ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আইওআরএর লিডার্স সামিটের ভাষণে বাংলাদেশে ওশান ভার্সিটি প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব

সামুদ্রিক সহযোগিতা জোরদারের আহ্বান শেখ হাসিনার

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৮ মার্চ ২০১৭

সামুদ্রিক সহযোগিতা জোরদারের আহ্বান শেখ হাসিনার

কাওসার রহমান, জাকার্তা থেকে ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধশালী ভারত মহাসাগর প্রতিষ্ঠায় সামুদ্রিক সহযোগিতা শক্তিশালী করার আহ্বান জানিয়েছেন। মঙ্গলবার দুপুরে ভারত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক জোট আইওআর এর লিডার্স সামিটে বক্তৃতাদানকালে প্রধানমন্ত্রী এই অঞ্চলে দক্ষ মেরিনার তৈরির জন্য বাংলাদেশে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন। তিনি এই প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম দেন ‘ইন্ডিয়ান ওশেন টেকনিক্যাল এ্যান্ড ভোকেশনাল ইউনিভার্সিটি।’ শেখ হাসিনা সমুদ্রকর্মী সমুদ্রগামী বিশেষজ্ঞদের নিরাপত্তার ব্যাপারে জোট নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, বৈশ্বিকভাবে সুনাম সত্ত্বেও সিম্যান ও মেরিন ইঞ্জিনিয়াররা প্রায়ই অনাকাক্সিক্ষত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছেন। তাই এই অঞ্চলে দক্ষ মেরিনারদের একটি ‘পুল’ তৈরির জন্য কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা জরুরী। বক্তৃতার শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৭ মার্চ উপলক্ষে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করে বলেন, আজ বাংলাদেশের জন্য একটি স্মরণীয় দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য এক ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। যার হাত ধরে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। আমি কৃতজ্ঞচিত্তে বঙ্গবন্ধুর স্মরণীয় অবদান স্মরণ করছি এবং তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। এ সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী চমৎকার আতিথেয়তার জন্য ইন্দোনেশিয়ার জনগণ ও সরকারকে ধন্যবাদ জানান। ভারত মহাসাগর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভারত মহাসাগর আমাদের কাছে নিরাপত্তা, সংযুক্তি, শান্তি ও সমৃদ্ধির প্রতীক। এটি আমাদের বিশ্বায়নের একটি ‘লাইফলাইনও’ বটে। কারণ এর মধ্য দিয়ে বিশ্বের অর্ধেক পণ্যবাহী কন্টেনার চলাচল করে। শুধু তাই নয়, বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ পণ্য এবং দুই-তৃতীয়াংশ তেলবাহী জাহাজও এই মহাসাগর ব্যবহার করে। শেখ হাসিনা আরও বলেন, ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরের একটি ছোট দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বাস করে, এই মহাসাগরের প্রাকৃতিক সম্পদের সুস্থায়ী ব্যবহারের ওপর নির্ভর করছে এই অঞ্চলের ভবিষ্যত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, খাদ্য নিরাপত্তা ও সামাজিক উন্নয়ন। ইতোমধ্যে আমরা আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনায় সামুদ্রিক অর্থনীতিকে অন্তর্ভুক্ত করেছি। প্রতিবেশীদের সঙ্গে আমাদের সমুদ্র সীমার শান্তিপূর্ণ সমাধানের মধ্য দিয়ে আমাদের অর্থনীতিতে নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। আমরা এখন বুঝতে পারছি, সমুদ্র থেকে আমাদের অর্থনৈতিক সুবিধা অর্জনের বিষয়টি নির্ভর করছে আমাদের দক্ষতা বৃদ্ধির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার ওপর। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে তার অবস্থান তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ গ্রহণ করেছি। সামুদ্রিক নিরাপত্তা রক্ষার ব্যাপারেও আমাদের এই পদক্ষেপ অব্যাহত থাকবে। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আইওআরএ সামিটের ঘোষণা এই অঞ্চলের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা আরও জোরদার করবে। জ্বালানি নিরাপত্তার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সুস্থায়ী জ্বালানি অনুসন্ধানের জন্য এই অঞ্চলের মধ্যে আঞ্চলিক জ্বালানি সহযোগিতা গড়ে তোলা সম্ভব। বাংলাদেশ এই জ্বালানি সহযোগিতার ইতিবাচক প্রভাবকে স্বীকৃতি দেয়। আমরা ইতোমধ্যে আমাদের প্রতিবেশীদের সঙ্গে জ্বালানি ও বিদ্যুত বাণিজ্য সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছি। এ ছাড়াও আমরা সমুদ্র ও সৌরশক্তি ব্যবহার করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ‘সার্কিট’ উন্নয়নে কাজ করছি। আমরা আশা করছি, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো নতুন জ্বালানি নিরাপত্তাময় পৃথিবী গড়তে এগিয়ে আসবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের অক্লান্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এখন জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ ক্ষতির শিকার। আমরা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির উদ্বেগজনক পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কৃষি জমি হারিয়ে যাবে। প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। অথচ আমরা এই বৈশ্বিক উষ্ণতা সৃষ্টি করিনি। কিন্তু আমরা এই উষ্ণতা বৃদ্ধির শিকার। তাই জলবায়ু ন্যায্য নিশ্চিত করার বিষয়টি আমরা অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করেছি। তিনি বলেন, সংযুক্তি (কানেকটিভিটি) আজকের দিনে শান্তি ও উন্নয়নের জন্য খুবই জরুরী। তাই আমি শুধু কাঠামোগত সংযুক্তির প্রতিই জোর দিচ্ছি না, আমি ধারণা, উদ্ভাবন, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও পর্যটন সংযুুক্তিরও আহ্বান জানাচ্ছি। সেই সঙ্গে শান্তিু ও সমৃদ্ধশালী সমাজ প্রতিষ্ঠায় আমি মানবিক মনের সংযুক্তির প্রতিও জোর দিতে চাই। লিডার্স সামিটে ভাষণের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জোট নেতাদের সঙ্গে সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত প্রদর্শনী ঘুরে ঘুরে দেখেন। এ ছাড়াও তিনি সম্মেলনের ফাঁকে ফাঁকে ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন। পাশাপাশি সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিমন্ত্রী ড. মাইথা সালেম আল-শামসি এবং জাপানের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নবো কিসি তার সঙ্গে সাক্ষাত করেন। পরে তিনি সমাপনী অনুষ্ঠানে যোগদান ছাড়াও সামিটের ঘোষণাপত্রের স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যোগ দেন। সব মিলিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এদিন ব্যস্ত সময় কাটান। এর আগে সকালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জোট নেতাদের সঙ্গে ইন্দোনেশিয়ার এতিহ্যবাহী ঢোল বাজিয়ে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর জোট ইন্ডিয়ান ওশেন রিম এ্যাসোসিয়েশনের (আইওআরএ) লিডার্স সামিটের সূচনায় অংশ নেন। আইওআরএ’র ২০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে জাকার্তা কনভেনশন সেন্টারে আয়োজিত লিডার্স সামিট শুরু হয় মঙ্গলবার সকাল ১০টায়। সেন্টারে ২১ দেশের এই জোটের ‘লিডার্স সামিটের’ উদ্বোধন ঘোষণা করেন ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো। উদ্বোধন ঘোষণার পর দেশটির প্রথাগত পোশাক পরে হাতে ঐতিহ্যবাহী ঢোল নিয়ে মঞ্চে উঠে আসে একদল শিশু। তারা ইন্দোনেশিয়ার জনপ্রিয় একটি ঢোল নৃত্য পরিবেশন করে। এই নৃত্য পরিবেশনের পর একে একে মঞ্চে ডাকা হয় ২১ দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের। এ সময় শিশুরা তাদের হাতে একটি করে ঢোল তুলে দেয়। মঞ্চে উঠে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে তারা ঢোল বাজিয়ে ভবিষ্যত প্রজম্মের জন্য সুন্দর ও নিরাপদ পৃথিবী গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেন। এর মধ্য দিয়ে মঙ্গলবার সকালে শেষ হয় আইওআরএ’র লিডার্স সামিটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর শুরু হয় কার্যকরী অধিবেশন। এ অধিবেশনে একে একে ২১ দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান তাদের ভাষণ প্রদান করেন। ‘শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ ভারত মহাসাগরের জন্য সমুদ্র সহযোগিতা জোরদার’ শীর্ষক প্রতিপাদ্য নিয়ে এই প্রথমবারের মতো আইওআরএ শীর্ষ সামিট আয়োজন করেছে ইন্দোনেশিয়া। সামিটে জোটভুক্ত ২১টি দেশের সুলতান, প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও উপ-প্রধানমন্ত্রী অংশ নিয়েছেন। ‘লিডারস সামিটে’ যোগ দিতে তিন দিনের সফরে সোমবার জাকার্তায় পৌঁছান শেখ হাসিনা। মধ্য জাকার্তার সাঙ্গরি-লা হোটেল থেকে স্থানীয় সময় সকালে সম্মেলন কেন্দ্রে পৌঁছানোর পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানান ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট। এরপর ফটোসেশনে অংশ নেন সম্মেলনে আসা জোট নেতারা। ভারত, বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়া, কমোরস, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, কেনিয়া, মাদাগাস্কার, মালয়েশিয়া, মরিশাস, মোজাম্বিক, ওমান, সেসেলস, সিঙ্গাপুর, সোমালিয়া, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, তানজানিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইয়েমেন ও দক্ষিণ আফ্রিকা আইওআরএর সদস্য। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র চীন, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, জাপান ও মিসর এই জোটের ডায়লগ পার্টনার।
×