ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অর্থনীতির চাকা ঘোরাচ্ছে দেশের নারীরা

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ৮ মার্চ ২০১৭

অর্থনীতির চাকা ঘোরাচ্ছে দেশের নারীরা

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে নারীরা ঘরে-বাইরে সমানভাবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর। নারীরা বিগত একশ’ বছর ধরে পুরুষতান্ত্রিক বিশ্বে নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য আজও আন্দোলন করে যাচ্ছে। কীভাবে এই লড়াই করতে হয়, কীভাবে নারীর ক্ষমতায়ন করতে হয়, কীভাবে অধিকার নিশ্চিত করতে হয়- তা এখন বিশ্বকে শেখাচ্ছে বাংলাদেশ। রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সমাজের সর্বক্ষেত্রে নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে স্বাধীনতার ৪৬ বছরে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাংলাদেশ। রক্ষণশীল দেশে অনেক বাধা তবুও লড়াই করে এগিয়ে যাচ্ছেন নারীরা। দেশের প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পীকার, বিরোধীদলীয় নেত্রী, পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, সচিব, বৈমানিক, বিচারক, উদ্যোক্তা, সাংবাদিক, পুলিশ ও সেনাসদস্য, ক্রিকেটার ও ফুটবলার তো বটেই। বাংলাদেশের নারীর বিজয় পতাকা উড়েছে এভারেস্ট চূড়ায়ও। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে নারীর অংশগ্রহণের দিক দিয়ে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের প্রথম দশটি দেশের একটি। এই গৌরবময় সময় নিয়ে দেশ আজ পালন করবে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। প্রতিবছরের মতো এবারও সারাবিশ্বে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালিত হচ্ছে দিনটি। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও এই দিনটিকে ঘিরে বিভিন্ন কর্মসূচী পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও নারীরা সামাজিকভাবে বৈষম্যের শিকার ছিল। শিক্ষা, চাকরিতে অংশগ্রহণ তো বটেই, এমনকি নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীও ছিল নেতিবাচক। একে একে কেটে গেছে দীর্ঘ ৪৬ বছর। আজও নারীরা তাদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে এগিয়ে যাচ্ছে। নারীশিক্ষার কিংবদন্তী বেগম রোকেয়া যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন তা এখনও পুরোপুরিভাবে কার্যকর হয়নি। তবে তার দেখানো পথেই এগিয়ে যাচ্ছে বর্তমান প্রজন্ম। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম জনকণ্ঠকে বলেন, বেগম রোকেয়া বলেছিলেন, ‘ছেলেরা যা করতে পারে মেয়েরাও তা করতে পারে। আজ মেয়েরা তা করে দেখাচ্ছে। তবে এখানেই থেমে থাকবে না বাংলাদেশের নারী। নারীদের কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে, নির্যাতনে রুখে দাঁড়াতে হবে।’ শিক্ষাক্ষেত্রে নারীর অগ্রগতি ॥ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় মেয়ে শিশু ভর্তির হার ক্রমশ বাড়ছে। সরকারী তথ্যমতে, বাংলাদেশের প্রাথমিক পর্যায়ে বর্তমানে মেয়ে শিশু ভর্তির হার শতকরা ৯১ শতাংশ। আর ছেলে শিশুর ভর্তির হার ৮৭ দশমিক ৮ শতাংশ। বিগত কয়েক বছরের এসএসি ও এইচএসসির ফলাফলেও দেখা গেছে, সব কয়টি শিক্ষাবোর্ডেই মেয়ে শিক্ষার্থীরা ছেলেদের তুলনায় এগিয়ে রয়েছেন অথবা সমান ফলাফল করছেন। এমনকি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডেও ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা এগিয়ে আছে। সরকারীভাবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা বিনামূল্যে পাঠ্যবই পাচ্ছে। দরিদ্র পরিবারের ছাত্রছাত্রীরা উপবৃত্তি পাচ্ছে। মেয়েরা উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত বিনা বেতনে পড়তে পারছে। ডিগ্রীতে পড়ার ক্ষেত্রে সহায়তা কর্মসূচী চালু করা হয়েছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে লিঙ্গসমতা নিশ্চিত করার সকল কর্মপ্রচেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। উচ্চশিক্ষাতেও মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। বর্তমানে দেশের মোট ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার্থীর ৩০ শতাংশ নারী। বাংলাদেশ ইউনির্ভাসিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং এ্যান্ড টেকনোলজি (বুয়েট) এর পরিসংখ্যান মতে স্নাতক পর্যায়ে ৫২৮১ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৪ হাজার ১৫৯ জন পুরুষ এবং এক হাজার ১২২ জন নারী। স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ৫ হাজার ৪৫৪ জনের মধ্যে ৪ হাজার ৪৩১ জন পুরুষ ও এক হাজার ২৭ জন নারী। অর্থনীতির চাকা ঘোরাচ্ছে নারীরা ॥ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী দেশের প্রধান খাত পোশাকশিল্পে কমর্রতদের প্রায় ৭৫ শতাংশ নারী। প্রায় ২৫ লাখ নারী এ খাতে কর্মরত। এছাড়া, চা ও চামড়াশিল্পেও ব্যাপকভাবে কাজ করছে নারীরা। এদিকে বাংলাদেশে নারীদের গৃহস্থালির কাজের অর্থমূল্য হিসাব করা হয় না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত জরিপ অনুযায়ী, গৃহস্থালির কাজ করে কোন মজুরি পান না ৯১ লাখ নারী। শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে আট লাখ ৪৯ হাজার নারী দিনমজুর রয়েছেন। কিন্তু তারা পুরুষের সমান কাজ করেও মজুরি কম পান। অর্থনৈতিক শুমারি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে নারীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সর্বশেষ শুমারির সময় ২০১৩ সালে দেশে মোট প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মহিলা প্রধান প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা হয়েছে ৫ লাখ ৬৩ হাজার ৩৬৮টি, যা মোট আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৭ দশমিক ২১ শতাংশ। ২০০১ এবং ২০০৩ সালে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ১ লাখ ৩ হাজার ৮৫৮টি, যা মোট আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ২ দশমিক ৮০ শতাংশ। দেখা যাচ্ছে এক দশকে প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে পাঁচ গুণেরও বেশি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সরকারী চাকরিতে নারীর সংখ্যা বেড়েছে। ২০০৯ সালেও সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মোট দুই লাখ ২৩ হাজার ৬৪৪ নারী কর্মরত ছিলেন। এ সংখ্যা ২০১৪ সালে বেড়ে হয়েছে দুই লাখ ৮৮ হাজার ৮০৪ জন। এ হিসাবে দেখা যায়, মাত্র পাঁচ বছরেই সরকারী চাকরিতে ৬৫ হাজার ১৪০ জন নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে। এ বৃদ্ধির হার ২৯ দশমিক ১ শতাংশ। বেসরকারী ক্ষেত্রে শ্রমজীবী নারীর সংখ্যা ৮৬ লাখ থেকে বেড়ে হয়েছে এক কোটি ৭২ লাখ। এ বৃদ্ধি হয়েছে মূলত নারীর শিক্ষার হার বাড়ার পাশাপাশি পোশাকশিল্প ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে অধিক হারে নতুন নতুন চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার কারণে। চ্যালেঞ্জ নিয়ে সশস্ত্র বাহিনীতে নারীরা ॥ সেনা, বিমান ও সেনাবাহিনীতে নারী অফিসার নিয়োগ নারী উন্নয়নে এবং নারী জাগরণে এক নতুন মাইলফলক। নারী পুলিশ অফিসার ও সার্জেন্টসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়কেও আজ নারী ট্রাফিক পুলিশেরা পুরুষের পাশাপাশি চ্যালেঞ্জ নিয়ে একনিষ্ঠচিত্তে কাজ করে যাচ্ছে। এখন বিমানবাহিনীর প্যারাট্রুপারও রয়েছেন নারী। আর বিমানবাহিনীর জঙ্গী বিমানও উড়াচ্ছেন নারী পাইলট। গত বছর প্রথমবারের মতো সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবিতেও নিয়োগ হয়েছে নারী ব্যাটালিয়ন। রাজনৈতিক অঙ্গনেও এগিয়ে নারীরা ॥ রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ অনেক এগিয়ে গেলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে নারী এখনও সংগ্রাম করে যাচ্ছে। এবারের ইসি নির্বাচনে প্রথমবারের মতো কোন নারী প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে বিবেচিত হলো। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে মাইলফলক। রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সুপারিশ অনুযায়ী ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্বের বিষয়টিকে নীতিগতভাবে মেনে নিলেও ২০০৮ ও ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩৩ শতাংশ নারীকে মনোনয়ন দিতে ব্যর্থ হয়েছে দলগুলো। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বিশ্বের ১৪২ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০ম। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় রাজনীতিতে নারী-পুরুষ বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে নেতৃস্থানীয় ভূমিকার জন্য বাংলাদেশ ‘উইমেন ইন পার্লামেন্টস (ডব্লিউআইপি) গ্লোবাল এ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেছে। রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান নবম এবং নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে অষ্টম। নারীর ক্ষমতায়নে রোল মডেল বাংলাদেশ ॥ নারীর ক্ষমতায়নে রোল মডেল বাংলাদেশ। বর্তমান সরকার সর্বপ্রথম নারী স্পীকার, নারী ইসি নিয়োগ করেছে। জাতীয় সংসদে ২০ জন সরাসরি নির্বাচিত নারী সংসদ সদস্য রয়েছেন। জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসন ৪৫ থেকে ৫০টিতে উন্নীত করা হয়েছে। ২০১৩ সালে প্রকাশিত গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাস রিপোর্ট অনুযায়ী, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান এখন বিশ্বে ৭ম স্থানে। উপজেলা পর্যায়ে ১টি মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের প্রতিবেদন অনুযায়ী, নারীর অগ্রগতির নানা সূচকে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। সার্বিক বিবেচনায় নারী উন্নয়নে বিশ্বের ১৪৫টি দেশের মধ্যে এবার জায়গা করে নিয়েছে ৬৪ নম্বরে। এই তালিকায় ভারতের অবস্থান ১০৮ ও পাকিস্তান ১৪৪ নম্বরে। সরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের ৬২ শতাংশ নারী আয়বর্ধক কাজে জড়িত। দক্ষিণ এশিয়ায় এই হার সর্বোচ্চ। ৫০ শতাংশ উন্নয়নশীল দেশের চেয়ে এই হার সবচেয়ে বেশি। কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রেও পিছিয়ে নেই নারীরা। হার্ভার্ড ও ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে করা ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরামের ‘দ্যা গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট, ২০১৫ অনুযায়ী রাষ্ট্রক্ষমতায় নারীর অবস্থান বিবেচনায় সবাইকে পেছনে ফেলে বিশ্বের এক নম্বরে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ নারী উন্নয়নে বিশ্বে রোল মডেল বলে বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার মতে, মেয়েরা আজ এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ নারী উন্নয়নের একটি রোল মডেল হিসেবে বিশ্বে মর্যাদা পাচ্ছে। এরইমধ্যে নারী ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নে সরকার ব্যাপকভাবে কাজ করেছে। নারীদের অধিকার নিজেদেরই আদায় করে নিতে হবে। শুধু মুখে বললে হবে না, অধিকার দাও। সরকার নারীদের জন্য সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগাতে হবে।’ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আয়োজিক অনুষ্ঠানসূচী ॥ কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ বিকেল ৩টায় কেআইবি কমপ্লেক্স মিলনায়তনে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে ‘ওমেন ইম্পাওয়ারমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক সেমিনার ও বিকেল ৪টা ২০ মিনিটে বর্ণাঢ্য র‌্যালির আয়োজন করেছে। এই সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি। বিশেষ অতিথি হিসেবে থাকবেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য অধ্যাপক মেরিনা জাহান। বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরামের অধীনে পরিচালিত ‘উইমেন ইন লিডারশিপ’ নামের প্রকল্পে আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০১৭ উপলক্ষে ঢাকার হোটেল লা মেরিডিয়ানে দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে। ‘লা মেরিডিয়ান ঢাকা উইমেন লিডারশিপ সামিট ২০১৭, পাওয়ার্ড বাই আইপিডিসি ফাইন্যান্স লিমিটেড’র (সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত) মধ্য দিয়ে দিনব্যাপী এই কর্মকা- চলবে।
×