ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

২৫ মার্চের গণহত্যা এবং দেশী-বিদেশী গোয়েবলসদের প্রচারণা

প্রকাশিত: ০৫:২২, ৮ মার্চ ২০১৭

২৫ মার্চের গণহত্যা এবং দেশী-বিদেশী গোয়েবলসদের প্রচারণা

বাংলাদেশকে বলা হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ। কিন্তু ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তারিখে মানুষের সৃষ্ট দুর্যোগ (সবহ সধফব পধষধসরঃু) আর সকল প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতিকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। ১৯৭০ সালের নবেম্বর মাসের ভয়াবহ সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও ঝড়ে মারা গিয়েছিল দশ লাখ লোক। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বাংলাদেশে পাকিস্তানী হানাদারেরা যে বর্বর গণহত্যা শুরু করে তাতে বুদ্ধিজীবীসহ ত্রিশ লাখ মানুষকে আত্মাহুতি দিতে হয়। বাংলাদেশে এটি মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ এবং সবচাইতে ভয়াবহ দুর্যোগ। এই দুর্যোগে এক কোটি মানুষকে দেশছাড়া হতে হয়েছিল। অতীতের বাংলাদেশে বহু দেশী ও বিদেশী ডাকাত ও দস্যু সম্প্রদায় হামলা চালিয়েছে। সম্পদ লুণ্ঠন ও নারী অপহরণ করেছে। তাদের মধ্যে আছে ওলন্দাজ, পতুর্গিজ, মগ, হার্মাদ, বর্গি ইত্যাদি দস্যুদল। নবাব আলিবর্দী খাঁর আসলে বর্গিরা সারা সুবে বাংলায় ভয়াবহ ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল। আলিবর্দী অবশ্য তাদের দমন করেন। গত শতকের সত্তরের দশকে বাংলাদেশে পাকিস্তানী হানাদারদের হামলা নৃশংসতার দিক থেকে অতীতের সব হামলার রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। ভারতে এখনও জালিয়ানওয়ালাবাগ দিবস পালন করা হয়। জালিয়ানওয়ালাবাগের একটি প্রাচীরঘেরা স্থানে ব্রিটিশ সেনাপতি জেনারেল ডায়ার নিরস্ত্র ও অবরুদ্ধ মানুষের উপর গুলি চালিয়ে তাদের হত্যা করেছিলেন। প্রতিবাদে সারা অবিভক্ত ভারতে আগুন জ্বলে উঠেছিল। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এই হত্যাকা-ের প্রতিবাদে ব্রিটিশরাজের দেয়া স্যার উপাধি ত্যাগ করেছিলেন। প্রচ- ক্ষোভে লিখেছিলেন, কণ্ঠ আমার রুদ্ধ আজিকে বাঁশি সঙ্গীত হারা অমাবস্যার কারা, লুপ্ত করেছে আমার ভুবন দুঃস্বপ্নের তলে তাই তো তোমরে শুধাই অশ্রুজলে যাহারা তোমার বিষাইছে বাযু,নিভাইছে তব আলো তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছো, তুমি কি বেসেছো ভালো? ব্রিটিশ সরকার তখন এই বর্বরতার জন্য ভারতবাসীর কাছে ক্ষমা চায়নি। আবার এতো বড় অবরোধের কথা অস্বীকারও করেনি। পরবর্তীকালে তারা দুঃখ প্রকাশ করেন। জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে প্রথম আণবিক বোমাবর্ষণ করে মানবতার বিরুদ্ধে সবচাইতে বড় অপরাধ করেছে আমেরিকা। সুপার পাওয়ার হওয়ার ঔদ্ধত্য নিয়ে তারা এই বর্র্বরতার জন্য জাপানের মানুষের কাছে ক্ষমা চায়নি। কিন্তু এই অপরাধ অস্বীকার করেনি। প্রেসিডেন্ট পদে থাকার শেষ বছরে বারাক ওবামা জাপানের এই বোমাবিধ্বস্ত (এখন মৃত্যুবিভীষিকা কাটিয়ে নতুনভাবে গড়ে উঠেছে) শহরে গিয়ে অসংখ্য মৃত ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য অশ্রু ঝরিয়েছেন এবং দুঃখ প্রকাশ করেছেন। সম্ভবত বলদর্পী আমেরিকান এস্টাবলিশমেন্টের চাপে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে পারেননি। জালিয়ানওয়ালাবাগের ব্যাপারে অতীতের ব্রিটিশরাজ এবং নাগাসাকি-হিরোশিমার ব্যাপারে মার্কিন শাসকেরা প্রকাশ্যে ক্ষমা না চাইলেও এই বর্বরতার কথা তারা অস্বীকার করেননি। এর দায়দায়িত্ব নির্যাতিত দেশ বা তার মানুষের ঘাড়ে চাপাননি। কিন্তু এই ব্যাপারে চরম নির্লজ্জতার ও অমানবিক মনোভাবের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন এবং এখনও দেখাচ্ছেন পাকিস্তানের অতীতের ও বর্তমানের শাসকেরা। বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে তারা যে ত্রিশ লাখ নরনারী হত্যা করেছেন, তার জন্য দেশটির কাছে ক্ষমা চাওয়া ও দুঃখ প্রকাশ দূরের কথা, তারা এতো বড় অপরধের কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করছেন এবং একাত্তর সালে কোনো ধরনের হত্যাকা- হয়ে থাকলে তার দায়দায়িত্ব বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ওপর চাপাচ্ছেন। এই গোয়েবলসীয় মিথ্যা প্রচারের দুঃসাহস পাকিস্তানের শাসকেরা কোথা থেকে পায় এই প্রশ্নটি সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তুলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই প্রশ্নটির জবাব খুঁজতে হলে প্রথমেই নিজ দেশের বিভীষণ গোষ্ঠীর দিকে তাকাতে হবে। প্রথম দিকে এই বিভীষণ গোষ্ঠীর নেতা ছিলেন ড. জি ডব্লিউ চৌধুরী (গোলাম ওয়াহেদ চৌধুরী) নামে এক বাংলাদেশী প-িত। তিনি ছিলেন পাকিস্তানের সামরিক জান্তার অনুগ্রহভোগী এক বুদ্ধিজীবী। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি একটি বই লেখেন, ঞযব ষধংঃ ফধুং ড়ভ ঁহরঃবফ চধশরংঃধহ (অবিভক্ত পাকিস্তানের শেষের দিনগুলো)। এই বইতে তিনি পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ার জন্য প্রধানত দায়ী করেন আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। নানা অসত্য ও বিকৃত তথ্যে ভর্তি এই বইটি দেশে-বিদেশে বহুলভাবে প্রচারিত হওয়ায় বঙ্গবন্ধু সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে এই বইটির প্রচারণার জবাবে ইংরেজিতে একটি বই প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন। এই বই লেখার দায়িত্ব নেন বঙ্গবন্ধু সরকারের তৎকালীন মন্ত্রী ড. কামাল হোসেন। তিনি এই বই লেখার নামে সরকারী দায়িত্ব থেকে কিছুদিনের জন্য ছুটি নিয়ে অক্সফোর্ডে চলে যান। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাকশাল মন্ত্রিসভা গঠিত হওয়ার পরও তিনি যথাসময়ে মন্ত্রিত্বের শপথ গ্রহণের জন্য অক্সফোর্ড থেকে ঢাকায় আসেননি। (বহু পরে এসে শপথ নেন।) অজুহাত ছিল তিনি বইটি লেখায় ব্যস্ত আছেন। তার দ্বারা এই বই লেখা আর হয়নি। বঙ্গবন্ধুর দেয়া এই দায়িত্বটি তিনি কেন পালন করেননি, সে সম্পর্কে আজ পর্যন্ত কোনো কারণও দর্শাননি। ড. জি ডব্লিউ চৌধুরীর পর বিবিসি রেডিও’র বাংলা বিভাগের সাবেক কর্মাধ্যক্ষ সিরাজুর রহমান কিছুকাল আগে ‘গার্ডিয়ানে’ চিঠিপত্র কলামে একটি চিঠি পাঠান এবং তাতে দাবি করেন, মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে বলে বঙ্গবন্ধু ভুল সংখ্যাতত্ত্ব দিয়েছেন। আসলে তিনি তিন লাখ মারা গেছে বলতে চেয়েছিলেন। লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে তার এই বক্তব্যের প্রতিবাদ করা হয়। সিরাজুর রহমান এখন প্রয়াত (আল্লাহ তাকে বেহেশত নসিব করুন)। কিন্তু তার এই বক্তব্য এবং তার আত্মজীবনীতে (সকলে প্রীতি নিন) বঙ্গবন্ধুবিদ্বেষী কথাবার্তা পাকিস্তানী শাসকদের প্রচারণায় যথেষ্ট সাহায্য জোগায় এবং তারা ক্রমে ক্রমে ’৭১-এর গণহত্যার অপরাধ অস্বীকার করারও দুঃসাহস পায়। একাত্তরের গণহত্যার অপরাধ অস্বীকার করার ব্যাপারে পাকিস্তান যে নির্লজ্জ স্পর্ধা দেখাচ্ছে, তার পেছনে দুঃখজনকভাবে হলেও বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ারও একটা ভূমিকা আছে। তিনি সম্প্রতি কথা নেই বার্তা নেই, মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ মানুষের শহীদ হওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে শুধু তার পাকিস্তান প্রেমের পরিচয় দেননি, তার রাজনীতিতে দেশপ্রেমহীনতারও প্রমাণ দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের বিরোধিতা আর দেশের মর্যাদার বিরোধিতা এক কথা নয়। মুুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বেগম জিয়া যেসব কথা বলেছেন, পশ্চিমা কোনো উন্নত দেশে তা রাষ্ট্র বিরোধিতার অপরাধ বলে বিবেচিত হতো এবং তার বিচার হতো। পাকিস্তানের সামরিক ও অসামরিক শাসকেরা নিজেদের মানবতাবিরোধী চরম অপরাধ ঢাকা দেয়ার জন্য বাংলাদেশে তাদের প্রতি অনুগত ‘বিভীষণ গোষ্ঠীর’ সাহায্য তো পেয়েছেই, তার ওপর বিপুল অর্থ ছড়িয়ে বিদেশী কিছু বুদ্ধিজীবীকে ভাড়া করে তাদের দ্বারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বিকৃত এবং কল্পিত তথ্যযুক্ত বই লিখিয়ে বিশ্বময় বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করেছেন এবং এখনও করছেন। এই ব্যাপারে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর পরিবারের এক মহিলা বুদ্ধিজীবীকে দিয়ে একটি বই লিখিয়ে তারা চারদিকে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিলেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের গণহত্যাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার কয়ে এক পাকিস্তানী লেখকের লেখা একটি বই প্রকাশ করা হয়েছে এবং বইটির মোড়ক উন্মোচনও ঢাকঢোল পিটিয়ে করা হয়েছে। কথায় বলে “এক কান কাটা গ্রামের পথ এড়িয়ে চলে, দু’ কান কাটা গ্রামের ভেতর দিয়েই চলে।” পাকিস্তানের বেলায় প্রবাদটি শতভাগ সঠিক। এখন প্রশ্ন, পাকিস্তানের দেশী লেখকদের একটা শ্রেণী না হয় তাদের শাসকদের হাতে তামাকু সেবনে লজ্জা পান না, কিন্তু বিদেশী কিছু নামী লেখক কেন পাকিস্তানের হয়ে গোয়েবলসীয় অসত্য প্রচারে রাজি হলেন? এর একটাই জবাব, অনেক বড় প্রতিভাও অনেক সময় অর্থলোভে বা খ্যাতির লোভে আত্মবিক্রয়ে অথবা বিবেক বিক্রয়ে দ্বিধা করেন না। গত শতকে লুইগি পিরানাদেল্লোর মতো বড় সাহিত্যিক ফ্যাসিস্টদের সমর্থনে কলম ধরেছিলেন। এজরা পাউন্ডের মতো মহাকবি ইতালির ফ্যাসিস্ট শাসক মুসোলিনীকে অন্ধ সমর্থন দিয়েছিলেন। শেষ বয়সে তাকে মানসিক হাসপাতালে বন্দী থাকতে হয়েছে। আমার দুঃখ, আমরা ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি দিতে পেরেছি। কিন্তু পাকিস্তানীদের গণহত্যা ঢাকা দিতে একই ধরনের অপরাধ যারা করেছে এবং করে চলেছে, দেশের সেই রাষ্ট্রদ্রোহী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে আমরা বিচার করে দণ্ড দিতে পারিনি। এই অপারগতা পাকিস্তানে মানবতার শত্রু যে শাসককুল রয়েছে (জনগণ নয়) তাদের মিথ্যা ও বিকৃত তথ্য প্রচারে আরও উৎসাহ যোগাচ্ছে। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পার্লামেন্টে ঘোষণা করেছেন, ২৫ মার্চ তারিখটিকে গণহত্যা দিবস বলে পালনের ব্যবস্থা করা হতে পারে। এই ঘোষণায় দেশের মানুষ অবশ্যই আনন্দিত। সরকারীভাবে ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষিত হওয়া এবং প্রতি বছর পালনের ব্যবস্থা হওয়া দরকার। একুশের ভাষা শহীদ দিবসের মতো এই গণহত্যা দিবসও বিশ্বময় বাঙালীদের দ্বারা প্রতিবছর পালিত হওয়া আবশ্যক। বিশ্ববাসীও তাতে সাড়া দেবে এবং সেটাই হবে বাংলাদেশে ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটন সম্পর্কে পাকিস্তানী শাসকদের মিথ্যা প্রচারের উপযুক্ত জবাব। দিবস পালনের পাশাাশি এই গণহত্যা সম্পর্কে প্রকৃত তথ্যভিত্তিক বই প্রকাশ করার দায়িত্বও সরকারকে গ্রহণ করতে হবে। সরকার উদ্যোগ নিলে যে কাজটি করতে গিয়ে ড. কামাল হোসেনের মতো ব্যক্তি পিছিয়ে গেছেন, সেই দায়িত্ব পালনে অনেক দেশপ্রেমিক তরুণ লেখক ও ইতিহাসবিদ এগিয়ে আসবেন। দিবসটি গণহত্যা দিবস বলে সরকারীভাবে ঘোষিত হোক। ল-ন ৭ মার্চ, মঙ্গলবার, ২০১৭
×