্গলের প্রোগ্রামে যাওয়া মানে, অভিজাত শ্রেণীর বাসিন্দা সেটা, প্রমাণ দেবার সে কী প্রাণান্তকর চেষ্টা। নিজেকেই প্রশ্ন করলাম, কী বিচিত্র আমরা, কী বিচিত্র আমাদের গতিপ্রকৃতি। ধন্যবাদ, বেঙ্গল ফাউন্ডেশনকে। এমন নন্দিত অনুষ্ঠানের নান্দনিকতায় আমাদের জড়ানোর জন্য। আশা রাখি আগামীতেও তার ব্যত্যয় হবে না, তবে অনুরোধ একটাই এমন আয়োজনে আগামীতে রেজিস্ট্রেশনের সময় যেন একটা সম্মানী নির্ধারণ করে দেয়া হয়।
×