ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

৭ মার্চ ও একটি বিশ্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ৮ মার্চ ২০১৭

৭ মার্চ ও একটি বিশ্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ

মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে এটি সুষ্পষ্ট যে, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তি অর্জনের ইতিহাসে একটি অনন্য সাধারণ গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দিন। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশ্ব-শ্রেষ্ঠ ভাষণের জন্য ঐদিনের তাৎপর্য বিশ্ব ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অধ্যায় হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। এজন্যই বিভিন্নভাবে বঙ্গবন্ধুকে শুধু বাঙালি জাতির জনক নয়, এ ধরিত্রির মহাকালের মহানায়ক অভিধায় অভিষিক্ত করে বিশ্বব্যাপি অনেক কবিতা, সাহিত্য, গান ও রচনায় অভিনব সৌকর্যের মোড়কে উপস্থাপন করা হয়েছে। বাঙালি কবি ও লেখক অজয় দাশ তাঁর ’বঙ্গবন্ধু: আদিগন্ত যে সূর্য’ কবিতায় বঙ্গবন্ধুকে যে সব সহজ সরল পংক্তিতে চিত্রায়িত করেছেন, তা হল ”বাঙালি কি বাঙালি হয় শাড়ি, ধুতি, লুঙ্গি ছাড়া/ থাকে না তার বর্গ কিছুই না থাকলে টুঙ্গিপাড়া/ সুর-অসুরে হয় ইতিহাস, নেই কিছু এ দু’জীব ছাড়া/বাংলাদেশের ইতিহাসে দেবতা নেই মুজিব ছাড়া/ৃৃ ................... বাংলাদেশের মুক্তিও নেই মুজিব নামের সূর্য ছাড়া”। ২০১৩ সালে জ্যাকব ফ. ফিল্ড এর প্রকাশিত গ্রন্থ ’ WE SHALL FIGHT ON THE BEACHES – THE SPEECHES THAT INSPIRED HISTORY’ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ একচলিল্লশটি ভাষণের এক অনবদ্য সংকলন। বইটির নামকরণে সম্পাদক বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের ভাষণের এক উল্লেখযোগ্য বাক্য ব্যবহার করেছেন। যখন জার্মানির হিটলার ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পোলান্ড এবং ১৯৪০ সালের এপ্রিলে নরওয়ে দখলে নেন, তখন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চ্যাম্বারলিকে হিটলারের এই দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর ব্যর্থতার জন্য পদত্যাদে বাধ্য করে চার্চিলকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে নিয়োগ দেয়া হয়। অল্প বিরতিতে ফ্রান্সসহ হিটলারের অন্য দেশ দখলের জন্য ঘধুর বাহিনীর বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে ১৯৪০ সালের ৪ জুন চার্চিল তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, ”We shall fight on the seas and oceans, we shall fight with growing confidence and growing strength in the year…, we shall fight on the beaches... We shall fight in the fields and in the streets and…, we shall never surrender“ । ঠিক একইভাবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চ রেসকোর্সে গর্জে বলেছিলেন ”আর তোমরা গুলি করবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবা না।” উল্লেখিত গ্রন্থে খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩১ থেকে ১৯৮৭’র রোনাল্ড রিগেনের ভাষণসহ মোট একচল্লিশটি বিশ্ব শ্রেষ্ঠ ভাষণের অন্যতম ছিল বঙ্গবন্ধুর ১৯৭১ সালের The Struggle This Time is the Struggle for Independence fvlYwU| Ab¨vb¨v D‡j­L‡hvM¨ fvl‡Yi g‡a¨ wQj : 431 BC Funeral Oration – Pericles, 326 BC Address at Hydaspes River - Alexander the Great, 48 BC Address before the Battle of Pharsalus - Julius Caesar, 1453 The Final Stand - Emperor Constantine XI, 1653 Dismissal of the Rump Parliament - Oliver Cromwell, 1716 Speech to the Council of Perth - James Francis Edward Stuart, 1783 The Newburgh Address - George Washington, 1805 Speech Before and After the Battle of Austerlity – Napoleon Bonaparte, 1862 Blood and Iron - Otto von Bismarck, 1865 Second Inaugural Address - Abraham Lincoln, 1917 An Appeal to the Read Army - Vladimir Lenin, 1917 War message to Congress - Woodrwo Wilson, 1940 We Shall Fight on the Beaches - Winston Churchill, 1941 A Date Which Will Live in Infamy - Franklin D. Roosevelt, 1941 Address on the Anniversary of the October Revolution - Joseph Stalin, 1944 Serve the People - Mao Zedong, 1945 Declaration of Independence - Ho Chi Minh, 1973 Farewell to the Nation - Salvador Allende সকলের জানা যে, ১৯৭০ সালের ৭ ও ১৭ ডিসেম্বর যথাক্রমে পকিস্তানের জাতীয় পরিষদ ও পাঁচটি প্রদেশে প্রাদিশিক পরিষদের নির্বাচন হয়। আওয়ামী লীগ উভয় পরিষদেই একক ও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু জুলফিকার আলী ভ’ট্টোর ঘোষনা ’গত তেইশ বছর পূর্ব পাকিস্তান দেশ শাসনে ন্যায্য হিস্যা পায়নি, তাই বলে আগামী তেইশ বছর পাকিস্তানের উপর প্রভুত্ব করবে তা হতে পারে না’ এর ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পাকিস্তারনের সামরিক প্রেসিডেন্ট জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান করেও ১লা মার্চ অধিবেশন স্থগিত ঘোষনা করে অর্থাৎ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ অর্জনের ফলে পাকিস্তানের পরিপূর্ণ শাসনভার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তথা বঙ্গবন্ধুকে হস্তান্তর না করার সুগভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এর প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধুর আহবানে ১লা মার্চ থেকে সারা দেশে শুরু হয় ব্যাপক অসহযোগ আন্দোলন। ৩ মার্চ আগের রাতের শহীদদের লাশ নিয়ে মিছিল শেষের সভায় পল্টনে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন ’গণতান্ত্রিক নিয়মে প্রণীত এক শাসনতন্ত্র যদি না চান তাহলে আপনাদের শাসনতন্ত্র রচনা করুন। বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র আমরাই রচনা করব। .........২৩ বছর ধরে রক্ত দিয়ে আসছি। প্রয়োজনে আবার বুকের রক্ত দেব। মৃত্যুর মুখে দাঁডিয়ে বীর শহীদদের রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করব না। বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে তিনি বলেছিলেন- ভায়েরা, আবার আমি বলছি, আমি থাকি আর না থাকি, আমার সহকর্মীরা আছেন। তাঁরাই নেতৃত্ব দেবেন। আর যদি কেউ না থাকে, তবু আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। বাংলার ঘরে ঘরে প্রতিটি বাঙালিকে নেতা হয়ে নির্ভয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে’। এভাবেই অনিবার্য পরিণতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চ তাঁর ভাষণে বাংলাদেশের মুক্তি ও স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। প্রফেসর আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকির ভাষায় ’ভাষণের সূচনাপর্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বলা হয়ে থাকে- There is nothing like a good beginning for a speech. বক্তব্যের প্রারম্ভে শ্রোতার মানসিক অবস্থান (ধঁফরবহপব ড়ৎরবহঃধঃরড়হ) ও সাম্প্রতিক ঘটনা উল্লেখ করা অত্যাবশ্যক বলে যোগাযোগতত্ত্বে যা বলা হয় (reference to audience and reference to recent happenings) তার আশ্চর্য প্রতিফলন ঘটে বঙ্গবন্ধুর এ যুগান্তকারী ভাষণে’। ”ভায়েরা আমার, আজ দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়’ বলে তাঁর ঘোষণার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেন। বাঙলার মানুষ যে কী কঠিন বাস্তবতায় পাকিস্তানের সকল শোষনকে সহ্য করেছিল এবং তারই বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিকারের আশায় অসম সাহসের সাথে সকল অন্যায় অবিচারকে প্রতিরোধের শপথ নিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ভাষণে এর প্রতিফলন ঘটেছিল অতি জোরালোভাবে - ’কি অন্যায় করেছিলাম? নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে, আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল এসেম্বলী বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করব এবং এদেশকে আমরা গড়ে তুলব, এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, ২৩ বৎসরের করুণ ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বৎসরের ইতিহাস, মুমূর্ষ নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস। ১৯৬৯ সালের আন্দোলনে আয়ুব খানের পতন হওয়ার পরে যখন এহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন, তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গণতন্ত্র দেবেন, আমরা মেনে নিলাম। তারপর অনেক ইতিহাস হয়ে গেল, নির্বাচন হল। আমি প্রেসিডেন্ট এহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি শুধু বাংলার নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসাবে তাঁকে অনুরোধ করলাম ১৫ই ফেব্রুয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না। তিনি রাখলেন ভূট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে হবে। আমরা বললাম ঠিক আছে, আমরা এসেম্বলীতে বসব’।(সূত্র: মুনতাসির মামুন) কিভাবে বাংলার মানুষের উপর নিপিড়ন নির্যতন চালানো হয়েছিল এবং এদেশের আয় উপার্জন থেকে অন্যায় ও অবৈধভাবে অস্ত্র কিনে তা এদেশের জনগণ নিধনে ব্যবহার করা হয়েছিল স্বাধীনতার ঘোষণার প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু তার এক সাবলিল ও সহজ ভাষায় অসাধরণ সাহসিকতায় তুলে ধরেন। ’কি পেলাম আমরা? আমার পয়সা দিয়ে যে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রু থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরিব-দুঃখী আর্ত মানুষের মধ্যে। তার বুকের উপর হচ্ছে গুলি। অমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ, আমরা বাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি তখনই তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। টেলিফোনে আমার সঙ্গে তাঁর কথা হয়। তাঁকে আমি বলেছিলাম, জনাব এহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কীভাবে আমার গরিবের উপরে, আমার বাংলার মানুষের উপরে গুলি করা হয়েছে। কী করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে। কী করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন’। চলবে...
×