ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

শীর্ষ জঙ্গী রাজীব গান্ধীর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী

এক যুগ পর সাংবাদিক দীপংকর চক্রবর্তী হত্যা রহস্য উন্মোচন

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ৮ মার্চ ২০১৭

এক যুগ পর সাংবাদিক দীপংকর চক্রবর্তী হত্যা রহস্য উন্মোচন

স্টাফ রিপোর্টার, বগুড়া অফিস ॥ দীর্ঘ এক যুগ পর বগুড়ার প্রবীণ সাংবাদিক বগুড়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক দুর্জয় বাংলার নির্বাহী সম্পাদক দীপংকর চক্রবর্তী হত্যাকা-ের রহস্য উন্মোচন হয়েছে। নিষিদ্ধ ঘোষিত জেএমবি’র নির্দেশে নৃশংস ওই হত্যাকা- ঘটেছিল বলে পুলিশ জানিয়েছে। হলি আর্টিজান মামলায় গ্রেফতার হওয়া ও বগুড়া পুলিশের হাতে রিমান্ডে থাকা জঙ্গী রাজীবগান্ধী ওরফে জাহাঙ্গীর ওরফে আদিল (৩৫) সাংবাদিক কিলিং মিশনে সরাসরি জড়িত থাকার বিষয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে বলে পুলিশ জানায়। সোমবার সে বগুড়া জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়ার পর বগুড়ার পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামান মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে রাজীবগান্ধীর স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে হত্যাকা-ের বর্ণনা ও জড়িতদের নাম উল্লেখ করে জানান, জেএমবি’র ৪ জনের একটি কিলিং স্কোয়াড এই হত্যাকা- ঘটিয়েছিল। এরা হলো- রাজীবগান্ধী, নুরুল্লাহ, সানাউল্লাহ ও মানিক। এর মধ্যে মানিক গত বছরের অক্টোবরে ঢাকার সাভারে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর এক অভিযানে নিহত হয়েছে। অন্যদের বিষয়েও পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। দীপংকর চক্রবর্তী বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি ছিলেন। বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের সময় ২০০৪ সালের ২ অক্টোবর রাতে দীপংকর চক্রবর্তী খুন হন। ঘটনার সময় তিনি দৈনিক দুর্জয় বাংলা অফিস থেকে কাজ শেষে বাড়ি ফিরছিলেন। বগুড়ার শেরপুর উপজেলার স্যান্নালপাড়ায় নিজ বাড়ির সামনে গলায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে নৃশংসভাবে তাকে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকা-টি দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং সাংবাদিকরা তার পর থেকেই হত্যার রহস্য উন্মোচন ও হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে গ্রেফতারের দাবি জানিয়ে আসছিল। বছরের পর বছর মামলাটি তদন্ত, পুনর্তদন্ত ও চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিলের চক্রের মাঝে ঘুরে ফিরছিল। দফায় দফায় মামলাটি থানা-পুলিশ থেকে সিআইডি ও ডিবি পুলিশ তদন্ত করে। তদন্তকারীরা ৪ দফা চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করলেও বাদীর নারাজি আবেদনের কারণে তা আদালতে গৃহীত হয়নি। সর্বশেষ দ্বিতীয় দফায় বগুড়ার ডিবি পুলিশ মামলাটি তদন্ত করেছিল। সংবাদ সন্মেলনে জানান হয়, জেএমবি সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি এবং বিভিন্ন মিটিং এ জেএমবি সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করায় জেএমবি তাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। সে সময়কার শূরা সদস্য ও বহুল আলোচিত সিদ্দিকুর রহমান ওরফে বাংলা ভাই এবং সংগঠনের উত্তরাঞ্চল শাখার সামরিক কমান্ডার আব্দুল আউয়াল দীপংকর চক্রবর্তীকে হত্যার নির্দেশ দেয়। হত্যার পরিকল্পনার পর শহরের একটি ছাত্রবাসে জেএমবির মিটিং হয়। সে অনুযায়ী ঘটনাস্থল রেকি করে আসার পর নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যাকা-ের পরিকল্পনাসহ পুরো ঘটনাটি তুলে ধরে পুলিশ সুপার জানান, হলি আর্টিজান হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী গ্রেফতার হওয়া রাজীবগান্ধী বগুড়ার শিবগঞ্জ ও শেরপুরের দুটি মামলায় রিমান্ডে থাকার সময় জিজ্ঞাসাবাদে এই চাঞ্চল্যকর মামলার রহস্য উন্মোচনের সূত্র বেরিয়ে আসে। এরপর পুলিশের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে সে হত্যকা-ের সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে। রাজীবগান্ধী ওরফে জাহাঙ্গীর ঢাকায় হলি আর্টিজান মামলায় প্রথমে গ্রেফতার হয়। ৬ ফেব্রুয়ারি তাকে বগুড়ার শেরপুরের একটি বিস্ফোরক মামলা ও শিবগঞ্জ উপজেলার নাশকতা চেষ্টা মামলায় বগুড়ার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে তদন্তকারী কর্মকর্তা রিমান্ডের আবেদন করে। আদালত প্রথম দফা ১৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। বর্তমানে সে বগুড়ায় চতুর্থ দফায় ৭ দিনের রিমান্ডে রয়েছে। পুলিশ জানায়, রাজীবগান্ধী ওরফে জাহাঙ্গীর ২০০১ সালে জেএমবি’তে যোগ দেয় এবং ২০০৪ সালে সারোয়ার জাহান ওরফে মানিক তাকে হিজরত করতে উদ্বুদ্ধ করে। এরপর সে গাইবান্ধা থেকে সিরাজগঞ্জে জেএমবি’র ডাঃ নজরুলের কাছে যায়। সেখানে ২ মাস থাকার পর বগুড়ায় শহরের জহুরুল নগরের ভাইবোন নামে একটি মেসে আসে। সেখানে নুরুল্লাহ, সানাউল্লাহসহ ১০-১২ জন জেএমবি সদস্য ছিল। একদিন পর আব্দুল আউয়াল সেখানে আসে এবং দীপংকর চক্রবর্তীকে হত্যা বিষয়ে আলোচনায় বলে বাংলা ভাই তাকে হত্যার নিদের্শ দিয়েছে। এরপর হত্যাকা-ের পরিকল্পনা ও কিলিং স্কোয়াড গঠন করে তাদের শেরপুরে ঘটনাস্থল রেকি করতে পাঠান হয়। রেকির পর একই মেসে বসে ঘটনার দিন বিকেলে চূড়ান্ত পরিকল্পনায় কে মোটরসাইকেল চালাবে, কার দায়িত্ব নজর রাখা এবং কে কোপ দিয়ে হত্যা করবে তা নির্ধারণ করা হয়। মিটিং শেষে মোটরসাইকেল ও ২টি চাপাতি তুলে দেয়া হয় কিলার গ্রুপের হাতে। এদের মধ্যে ৩ জন মোটরসাইকেলে ও রাজীবগান্ধী ওরফে জাহাঙ্গীর বাসে শেরপুরে যায়। রাত ১০টার দিকে তারা শেরপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় মিলিত হয় বলে জাহাঙ্গীর স্বীকারোক্তি দেয় বলে পুলিশ জানায়। রাত সোয়া ১২টার দিকে সাংবাদিক দীপংকর বাড়ি যাওয়ার সময় পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তাকে হত্যা করা হয়। পরে তারা ভাইবোন মেসে ফিরে আসে এবং পরের দিন এর প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য প্রেসক্লাবেও তারা নজর রাখে। এই হত্যাকা-ের পর রাজীবগান্ধীকে বগুড়ার দু’টি উপজেলার সাংগাঠনিক দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। পুলিশ সুপার জানিয়েছেন, হত্যাকা-ে অংশ নেয়া অন্যদের দ্রুত গ্রেফতারের প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে।
×