ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

বি বোল্ড ফর চেঞ্জ!

প্রকাশিত: ০৩:৫৪, ৮ মার্চ ২০১৭

বি বোল্ড ফর চেঞ্জ!

পুঁজিবাদী তামাশা নিয়ে আরও একটি আট মার্চ উদযাপিত হচ্ছে জাতিসংঘের উদ্যোগে। গালভরা একটি স্লোগানও ঠিক করা হয়েছে যথারীতি- ‘বি বোল্ড ফর চেঞ্জ’। বাংলায় সম্ভবত ‘পরিবর্তনের জন্য সাহসী হও’। কোন্ পরিবর্তনের জন্য সাহসী হতে বলা হচ্ছে? সমাজে নারীর প্রচলিত ভাবমূর্তিটি অক্ষুণœ রাখা শুধু নয়, নানাভাবে তাকে টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা যেখানে চলে প্রতিনিয়ত সেখানে নারী কিভাবে নিজের পরিবর্তনের জন্য সাহসী হবে? গতকাল জনকণ্ঠে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের কয়েকটি কেস স্টাডির একটিতে একজন গৃহিণী বলছেন, ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এ্যাকাউন্টিংয়ে মাস্টার্স করার পর এক বছর একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেছি। কিন্তু পরের বছর বিয়ে হয়ে গেলে সংসার সামলাতে গিয়ে আর চাকরিটা করা হয়নি। নিজের ক্যারিয়ারের চিন্তা না করে পরিবারের চিন্তা করেছি। মা হওয়ার পর সংসার ও বাচ্চাকে নিয়ে আরও ব্যস্ততা বেড়ে যায়। তখন তো চাকরি করার কথা ভাবতেও পারতাম না। সংসারের প্রতি ভালবাসায় বিভোর হয়ে নিজের পায়ে কুড়াল মেরেছি। এখন আমার মেয়ের বয়স বারো বছর। মেয়েকে স্কুলে আনা-নেয়া, গান শেখা, ছবি আঁকা সবকিছুতে ছায়ার মতো পাশে থাকতে হয়। সবসময় ভেবেছি আমি যেমন নিজের ক্যারিয়ারকে বিসর্জন দিলাম, আমার সন্তানের ভবিষ্যত যেন এমন না হয়। কিন্তু আমার সন্তানও আমাকে নিয়ে গর্ব করে না। স্বামী কিংবা সন্তানের মতে ‘সারাদিন তো তুমি ঘরেই থাকো’। চমৎকার একটি ক্যারিয়ার হতে পারত এ নারীর। তাতে তিনি যেমন একজন আত্মবিশ্বাসী মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতেন, তেমনি দেশও পেত একজন চৌকস পেশাজীবী। কিন্তু কেন তিনি ক্যারিয়ারের প্রতি মনোযোগী না হয়ে সংসার ও সন্তান পালনকে মনোযোগের একমাত্র বিষয় করে যাদের জন্য ক্যারিয়ার ত্যাগ করলেন তাদের কাছেই গুরুত্বহীন হয়ে পড়লেন? কারণ সমাজ তার মানসিক কাঠামোটি এভাবেই গড়ে দিয়েছে। স্বামীর দিক থেকেও চাপ ছিল নিশ্চয়। কারণ তিনিও এ সমাজের প্রডাক্ট। সুতরাং পরিবর্তন দরকার প্রচলিত মানসিকতার, সমাজের। এর পরিবর্তন না ঘটিয়ে শুধু নারীকে ‘বি বোল্ড ফর চেঞ্জ’ বলে জাগিয়ে তোলার আওয়াজকে ভ-ামি ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। ॥ দুই ॥ ‘সমাজসেবা’মূলক নানা ধরনের কাজ এ দেশে গত শতকের সত্তর দশকের শুরু পর্যন্ত ছিল পুরোপুরি ননপ্রফিট। কিন্তু আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে সে সময় অনুন্নত দেশগুলোতে ‘দারিদ্র্য ও বেকারত্ব সৃষ্টি রোধ’ করার জন্য ওই ব্যবস্থার তখনকার নিয়ন্তারা এক ‘নতুন উন্নয়ন কৌশল’-এর ফর্মুলা, প্রেসক্রাইব এবং তা বাস্তবায়নের জন্য তহবিল সরবরাহ করে। সত্তর দশকের মঝামাঝি থেকে এর রূপ স্পষ্ট হয়। বেসরকারী স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা নামে পরিচিত এসব সংস্থার কাজ মূলত গ্রামমুখী হওয়ায় শহরের বিত্তবান নারী-পুরুষরা এর মধ্য দিয়ে সমাজসেবায় খুব বেশি অবদান রাখতে পারলেন না। এ সুযোগ এলো মূলত আশির দশকে। ‘নারীমুক্তি’ বিষয়টি যখন শহুরে সমাজে বার্নিং ইস্যু। জার্মান সমাজতন্ত্রী নেত্রী ক্লারা জেটকিনের (১৮৫৭-১৯৩৩) আট মার্চ ততদিনে পুরোপুরি পুঁজির পণ্য। নারীমুক্তির পুঁজিবাদী ভার্সন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পৃথিবী। সে সঙ্গে আসছে অর্থ। ‘নারীর জীবনমান বাড়াতে’ নানা নামে ও বৈশিষ্ট্যে আত্মপ্রকাশ করছে অসংখ্য এনজিও। সমাজসেবায় নিজেকে নিবেদিত করার সুবর্ণ দরজা খুলে গেল। ননপ্রফিট সমাজসেবা আশ্চর্য এক জাদুমন্ত্রে স্রোতের মতো প্রফিট বয়ে আনতে শুরু করল। অবশ্য প্রফিট শব্দটা এখানে প্রায় নিষিদ্ধের মতো। যা আসছে তার নাম ফান্ড। ‘সুবিধাবঞ্চিত’ নারীর সহায়তা দেয়ার জন্য। নারী বিষয়ক এনজিওর পাশাপাশি তথাকথিত উন্নয়নমূলক দারিদ্র্যবিমোচনকারী অনেক এনজিওর লক্ষ্যও শুরু থেকে নারীর ‘সার্বিক না হোক অর্থনৈতিক মুক্তি’ ঘটিয়ে তার জীবনের মান বাড়ানো। তাকে স্বাবলম্বী করা। এ জন্য কেউ মনোযোগ দিয়েছেন কুটির শিল্পের দক্ষতা বাড়ানোর দিকে, কেউ ক্ষুদ্র ঋণে। নারীকে স্বাবলম্বী করতে এনজিও ঘরানায় এ দুই ধারাই সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট। কিন্তু গত তিরিশ-চল্লিশ বছরে দেশজুড়ে এনজিওওয়ালাদের দারিদ্র্যবিমোচন ও নারীর স্বাবলম্বনের নেট রেজাল্ট কি? দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে এদের ভূমিকা কতখানি? নারী কি হারে মুক্ত হয়েছেন? এসব প্রশ্নের পরিষ্কার উত্তর পাওয়া যায় না। গত শতকের সত্তর দশকের শুরুতে বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য বিশ্বসংস্থা দারিদ্র্যবিমোচন কর্মসূচীর ওপর জোর দিয়েছিল বলে আমাদের এখানে ‘গ্রামোন্নয়নের’ ঢেউ উঠেছিল। গ্রামোন্নয়নের নানা কর্মসূচী, দারিদ্র্য হ্রাস, কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি ইত্যাদির জন্য তখন ‘দুর্বার বেগে’ এসব সংস্থা কাজ করেছে। তাতে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য দূর না হলেও সংস্থার কর্ণধারদের জীবনে আর্থিক পরিবর্তন চোখ ধাঁধিয়ে দেয়ার স্তরে পৌঁছেছে। সত্তরের শুরুর দারিদ্র্যবিমোচন কর্মসূচীর পর মধ্য সত্তরে মনোযোগের কেন্দ্রে আসে নারী উন্নয়ন কর্মসূচী। যথারীতি সেখানেও উন্নয়নের জোয়ার শুরু হয়। আগেই বলেছি, ক্লারা জেটকিনের নারী আন্দোলন পুঁজিবাদী ধাঁধায় পথ হারিয়েছে অনেক আগেই। মধ্যসত্তরে শুরু হয়ে আশির দশকে এসে সে আদর্শের আলো পুরোপুরি নিভে গেলেও তার জায়গায় পুঁজিবাদী জেল্লা বর্ণবৈচিত্র্যে প্রচ-ভাবে উদ্ভাসিত হয়। কিন্তু নব্বইয়ের মাঝামাঝিতে বেজিংয়ে নারী শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর ধীরে ধীরে সে জেল্লাও ফিকে হতে থাকে। নারীদের নিয়ে বেজিং শীর্ষ সম্মেলনের মতো অমন ব্যাপক তোড়জোড় এর পর আর হয়নি। কারণ, এ সময় থেকে আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদ তার গতিমুখে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের বাঁক তৈরি করে। পঁচানব্বই সালেই গ্যাট চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এটাই বিশ্বের সব অর্থনীতিকে এক ধারায় প্রবাহিত করার প্রথম একক দলিল। এর পর বহুজাতিক কোম্পানির বাজার সম্প্রসারণের নগ্ন প্রতিযোগিতায় আদর্শবাদের লোক দেখানো লেবেলও ভেসে যায়। বাজার ও বিজ্ঞাপনের ডামাডোলে কোন কিছুই আর আলাদা করে চেনার উপায় রইল না। জীবন-জগতের সবই এখন বিক্রিযোগ্য পণ্য। বাজার ও পণ্যনির্ভর সংস্কৃতিতে নারীর অবস্থান কোথায় তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার প্রয়োজন না হলেও দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘নিষিদ্ধ কথা আর নিষিদ্ধ দেশ’ থেকে ক’টি লাইন উল্লেখ করার প্রয়োজন মনে করছি। ‘শ্রেণীসমাজের কাছে নারী জাতির পবিত্রতা রক্ষার প্রয়োজন অত্যন্ত গুরুতর। কেননা, শ্রেণীসমাজের ভিত্তিই হলো ব্যক্তিগত সম্পত্তি, আর তাই এই ব্যক্তিগত সম্পত্তির নির্ভুল উত্তরাধিকার নির্ণয় করাই শ্রেণীসমাজের একটি বড় মাথা ব্যথা। উত্তরাধিকারী যদি নির্ভুল না হয় তাহলে তো ব্যক্তিগত সম্পত্তি প্রায় বেহাত হওয়ারই শামিল। একই কারণে শ্রেণীসমাজে নারীর জীবনের ওপর অতিসতর্ক নিষেধাজ্ঞা। নারী তাই দুর্লভ সামগ্রী; দুর্লভ বলেই লোভনীয়, লোভনীয় বলেই তার ছবির লোভ দেখিয়ে যে কোন পণ্যবস্তুই বাজারে কাটানো সহজসাধ্য। ফলে অবস্থাটা মোটের ওপর এক উৎকট পরিহাসের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে; নারী জীবনের শুচিতা রক্ষা করার তাগিদই নারীকে আজ প্রায় পণ্যে পরিণত করেছে।...এই হলো শ্রেণীসমাজের অন্তর্দ্বন্দ্ব। একদিকে নির্ভুলভাবে উত্তরাধিকারীকে শনাক্ত করার আশায় স্বাভাবিক সামাজিক মর্যাদা থেকে নারী জাতিকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার আয়োজন এবং এই আয়োজনের খাতিরেই নারীজাতির শুচিতা ও সতীত্ব নিয়ে অফুরন্ত সাধুবাক্য; অপরদিকে এরই বাস্তব পরিণতি হলো নারীজাতিকে একেবারে পরম পণ্য করে তোলা- রংচঙে খাবারের ছবি আর রংচঙে মেয়েদের ছবি, মার্কিন পত্রিকায় এই দুইয়ের মধ্যে সীমারেখা অস্পষ্ট।’ তিনি যে সময়ে লিখেছিলেন সে সময় মুক্তবাজার এবং মুক্তমিডিয়া এত রমরমা ছিল না। রংচঙে খাবারের ছবি আর রংচঙে মেয়েদের ছবি এখন মার্কিন পত্রিকার পাতা থেকে বেরিয়ে ‘মুক্ত’ দুনিয়ার সবখানে অবাধে বিচরণ করছে। ওই অবাধ বাজারি পণ্যের প্রভাব থেকে নারীকে রক্ষার সাম্প্রতিকতম ঢাল হিসেবে জনপ্রিয় হয়েছে বোরকা বা হিজাব। এও ওই বাজারের খেলা বা অন্তর্দ্বন্দ্ব। সেই সত্তর দশক থেকে এই দু’হাজার সতের পর্যন্ত ‘সচেতনতা’ ও ‘উন্নয়নের’ ধারাবাহিকতা, যা করতে পারেনি তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি আলোড়ন তুলেছেন তৈরি পোশাকের নারী শ্রমিকরা। পরিবর্তন যদি কিছু এসে থাকে তবে তা এসব নারীর জীবনেই এসেছে। শুধু নিজেদের জীবনে নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রেও তারা পরিবর্তনের সূচনা করেছেন। দেশের অর্থনীতি ভেতর থেকে এরাই বদলাচ্ছেন। দেশের রফতানি আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস তৈরি পোশাক শিল্প। শিল্পায়নই সত্যিকারার্থে পরিবর্তন আনতে পারে বাংলাদেশের মতো দেশে। স্বনির্ভর হতে পারে দেশ। মুক্ত হতে পারেন নারী। তা যাতে না হতে পারে সে জন্য আন্তর্জাতিক পুঁজির নিয়ন্তা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রচেষ্টার শেষ নেই। আশির দশকে বিশ্বব্যাংকের কাঠামোগত সংস্কারের নামে দেশের শিল্প-কারখানা ধ্বংস করা ছিল এর অন্যতম উদ্যোগ। শিল্পায়নকে নিরুৎসাহিত করে দারিদ্র্যবিমোচন কর্মসূচী বা নারী উন্নয়নের নামে এনজিও ব্যবসার অবাধ সুযোগ করে দিলে গরিব ও নারীর অবস্থার উন্নতি হাজার বছরেও হবে না।
×