ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রামপালের পর এবার মাতারবাড়ি নিয়ে ষড়যন্ত্র

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ৮ মার্চ ২০১৭

রামপালের পর এবার মাতারবাড়ি নিয়ে ষড়যন্ত্র

রশিদ মামুন ॥ রামপালের পর এবার মাতারবাড়ী বিদ্যুত প্রকল্প নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে একটি পক্ষ। বিদ্যুত প্রকল্পটির কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করতে সরকারবিরোধী একটি পক্ষ উঠেপড়ে লেগেছে। দরপত্র জমা দেয়া জাপানের একটি কোম্পানির পক্ষে নেতিবাচক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যুত বিভাগের সব থেকে বড় প্রকল্পের কাজ আটকে দিতেই নতুন ষড়যন্ত্র শুরু করা হয়েছে। কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির কাছে জাইকা নেতিবাচক প্রচারণার বিষয়টি জানতেও চেয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির এক কর্মকর্তা জানান, জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) আমাদের কাছে নেতিবাচক খবর প্রচারের বিষয়ে জানতে চেয়েছে। তারা বলছে, তোমাদের দেশের পত্রপত্রিকা একটি কোম্পানির বিষয়ে কেন নেতিবাচক প্রচারণা চালাচ্ছে। আমরা তাদের বলেছি, নেতিবাচক খবর তো আমরা প্রচার করছি না। তোমাদের দেশেরই দুটি কোম্পানি দরপত্র জমা দিয়েছে। তারাই একজনের বিরুদ্ধে অপরজন প্রচারণা চালাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কিছু করার নেই। তাদেরই এ বিষয়টি দেখতে বলেছি আমরা। প্রসঙ্গত, জাইকার অর্থায়নে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করছে সরকারী কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি। এটিই কয়লাচালিত একমাত্র বৃহৎ বিদ্যুত কেন্দ্র যার শতভাগ মালিকানা বাংলাদেশের। জাইকার অর্থায়নে হওয়ায় এর নির্মাণ ঠিকাদার জাপান থেকেই নিতে হবে। হলি আর্টিজানে হামলার পর জাইকার অর্থায়নে মাতারবাড়ী বিদ্যুত প্রকল্পটির দরপত্র জমা দেয়ার সময় কয়েক দফা বৃদ্ধি করা হয়। সরকারের সফল কূটনৈতিক তৎপরতায় জাইকা এই প্রকল্পের পক্ষেই ছিল সব সময়। জাইকা শুধু এই প্রকল্পই নয় দেশের আরও একটি বড় প্রকল্প মেট্রোরেলেও অর্থায়ন করছে। ফলে কোন একটি জায়গা থেকে জাইকাকে হটাতে পারলে দুটি প্রকল্পের সম্ভাবনা নষ্ট হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, দুটি প্রকল্পের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করতে এই প্রক্রিয়া শুরু করেছে এই পক্ষটি। মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, নেতিবাচক প্রচারণার পেছনে কে বা কারা রয়েছে সে বিষয়ে আমাদের কাছে কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে এ ধরনের কার্যক্রম দেশের জন্য শুভ নয়। তিনি বলেন, সরকার চাইছে মহেশখালীকে সিঙ্গাপুরের আদলে গড়ে তুলতে। ভবিষ্যত বাংলাদেশের এ্যানার্জি হাব হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে দ্বীপটিকে। এখানে শুধু একটি বিদ্যুত কেন্দ্র নয়, ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্রের জন্য কয়লা খালাস করতে পারে এমন একটি বন্দর নির্মাণ করা হবে। এই বন্দরটির কাজ শেষ হলে দেশের কয়লা আমদানির প্রতিবন্ধকতাও কেটে যাবে। সঙ্গত কারণে যে বা যারা এই বিদ্যুত কেন্দ্রটির বিষয়ে নেতিবাচক প্রচারণা চালাচ্ছে তারা শুধু একটি বিদ্যুত কেন্দ্রের নয়, ভবিষ্যত বাংলাদেশের বড় রকমের ক্ষতি মিশন নিয়ে কাজ করছে। জানতে চাইলে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী আবুল কাশেম জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা নেতিবাচক প্রচারণার বিষয়টি দেখেছি। কিন্তু একটি কোম্পানিকে পরিমাপ করার আন্তর্জাতিক মানদ- হচ্ছে তার সম্পদ এবং লেনদেন (টার্নওভার)। যে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানো হচ্ছে তাদের প্রচুর সম্পদ রয়েছে এবং তাদের টার্নওভারও যথেষ্ট ভাল। এ রকম একটি বড় কোম্পানি এক বা দুই বছর লোকসান করলেই তাকে আর কেউ দেউলিয়া বলে তকমা দিতে পারে না। সব কাজ শেষে দরপত্র আহ্বানের পর গত বছর ২৬ জুলাই জমা দেয়ার শেষ দিন নির্ধারিত ছিল। এর মধ্যে ১ জুলাই গুলশানে হলি আর্টিজান ট্র্যাজেডির ঘটনা সকলকে নাড়া দেয়। এখানে জাইকার মেট্রোরেল প্রকল্পে কয়েকজন কর্মকর্তা নিহত হন। বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর অবস্থান নেয়। বাংলাদেশ এবং জাপানের পক্ষ থেকে এই সন্ত্রাসী হামলার পরও দুই দেশের সম্পর্ক অটুট থাকবে বলে উল্লেখ করা হয়। জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে সন্ত্রাস প্রতিরোধে বাংলাদেশকে সহায়তা দেয়ারও প্রতিশ্রুতি দেন। জাইকাও বাংলাদেশের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেয়। তবে এই পরিস্থিতিতে জাপানি কোম্পানি দরপত্র জমা দেয়ার জন্য দুই দফায় সময় চেয়ে আবেদন করে। কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি কেন্দ্রটির দরপত্র জমা দেয়ার সময় গত ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বৃদ্ধি করে। ওইদিনই জাপানের দুটি কোম্পানি দরপত্র জমা দেয়। এখন দরপত্র মূল্যায়ন চলছে। গুলশান হামলার পর জাপানের মাতারবাড়ী প্রকল্পটি নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। দেশের সব থেকে বড় বিদ্যুত অবকাঠামো নির্মাণ করার পরিকল্পনাও খানিকটা পিছিয়ে যায়। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে অনিশ্চয়তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টায় জোর দেয়া হয়। সর্বশেষ গত ৩১ জানুয়ারি দরপত্র জমা দেয়ার পর তাৎক্ষণিক একটি সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই ইলাহী চৌধুরী বীরবিক্রম বলেছিলেন, সরকার বিদেশীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করায় তাদের আস্থা ফিরেছে। বিদ্যুত বিভাগ সূত্র জানায়, জাইকার আর্থিক সহায়তায় টোকিও ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানি মাতারবাড়ী বিদ্যুত কেন্দ্রের সম্ভাব্যতা জরিপ পরিচালনা করে। সম্ভাব্যতা জরিপের ভিত্তিতে সরকার মাতারবাড়ী-মহেশখালীতে একটি আধুনিক শহর নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। একই সঙ্গে এখানে একটি ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্রের জন্য কোল হ্যান্ডেলিং টার্মিনাল নির্মাণ করা হচ্ছে। কয়লাচালিত বিদ্যুত কেন্দ্রের সব থেকে বেশি ব্যয়বহুল এই প্রকল্প ২৯ হাজার কোটি টাকা জাইকা ঋণ দিচ্ছে। পুরো প্রকল্পর জন্য ৩৬ হাজার কোটি টাকা দরকার হবে। বিদ্যুত কেন্দ্রটির জন্য ১ হাজার ৫০০ একর জমি অধিগ্রহণ করে উন্নয়ন করা হয়েছে। দরপত্র মূল্যায়নের পর কার্যাদেশ দিলে কেন্দ্র নির্মাণের কাজ শুরু হবে। পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা ইতোমধ্যে নেতিবাচক প্রচারণার বিষয়টি দেখেছি। দরপত্র মূল্যায়ন পর্যায়ে এ ধরনের প্রচারণা মূল্যায়নকারীদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। তিনি বলেন, আমরা মনে করছি, যারা রামপালের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা চালাচ্ছে তারাই মাতারবাড়ীর বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাচ্ছে। যাতে বিদ্যুত কেন্দ্রটির কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়। এ ধরনের কোন কিছু দেশের জন্য শুভ হয় না বলে মনে করেন তিনি।
×