ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

১৯৭৫ এর প্রজন্ম এবং ওবায়দুল কাদেরের ‘দুই ভাগ’ -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৪:০২, ৯ মার্চ ২০১৭

১৯৭৫ এর প্রজন্ম এবং ওবায়দুল কাদেরের ‘দুই ভাগ’ -স্বদেশ রায়

সৈয়দ আশরাফ ছিলেন ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের রক্ত স্রোতধারার একজন আর ওবায়দুল কাদের ১৫ আগস্টের রক্তধারায় গড়ে ওঠা একজন। এদের একের সঙ্গে যেমন অন্যকে তুলনা করা যায় না তেমনি একজন থেকে অপরকে ছোট বা বড় করার কোন উপায় নেই। সৈয়দ আশরাফ আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারির কাজ করার দায়িত্ব পেয়েছিলেন ১/১১ এর পরে এক দুঃসময়ে। শত সমালোচনার উর্ধে উঠে ইতিহাস বলবে, তিনি একজন সফল মানুষ। তাঁকে ইতিহাস বা সময় যে দায়িত্ব দিয়েছিল তিনি তা সফলভাবে পালন করেন। সাফল্য, মানুষের ভালবাসা ও আনন্দাশ্রু নিয়ে তিনি তাঁর দায়িত্ব ওবায়দুল কাদেরের হাতে তুলে দিয়েছেন। এখন সময় ওবায়দুল কাদেরের। ওবায়দুল কাদের যে সুসময়ে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নিয়েছেন এমন বলার কোন সুযোগ নেই। এখন আওয়ামী লীগ সরকারে আছে তার অর্থ এই নয় যে, এটা আওয়ামী লীগের সুসময়। কারণ, পৃথিবীজুড়ে মানুষের মানবিক প্রকৃতি বা মেন্টাল ডেমোগ্রাফি যেভাবে বদলে যাচ্ছে তার ছাপ এখন বাংলাদেশেও পড়েছে ব্যাপক। এই সময়টি আওয়ামী লীগের জন্য কেন, কোন প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের জন্য কেউ যদি সুসময় বলেন তিনি মনে হয় সময়কে উপেক্ষা করেই বলবেন। বাস্তবে বলার কোন সুযোগ নেই। আওয়ামী লীগের মূল ভিত্তি বাঙালী সংস্কৃতি। আওয়ামী লীগ যদি বাঙালী সংস্কৃতি নির্ভর না থাকে, তখন আওয়ামী লীগ আর আওয়ামী লীগও থাকবে না, এমনকি আওয়ামী মুসলিম লীগও নয়, সেটা পুরোপুরি মুসলিম লীগ হয়ে যাবে। তখন বাংলাদেশের রাজনীতি দাঁড়াবে কাউন্সিল মুসলিম লীগ বনাম কনভেনশন মুসলিম লীগের। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ট্রাডিশনাল মুসলিম লীগ আর বিএনপি আইয়ুব খানের মুসলিম লীগ। বিএনপি বাস্তবে আইয়ুব খানের মুসলিম লীগ- এ কথা বহুবার লিখেছি। পাকিস্তানও তাই মনে করে। তাই পাকিস্তানী সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা বিএনপিকে পরিচালনা করে। অপরদিকে আওয়ামী লীগের মুসলিম লীগ হওয়ার কোন সুযোগ নেই। কারণ আওয়ামী লীগ যদি মুসলিম লীগ হয় তাহলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব সেই দিনই শেষ হয়ে যায়। আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধ একে অপরের পরিপূরক। আর মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালী সংস্কৃতি যমজ শব্দ। তাই আওয়ামী লীগ, মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালী সংস্কৃতিকে আলাদা করা যায় না। ওবায়দুল কাদের যে সময়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়েছেন এ সময়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে বাঙালী সংস্কৃতিকে লালন করার একটা চেষ্টা আছে কিন্তু বাস্তবে সমাজে বাঙালী সংস্কৃতি বেশ খানিকটা কোণঠাসা। এখানে শুধু কোণঠাসা শব্দটি প্রকৃত অর্থে সঠিক অবস্থাটা প্রকাশ করে না। বরং বলা যেতে পারে, কোণঠাসা ও দোলাচলে। কারণ, পহেলা বৈশাখ রাজধানীর রাস্তা মানুষে ভরে যাচ্ছে, আবার সংক্ষিপ্ত করতে হচ্ছে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান। অন্যদিকে যারা পহেলা বৈশাখকে বিরোধিতা করছেন, তারা প্রকাশ্যে করছেন। তাদের বিরুদ্ধে ওই অর্থে কোন সামাজিক প্রতিরোধ নেই। অপরদিকে যে কোন দেশের মাটির সংস্কৃতির সঙ্গে সব সময়ই মুক্তচিন্তার যোগ থাকে। মূলত মুক্তচিন্তাই ওই দেশের মাটির সংস্কৃতির প্রাণরস। কোন দেশের মানুষের স্বাভাবিক আচরণের ও কাজের ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠা নানান মুক্তচিন্তা চেতনাই ওই দেশের সংস্কৃতি। একে কোন মতেই ওই দেশের মানুষের থেকে আলাদা করা যায় না। কারণ, এটা মা প্রকৃতির দান। তবে মাঝে মাঝে নানান কট্টর চিন্তা-চেতনা বা আচরণ দিয়ে ওই মুক্তচিন্তাকে বা সংস্কৃতিকে ঢেকে দেয়ার চেষ্টা হয়। বাংলাদেশে এখন সেই চেষ্টা খুব বড়ভাবে চলছে। এখানে মুক্তচিন্তায় জেন্ডার শিক্ষা দেয়ার কারণে একজন শিক্ষককে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চাকরি হারাতে হচ্ছে। এখানে যাদের সঙ্গে আধুনিক চিন্তা-চেতনার বা ভূমি থেকে উৎসারিত চিন্তা-চেতনার কোন সম্পর্ক নেই; যারা আধুনিক শিক্ষা থেকে কয়েক হাজার বছর পিছিয়ে আছে- তাদের কথা মতো শিশুদের শিক্ষা বই পরিবর্তন হচ্ছে। এ নিয়ে সমাজে ও সরকারে বড় মাপের কোন প্রতিক্রিয়া নেই। এর থেকে স্পষ্ট হয়, সংস্কৃতির ওপর একটি কালো ছায়া পড়েছে। আর এই কালো ছায়ার সময়ে বাঙালীর সংস্কৃতি থেকে উৎসারিত দলটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিতে হয়েছে ওবায়দুল কাদেরকে। যদিও ওবায়দুল কাদের বলেছেন তিনি মাত্র ‘দুই ভাগ’ আর শেখ হাসিনা অষ্টানব্বই ভাগ। ওবায়দুল কাদের সত্য বলেছেন। কিন্তু তাকে এটাও স্বীকার করতে হবে কখনও কখনও দুই ভাগও কিন্তু অনেক বড়। রাম রাবণের যুদ্ধে মূল যুদ্ধ রামই করেছিলেন; কিন্তু সেখানে হনুমানের ভূমিকা দুই ভাগ হলেও কিন্তু বিশাল। এই বিশাল দায়িত্বের প্রথমে আসছে, কীভাবে ওবায়দুল কাদের তাঁর সংগঠনের ভেতর বাঙালী সংস্কৃতির চিন্তা-চেতনার ধারকদের সংগঠিত করবেন? কীভাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি সমাজের বাঙালী চিন্তা-চেতনার ধারকদের পেছনে রাজনৈতিক শক্তি নিয়ে দাঁড়াবেন? ওবায়দুল কাদের অনেক সময় বলেছেন, তাঁর দলে অনেক আগাছা ঢুকে গেছে। তাঁর এ কথা সত্য। ক্ষমতাসীন বড় রাজনৈতিক দলে আগাছা ঢোকে। কিন্তু এর থেকেও বড় দিক, তাঁর দলের নানান স্তরের নেতাদের মানবিক প্রকৃতির পরিবর্তন হয়ে গেছে। তাদের চিন্তা-চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রাখছে প্রাচীন চিন্তাধারা, বাঙালী সংস্কৃতি বিরোধীদের চিন্তার সঙ্গে তাঁরা শুধু আপোস করছেন না, তাঁরা বিশ্বাসও করছেন। এমনকি একজন রাজনীতিক হিসেবে তাঁরা জনগণকে পরিবর্তন করে নিজস্ব ভোটের ধারায় না এনে বরং তাঁরা ভোটের রাজনীতি বলে প্রাচীন চিন্তার কাছে আত্মসমর্পণ করছেন। এ কাজ পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষকেই সাহায্য করছে। ওই সব নেতার যাবতীয় কাজ বাস্তবে জমা হচ্ছে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষদের এ্যাকাউন্টে। আওয়ামী লীগের এই নেতাদের কীভাবে পরিবর্তন করবেন, এ বিষয়ে কোন বক্তব্য জনসমক্ষে ওবায়দুল কাদের বলেননি। না বলা অবশ্য কোন দোষের নয়; কারণ রাজনীতিবিদরা অনেক কিছু তাঁদের নীতিনির্ধারণী ফোরামে আলোচনা করেন। সেখানে সিদ্ধান্ত নেন। তবে এখনও পর্যন্ত এদের নিয়ে কোন কাজ কিন্তু দেশের মানুষ বা সচেতন সমাজ দেখতে পাননি। লেখার শুরুতে বলেছি, সৈয়দ আশরাফের মতো ওবায়দুল কাদেরও আরেকটি দুঃসময়ে আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব পেয়েছেন। সৈয়দ আশরাফ অবশ্য পেয়েছিলেন ভারপ্রাপ্ত হিসেবে। ১/১১ সৈয়দ আশরাফ যখন দায়িত্ব পান তখন দেশের অবস্থা ছিল এমনই, যদি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না আসে তাহলে দেশ আর স্বাধীনতার ধারায় ফেরে না। দেশকে স্বাধীনতার ধারায় ফেরানোর জন্য একটি নির্বাচন ও সে নির্বাচনটির ফল যাতে প্রায় গণভোটের মতোই হয় সে কাজটি করা। শেখ হাসিনার ৯৮ ভাগ নেতৃত্বে বাকি দুইভাগ হিসেবে সৈয়দ আশরাফ তাঁর দুই ভাগ সেদিন যথাপালন করেছিলেন। তাঁর অন্যতম বড় কাজ ছিল নাগরিক মধ্যবিত্তের কাছে আওয়ামী লীগের প্রয়োজনীয়তা ও শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরা। তিনি তা সঠিকই করেছিলেন। ওবায়দুল কাদেরের সামনে এখন ২০১৯ এর নির্বাচন। কেউ কেউ বলছেন, এই নির্বাচন ২০১৮ এর ডিসেম্বরে হবে। তবে আইনগতভাবে এ নির্বাচন আওয়ামী লীগ ২০১৯ এর মার্চের শেষ সপ্তাহের মধ্যে অনুষ্ঠিত করতে পারবে। ২০১৯ এর এই নির্বাচনেও কিন্তু ‘দুই ভাগ’ হওয়া সত্ত্বেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ওবায়দুল কাদেরকে গণভোটের মতোই একটি রায় আনতে হবে। কারণ ২০১৯ এ যদি গণভোটের মতো রায় আওয়ামী লীগ ও তাঁর জোট না আনতে পারে তাহলে আবার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হুমকির মুখে পড়বে। দেশে জঙ্গী ও গণহত্যা বাড়বে। এখন প্রশ্ন হলো, সৈয়দ আশরাফের তো দুই ভাগ শক্তি চিহ্নিত ছিল অর্থাৎ তিনি ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের রক্তস্রোত ধারার অংশ। ওবায়দুল কাদেরের চিহ্নিত অংশ কী? ওবায়দুল কাদেরের চিহ্নিত অংশও কিন্তু ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের রক্তধারায় গড়ে ওঠা। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর রক্তে শপথ নিয়ে দেশব্যাপী একটি তরুণ ও কিশোর প্রজন্ম আত্মত্যাগে এগিয়ে এসেছিল। সেই তরুণ ছাত্র সমাজের অন্যতম নেতা ছিলেন ওবায়দুল কাদের। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের রক্ত ছোঁয়া শপথে বাঙালীর কিন্তু ষাটের দশকের মতো আরেকটি প্রজন্ম গড়ে ওঠে। বাঙালীর ষাটের দশকের প্রজন্মটিকে হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো সমুদ্রে বিসর্জন দিয়েছেন সিরাজুল আলম খান আর ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের প্রজন্মটির একটি অংশকে বুড়িগঙ্গায় বিসর্জন দেন আবদুর রাজ্জাক। তিনি বুড়িগঙ্গায় বিসর্জন দেন বলে সবাই ডুবে মারা যাননি। অনেকেই সাঁতরে কূলে ওঠেন। অন্যদিকে ’৭২ এ সিরাজুল আলম খানের দৃষ্টান্ত সামনে থাকায় ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের রক্ত স্রোতধারার এ প্রজন্মের সকলে ভুল করেননি। তাঁরা দ্রুতই আবদুর রাজ্জাকের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে শেখ হাসিনার ধারায় অর্থাৎ ১৫ আগস্টের রক্তধারায় ফিরে আসেন। দেশব্যাপী শুধু রাজনীতি নয়, নানান পেশায় এখন ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের এই রক্তধারায় গড়ে ওঠা শ্রেণী অবস্থান করছে। এদের সকলের বয়স ৫৫ থেকে ৬০। অর্থাৎ সমাজের নানান স্থানে এরা প্রতিষ্ঠিত। যেহেতু, বঙ্গবন্ধুর রক্ত শপথে গড়ে ওঠা শ্রেণী- তাই এরা তুলনামূলক সৎ ও সাহসী। যে কারণে যে যেখানেই থাকুন না কেন, সকলেরই মানুষের মাঝে একটা গ্রহণযোগ্যতা আছে। ওবায়দুল কাদের তাঁর অন্য সব রাজনৈতিক কাজের সঙ্গে যদি কেবল রাজনীতিসহ সকল পেশায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই প্রজন্মকে এক করতে পারেন, তাহলে তিনি যতই দুই ভাগ মাত্র হোন না কেন, লঙ্কা বিজয়ে সমুদ্র পাড়ি দেয়া হনুমানের মতো তাঁর দেহ বিশাল হয়ে উঠবে। তখন তিনি অতি সহজে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০১৯ এর নির্বাচন নামক পর্বত মাথায় করে শেখ হাসিনার সামনে নিয়ে আসতে পারবেন। এই ’৭৫ এর প্রজন্মের হাত ধরেই কিন্তু এসেছে ’৯০ এর প্রজন্ম। তাই তাদেরও যোগসূত্র রয়ে গেছে ’৭৫ এর প্রজন্মের সঙ্গে। তারাও ২০১৯ এর যুদ্ধের বিশাল বাহিনী। এই ’৭৫ ও ৯০ এর প্রজন্ম বাঙালী সংস্কৃতিতেও উজ্জীবিত একটি শ্রেণী। এদের প্রাণ থেকে বাঙালী সংস্কৃতিকে আলাদা করা যাবে না। এরা জেগে উঠলে আওয়ামী লীগ ও বাঙালী সংস্কৃতি বলিষ্ঠ হবে। সংস্কৃতি সূর্যের মতো; সংস্কৃতি জেগে উঠলেই অন্ধকার কেটে যায়। নিজেকে মাত্র দুই ভাগ বললেও অন্ধকার কাটানোর এ বড় দায় ওবায়দুল কাদেরের স্কন্ধে। বাংলাদেশের মাটি কিন্তু সব সময়ই আলো চায়, বীজ চায়, চায় প্রস্ফুটিত পাতা ও ফুল। [email protected]
×