ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আনসার আল ইসলাম নেতা জিয়াকে নিয়ে রহস্যের জট খুলছে না

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ৮ মার্চ ২০১৭

আনসার আল ইসলাম নেতা জিয়াকে নিয়ে রহস্যের জট খুলছে না

শংকর কুমার দে ॥ জঙ্গী সংগঠন আনসার আল ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে সরকার। কিন্তু আনসার আল ইসলামের নেতৃত্বদানকারী মেজর জিয়া কোথায়? আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নিষিদ্ধ করার পর তার জঠর থেকেই জন্ম নেয়া আনসার আল ইসলামের নেতৃত্বে মেজর জিয়া সরাসরি অন্তত ৯টি টার্গেট কিলিংয়ের সঙ্গে জড়িত বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি। এছাড়াও অন্তত ৩০টি টার্গেট কিলিং তার পরিকল্পনায় হয়েছে। ২০১৩-১৫ সালের মধ্যে পাঁচজন ব্লগার, একজন প্রকাশক ও সমকামীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা দুজনকে হত্যা করেছে এবিটি। এসব ঘটনার তদন্ত শেষে মূল পরিকল্পনাকারী ও নির্দেশদাতা হিসেবে উঠে আসে মেজর জিয়ার নাম। এ খবর তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, প্রগতিশীল লেখক, প্রকাশক, ব্লগার হত্যাকা-ের নেতৃত্ব দিয়ে আসা জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের আমির জসীমউদ্দিন রাহমানীকে কারারুদ্ধ করার পর তার শূন্য স্থান পূরণ করে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে মেজর জিয়া। সেনাবাহিনী থেকে পলাতক চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়াকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে সরকার। কিন্তু মেজর জিয়া কি আটক, গোয়েন্দা নজরদারিতে নাকি পলাতক তা নিয়ে রহস্য ঘনীভূত হয়েছে। গুলশান ও শোলাকিয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা এবং বিভিন্ন হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত জঙ্গিদের অন্যতম নেতা সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত মেজর জিয়া কোথায় আছে তা না জানালেও, সে নাকি ধরা পড়বে, গোয়েন্দা নজরদারিতে আছে, ইতোমধ্যেই এমন সব কথা বলেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উর্ধতন কর্মকর্তারা। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান চেষ্টার পরিকল্পনাকারীদের মূল হোতা এই চাকরিচ্যুত মেজর জিয়া। জিয়ার পুরো নাম সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক। পলাতক থেকে দেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ বিস্তারে অন্যতম পরিকল্পনাকারী হিসেবে কাজ করছে সে। রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে টার্গেট কিলিংয়ে জড়িত গ্রেফতারকৃত কয়েক জঙ্গীর দেয়া তথ্যে প্রথমে উঠে আসে জিয়ার নাম। এসব জঙ্গীর মোবাইল ফোনের কল রেকর্ড, ই-মেইল এ্যাকাউন্ট, ফেসবুক ও টুইটার এ্যাকাউন্ট পর্যালোচনা করেও অনেক তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে তার জড়িত থাকার বিষয়টি। নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) একাংশ নব্য জেএমবির সঙ্গেও চাকরিচ্যুত মেজর জিয়ার যোগাযোগ রয়েছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি। গোয়েন্দা সূত্র জানান, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) আধ্যাত্মিক নেতা জসীমুদ্দিন রাহমানীকে গ্রেফতারের পর সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর জিয়াউল হক ওরফে জিয়া এবিটির শীর্ষ সংগঠকের দায়িত্বে আসে বলে গোয়েন্দারা জানতে পারেন। ব্লগার, মুক্তমনা লেখক ও প্রকাশকসহ অন্তত ৯ জনকে টার্গেট কিলিংয়ের নেপথ্যে মূল হোতা ছিল এই জিয়া। এছাড়া আরও কয়েকজনকে হত্যাচেষ্টার পরিকল্পনার সঙ্গেও সে যুক্ত ছিল। তার সঙ্গে আশপাশের দেশের কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থারও যোগাযোগ রয়েছে বলে গোয়েন্দারা ধারণা করছে। দেশকে অস্থিতিশীল করার পাশাপাশি সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে গুপ্তহত্যাসহ নানা পরিকল্পনার নেপথ্য নায়ক সে। তার নির্দেশ ও তত্ত্বাবধানে গত তিন বছরে এবিটির অন্তত আটটি সিøপার সেল তৈরি হয়েছে। এসব সিøপার সেলের সদস্য রয়েছে চার থেকে পাঁচজন। অর্থাৎ প্রায় ৩০ জন দুর্ধর্ষ গুপ্তঘাতক তৈরি করেছে জিয়া। আর এসব গুপ্তঘাতকই ব্লগার, মুক্তমনা লেখক ও প্রকাশকদের হত্যা ও হত্যাচেষ্টা করেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, জঙ্গি হামলার মাস্টারমাইন্ড জিয়া কোথায়? তার সহযোগী শরীফ ওরফে হাদী, সেলিম, সিফাত, রাজু, সিহাব ও সাজ্জাদ। এদের মধ্যে এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তাদের মধ্যে আবদুস সবুর ওরফে রাজুকে ও মইনুল ইসলাম শামীমকে জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যা ও আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল হত্যাচেষ্টায় গ্রেফতার দেখিয়েছে পুলিশ। এর আগে গত জুলাই মাসে খিলগাঁওয়ে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন ৫ লাখ টাকা পুরস্কারের এবিটির জঙ্গী শরীফ ওরফে হাদী। অপরদিকে জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ সামরিক শাখার প্রধান চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়াকে ধরিয়ে দিতে ২ আগস্ট ২০ লাখ টাকা করে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, দেশে এ পর্যন্ত যত ব্লগার হত্যার ঘটনা ঘটেছে, তার সবকটিই হয়েছে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন এবিটি নেতা চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হকের নির্দেশে। গ্রেফতার এবিটি সদস্যদের জবানবন্দীর বরাত দিয়ে এ কথা জানান এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা। মোস্ট ওয়ান্টেড জিয়ার অবস্থান সম্পর্কে কিছু জানাতে পারেননি তিনি। তবে তাকে খোঁজা হচ্ছে বলে জানান তিনি। প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন ও ব্লগার নিলয় নীল হত্যার সঙ্গে জড়িত আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নেতা খায়রুলকে গ্রেফতার করার রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। একুশে বইমেলায় প্রকাশ্যে লেখক ব্লগার প্রকৌশলী ড. অভিজিৎ রায়কে নৃশংসভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশজুড়ে শুরু হয় মুক্তমনাদের সিরিজ টার্গেট কিলিং। কলাবাগানে জুলহাস মান্নানকে ও তার বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব রাব্বী তনয়কে। মাঝখানে ওয়াশিকুর রহমান বাবু, নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নীলয়, সিলেটে অনন্ত বিজয়, পুরান ঢাকায় জবি ছাত্র নাজিমউদ্দিন সামাদ ও শাহবাগে প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে একই কায়দায় চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা আনসার আল ইসলামের (এবিটি) সিøপার সেলের দুর্ধর্ষ জঙ্গিরা জড়িত বলে জোর দিয়ে একাধিকবার জানিয়েছেন বলে জানান গোয়েন্দা কর্মকর্তা। পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা বলেন, খায়রুল নামে এবিটির এক জঙ্গী পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে, ২০১৩ সালে ‘বড় ভাই’ মেজর জিয়ার সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তার মাধ্যমেই সে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমে যোগ দেয়। ২০১৪ সাল থেকে সংগঠনের তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করে আসছিল সে। ইন্টারনেটে নজরদারি করত। তথ্য বিশ্লেষণ করতেন। সম্ভাব্য টার্গেটের বিষয়ে বড় ভাইকে তথ্য জানাতো। এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ‘টার্গেট’ ঠিক করত বড় ভাই। পরে টার্গেটের বিষয়ে আরও তথ্য সংগ্রহ করা হতো। বড় ভাইকে তা জানানো হতো। প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন ও ব্লগার নিলয় নীল হত্যার সঙ্গে জড়িত আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নেতা খায়রুলকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে খায়রুল জানায়, চাকরিচ্যুত মেজর জিয়ার নির্দেশেই দীপন ও নিলয়কে হত্যা করা হয়। ব্লগার হত্যার প্রতিটি ঘটনাই জিয়ার নির্দেশে হয়েছে। হত্যাসংক্রান্ত বিভিন্ন দায়িত্ব সদস্যদের মধ্যে সেই ভাগ করে দিত।
×