ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কানাডা প্রবাসী সাবেক তারকা ফুটবলার রিজভি করিম রুমি;###;জাহিদ রহমান

জীবনে যা কিছু অর্জন সবই ফুটবলের কল্যাণে

প্রকাশিত: ০৬:৩২, ৮ মার্চ ২০১৭

জীবনে যা কিছু অর্জন সবই ফুটবলের কল্যাণে

বাংলাদেশের ফুটবলে ‘রুমি’ নামটা এখনও ভীষণ উজ্জ্বল ও মুগ্ধময় হয়ে আছে। ফুটবলবিষয়ক আলোচনায় এ নামটি অনিবার্যভাবেই উঠে আসে। নতুন প্রজন্মের কাছে খানিকটা অজানা হলেও পুরনো ফুটবলমোদীদের কাছ থেকে এ নামটি হারিয়ে বা ক্ষয়ে যায়নি। ফুটবলের সোনালি সময়ের শেষবেলা পর্যন্ত যারা অন্যরকম আলো ছড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন রুমি তাদেরই একজন। ‘আবাহনীর রুমি’ হিসেবেই ট্রেডমার্ক হয়ে উঠেছিলেন। এখনও ওই নামেই ট্রেডমার্ক। ফুটবল জীবনের দীর্ঘসময় ছিলেন আবাহনীতে। আবাহনীতে খেলেছেন সামর্থ্য দিয়ে। আবাহনীর অনেক ম্যাচেই জয় এসেছিল তার পা থেকেই। সর্বশেষ আবাহনীর জার্সি পরেই নিঃশব্দে বিদায় নেন ফুটবল থেকে। মনে থাকার কথা, আশির দশকের শেষ ভাগ আর নব্বই দশকের বড় অংশজুড়ে রুমি নিজস্ব ফুটবলশৈলী দিয়ে ফুটবলমোদীদের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ঘাড়ের ওপর চুল ঝাঁকিয়ে খেলতেন নিজস্ব স্টাইলে। ড্রিবলিং আর ছোট পাসে চমৎকার খেলতেন। ওই সময়ে ঢাকার উত্তেজনাময় ফুটবল লীগে তারুণ্যময় আবাহনীর অনেক জয়েই ছিল তার অবদান। তার খেলায় একটু আলাদা বিশেষত্ব ছিল। চমৎকার ড্রিবলিং করতে পারতেন। লাইন ধরে বল নিয়ে প্রতিপক্ষের গোল মুখে আছড়ে পরাটাও ভালো করে জানতেন। সবচেয়ে বড় কথা রুমির খেলায় ছিল অন্যরকম এক আর্ট। ড্রিবলিং, বডি ল্যাংগুয়েজ সবখানেই বিশেষত্ব ছিল। বিশেষত্ব ছিল মাঠের বাইরে তার চলাফেরা, আচার-আচারণেও। মাঠে কখনই সামান্য উত্তেজিত হতেন না। এসব কারণেই সবার মাঝে তার গ্রহণযোগ্যতা আর প্রিয়তা ছিল ঢের। আশির দশকে ফুটবলে অমলেশ, নান্নু, সালাহউদ্দিন, মঞ্জু, চুন্নু, বাদল, সালাম, টুটুল যুগের পরে বাবুল, আশীষ, গাফফার, আসলাম, জনির ধারাবাহিকতায় ওয়াসিম, কায়সার হামিদ, মোনেম মুন্না, সাব্বির, এমিলি যখন নতুন আলো ছড়াতে শুরু করেছেন তখন রুমির আগমন ঘটেছিল খুলনা থেকে। খুলনা লীগে সোনালী জুট মিলের স্ট্রাইকার হিসেবে অভিযেক ঘটে তার। এরপর ঢাকাতে আনুষ্ঠানিকভাবে রুমি ফুটবল ক্যারিয়ারটা শুরু করেছিলেন ৮৪ সালে। সাধারণ বীমা ক্লাবে প্রথম নাম লেখান। এরপর অবশ্য চলে আসেন বিআরটিসিতে। বিআরটিসি ক্লাবের হয়ে কৃষœা, মঞ্জুদের সতীর্থ হয়ে চমৎকার খেলেন। সেই ধারাবাহিকতায় ৮৮ সালের রুমির স্বপ্নের দ্বার খুলে যায়। আবাহনীর মতো ক্লাবে খেলার স্বপ্নময় সুযোগ পান। সে সময় আবাহনী বা মোহামেডানে খেলার সুযোগ পাওয়া মানেই সুপারস্টার হয়ে যাওয়া। রুমির জীবনেও ঘটলো তাই। প্রথম প্রথম ম্যাচ খেলার সুযোগ না পেলেও পরবর্তীতে রুমি অপূর্ব ফুটবলশৈলী প্রদর্শন করে দর্শকনন্দিত হন। জাতীয় দলেও ঠাঁই করে নেন। ৯৪ সালে আবাহনী ক্লাবে একবার অধিনায়কত্ব করেন। মাঝে দু’বছর খেলেন মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া সংসদে। বাফুফের করা নিয়মকে উপেক্ষা করে বিদ্রোহী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন তনিও। জাতীয় দলের হয়ে খেলাটাও ছিল রুমির জন্য মেঘ না চাইতে বৃষ্টির মতো। আর তাই ’৮৮ সালেই ডাক পেয়ে যান। ’৮৮ সালে এশিয়ান কাপ বাছাই পর্ব খেলার সুযোগ পান। এরপর থেকে তাকে আর ভাগ্যবঞ্চিত হতে হয়নি। ’৯৪ সাল পর্যন্ত টানা খেলেছেন। সর্বশেষ আবাহনীতেই ছিলেন। ’৯৮ সালে আবাহনী ক্লাব থেকেই অনেকটা নীরবেই ফুটবলকে বিদায় জানান তিনি। তবে সে বিদায় আনুষ্ঠানিকভাবে নিতে পারেননি, ফলে সেটা এখনও অসমাপ্ত থেকে গেছে। ফুটবল থেকে কোন অভিমান নয়, এমনিতেই সবার অলক্ষ্যে সরে দাঁড়ান রুমি। পাড়ি জমান কানাডাতে। ঢাকার মাঠের সেই দর্শকপ্রিয় রুমি দীর্ঘদিন ধরেই কানাডার টরন্টোতে বসবাস করেন। ওখানেই স্থায়ী হয়েছেন। স্ত্রী শিমু আর একমাত্র ছেলেকে নিয়ে থাকেন। নব্বই দশকের শেষলগ্নে যখন দেখেন ফুটবল ক্রমশই হারিয়ে যাচ্ছে তখনই কানাডা যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। ভিসাও পেয়ে যান দ্রুত। এরপর প্রিয় স্বদেশ আর ঢাকার সবচেয়ে প্রিয় মাঠ রেখে চলে যান টরন্টোতে। ওখানেই এখন বসতি। ওখানেই আছেন। কদিন আগে দেশে এসেছিলেন শ^শুরের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে। রুমি ফিরেও গেছেন কানাডাতে। দেশে এলে রুমি স্মৃতিকাতর না হয়ে পারেন না। দু’বছর পর এবারও দেশে এসে হাজারো কাজের ভিড়ে স্মৃতি হাতড়িয়েছেন। খুঁজে ফিরেছেন ফুটবল মাঠের বন্ধু, কোচ, সাংবাদিকসহ অন্যদের। অনেকের সঙ্গেই দেখা করেছেন কথা বলেছেন। তবে সবকিছুর মধ্যেই অনুসন্ধান করেছেন ফুটবলের পেছনের যাত্রায়। যে ফুটবল তাকে ঐশ্বর্যম-িত করেছে সেই ফুটবল তার বাহারি রং হারিয়ে ফেলায় বেদনাবিদ্ধ না হযে পারেনি। ফুটবলের অবনমনে অন্যদের মতো রুমিও ভীষণ রকম হতাশা প্রকাশ করেছেন। নিজে বুঝতে পারেন না কেন এমনটি হয়েছে। তবে বিগত দিনের কিছু অযাচিত সিদ্ধান্তকে তিনি ফুটবলের অবনমনের উৎস-অনুষঙ্গ হিসেবে মনে করেন। রুমির মতে, জেন্টেলম্যান এগ্রিমেন্ট এবং ওয়ান প্লেয়ার ওয়ান লীগ ফুটবলের ক্ষতির বড় কারণ। এ বিষয়ে আরও অনেক আগেই নজর দেয়া উচিত ছিল। ফুটবল ম্যানেজমেন্ট যদি এগুলো সুবিবেচনায় নিয়ে আসত তাহলে হয়ত এমন দশা হতো না। তবে রুমি মনে করেন, এখানেই শেষ নয়। যারা আছেন, যারা হাল ধরেছেন বৈশ্বিক নিরিখে তাদের কর্মপরিকল্পনা সাজাতে হবে। কেননা স্যাটেলাইটের এই যুগে ঘরে বসেই সব ধরনের চিত্তকর্ষকময় ম্যাচ দেখা সম্ভব। স্বভাবতই সেই নিরিখে ফুটবলের উন্নয়নটা ঘটাতে হবে। রুমি ফুটবল নিয়ে হতাশ হলেও আশাবাদীও। বলেন, ‘ফুটবল জনমানুষের খেলা। সবার প্রাণের খেলা। এবার বাড়িতে এসে মাগুরাতে অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু কাপেও সে প্রমাণ পেলাম। মাগুরায় অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু কাপের ফাইনাল দেখতে গিয়েছিলাম। স্টেডিয়ামে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। এটি প্রমাণ করে ফুটবল হৃদয়ে আছে।’ রুমি খুলনার বাড়িতে আসার পর যখন শুনতে পান ৫ মার্চ মাগুরাতে বঙ্গবন্ধু কাপ ফুটবলের ফাইনাল হবে। সাবেক তারকা ফুটবলার সাথীর সঙ্গে রুমিও মাগুরাতে আসেন। ওখানেই বাফুফের সভাপতি, নুমির একসময়ের কোচ কাজী সালাহউদ্দিন, বাদল রায়, শফিকুল ইসলাম মানিকসহ পুরনোদের অনেককেই তিনি খুঁজে পান। ফুটবলের শত স্মৃতি রুমির এখনও নিরন্তর আনন্দের উৎস। একই সঙ্গে সতীর্থ যারা চলে গেছেন তাদের জন্য তার মনটা ভীষণ কেঁদে ওঠে। তার প্রিয় ফুটবলার মুন্না, অগ্রজ পুশকিন আর হকির সেরা সাবেক তারকা জুম্মন লুসাই-এর চলে যাওয়াটা তাকে কাঁদায়। সবার মৃত্যু সংবাদই পেয়েছিলেন কানাডা বসেই। ভীষণ মন খারাপ হয়েছিল তার। মোনেম মুন্নার কথা একদম ভুলতে পারেন না। মুন্নার সঙ্গে তার অসংখ্য স্মৃতি। মাঠে এবং মাঠের বাইরে মোনেম মুন্না ছিলেন তার অভিভাবকের মতো। আর আবাহনী ক্লাবে এক রুমেই থেকেছেন তারা দীর্ঘদিন। রুমি বলেন, ‘ক্লাবে, মাঠে মুন্না ভাই সবসময়ই বড় অভিভাবক। সবসময়ই আগলে রাখতেন সতীর্থদের। মুন্না ভাই-এর লিডারশিপ ছিল অন্যরকম। চমৎকার নেতৃত্ব দিতে পারতেন। সাহস ছিল প্রচুর। আর তাই সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে দলকে জেতানোর জন্য যা যা করার দরকার তা সবাইকে নিয়ে করতেন। মাঠে মুন্না ভাই সামনে থাকলে কোন টেনশন লাগতো না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের খেলার সময়ে ক্লাব সমর্থকদের মারাত্মক চাপ থাকত। টিম হারলে অনেক অঘটন ঘটে যেত। মুন্না ভাই একাই সব সামাল দিতেন।’ ফুটবল অধ্যায়ের প্রসঙ্গে টানলে রুমি বলেন, ‘জীবনে যা কিছু অর্জন সেটা হয়েছিল ফুটবলের কারণেই। কতো যে মানুষের ভালবাসা পেয়েছি। ফুটবলার রুমির বাইরে আর কোন পরিচয় নেই। একসময় আমাদের একটু খানিক দেখার জন্য কতো যে ফ্যান আবাহনীর গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থেকেছে। সেই দৃশ্য এখন অকল্পনীয়।’ সবশেষে রুমি বলেন, ‘ক্ষোভ আর আক্ষেপ যায় করি ফুটবলস্বরূপে উদ্ভাসিত হোক এই কামনা করি। সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় ফুটবলে ফিরে আসুক সেই রঙিন দিন। ফুটবল এখনও এ দেশের মানুষের কাছে সবচেয়ে প্রিয় খেলা।’
×