ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কুমিল্লায় পেট্রোলবোমায় ৮ ঘুমন্ত যাত্রী হত্যা

খালেদা জিয়াকে আসামি করে আদালতে চার্জশীট

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ৭ মার্চ ২০১৭

খালেদা জিয়াকে আসামি করে আদালতে চার্জশীট

মীর শাহ আলম, কুমিল্লা থেকে ॥ বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ডাকা দেশব্যাপী লাগাতার হরতাল-অবরোধ চলাকালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে পেট্রোল বোমা হামলায় ৮ ঘুমন্ত যাত্রী হত্যাসহ ৩ মামলায় জোটের নেত্রী বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে অভিযুক্ত করে আদালতে পৃথক ৩টি অভিযোগপত্র দাখিল করেছে পুলিশ। এসব মামলায় বিএনপি-জামায়াতের আরও ৭ কেন্দ্রীয় নেতাসহ ১১০ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করা এসব ঘটনায় দায়ের করা মামলা ২ বছর ১ মাস তদন্ত শেষে সোমবার দুপুরে কুমিল্লার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুল ইসলামের আদালতে ৩টি অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। এর মধ্যে ২টি মামলার চার্জশীটে বেগম খালেদা জিয়া ও বিএনপি-জামায়াতের ৮ জন কেন্দ্রীয় নেতাসহ ৭৮ জনকে এবং অপর একটি মামলায় খালেদা জিয়াসহ স্থানীয় বিএনপি-জামায়াতের ৩২ জন নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়। জানা গেছে, বিএনপি-জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের ডাকা লাগাতার হরতাল-অবরোধ চলাকালে ২০১৫ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ভোর রাত সাড়ে ৩টার দিকে কক্সবাজার থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী আইকন পরিবহনের একটি নৈশ কোচ (ঢাকা মেট্রো-ব-১৪-৪০৮০) চৌদ্দগ্রামের মিয়াবাজারসংলগ্ন জগমোহনপুর নামক স্থানে পৌঁছুলে দুর্বৃত্তরা বাসটি লক্ষ্য করে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে। এতে বাসটির ভিতরে-বাইরে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠে। এ সময় বাসে ঘুমিয়ে থাকা যাত্রীরা কোন কিছু বুঝে উঠার আগে আগুনে পুড়ে ঘটনাস্থলে ৭ জন ও হাসপাতালে নেয়ার পর ১ জনসহ মোট ৮ ঘুমন্ত যাত্রী মারা যায়। নিহতরা হচ্ছেন- যশোরের গণপূর্ত বিভাগের ঠিকাদার জেলা সদরের ঘোপসেন্ট্রাল রোডের বাসিন্দা (বাসা- ৩৫, গোলাপ সেন্টার) হাজী রুকনুজ্জামানের পুত্র নুরুজ্জামান পপলু (৫০), তার একমাত্র মেয়ে যশোর পুলিশ লাইন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণীর ছাত্রী মাইশা নাঈমা তাসনিন (১৫), কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার আবু তাহের (৩৮) ও আবু ইউসুফ (৪৫), নরসিংদীর পলাশ উপজেলার আসমা আক্তার (৩৮) ও তার ছেলে শান্ত (৬), শরিয়তপুর জেলার ঘোষের হাট উপজেলার দক্ষিণ গজারিয়া গ্রামের ওয়াসিম। নিহতদের দেহ আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায়। দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোচিত নারকীয় ওই হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় চৌদ্দগ্রাম থানার এসআই নুরুজ্জামান হাওলাদার বাদী হয়ে পরদিন ৩ ফেব্রুয়ারি রাতে দ-বিধির ৩০২/৩৪ তৎসহ ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে ১৫ (৩)/২৫-ডি ধারায় একটি ও ১৯০৮ সালের বিস্ফোরক আইনের ৩ ও ৪ ধারায় একটিসহ থানায় পৃথক ২টি মামলা দায়ের করেন। এ ২টি মামলার পৃথক এজাহারে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা ও চৌদ্দগ্রামের সাবেক এমপি ডাঃ সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরকে প্রধান আসামি, স্থানীয় বিএনপি নেতা কামরুল হুদা, জামায়াত নেতা শাহাব উদ্দিন, শাহ মিজানুর রহমান, এ্যাডভোকেট শাহ জাহান, জামাল, মনিরসহ বিএনপি-জামায়াতের ৫৬ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। এছাড়া ওই ২টি মামলায় অজ্ঞাতনামা ১৫/২০ জনকে আসামি করা হয়। এ ২টি মামলায় ২০ দলীয় জোটের নেত্রী খালেদা জিয়া, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, দফতর সম্পাদক রিজভী আহমেদ (রুহুল কবির রিজভী), যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদ, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা শওকত মাহমুদ, স্থায়ী কমিটির সদস্য এমকে আনোয়ারসহ বিএনপির অন্য নেতৃবৃন্দকে হুকুমের আসামি করা হয়। মামলার ২টির তদন্তকারী কর্মকর্তা চৌদ্দগ্রাম থানার এসআই মোঃ ইব্রাহিম জানান, নিহতদের মধ্যে ওইসময় একজনের মরদেহের ময়নাতদন্ত করা হয়েছিল এবং অপর ৭ জনের মরদেহ ময়নাতদন্ত না করেই তাদের স্বজনদের নিকট হস্তান্তর করা হয়। পরবর্তীতে আদালতের নির্দেশে পুলিশ কক্সবাজারের ইউসুফ ও রাশেদুল ইসলামের লাশ ২০১৫ সালের ২১ নবেম্বর, যশোরের নুরুজ্জামান পপলু ও তার মেয়ে মাইশার লাশ ২০১৬ সালের ২১ জানুয়ারি, ২ ফেব্রুয়ারি শরীয়তপুরের ওয়াসিমের লাশ এবং ১ মার্চ নরসিংদীর আসমা ও শান্তর লাশ কবর থেকে উত্তোলন করে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করে। মামলায় বিভিন্ন সময়ে ২৯ জনকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করা হয়। এদের মধ্যে জাকির, মোতালেব ও আলমগীর নামে ৩ জন আসামি ঘটনার সাথে জড়িত থাকার বিষয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। এছাড়া আসামিদের মধ্যে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে শাহাবুদ্দিন নামে এক শিবির নেতা এবং সড়ক দুর্ঘটনায় সোহেল নামে এক আসামির মৃত্যু হয়েছে। ২ বছর ১ মাস তদন্ত ও পুলিশসহ ৬৬ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে সোমবার দুপুরে ২টি মামলার চার্জশীট আদালতে দাখিল করা হয়। এ ২টি মামলার প্রতিটিতে ৭৮ জনকে চার্জশীটভুক্ত করা হয়। এদের মধ্যে ২টি মামলায় জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা চৌদ্দগ্রামের সাবেক এমপি ডাঃ সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরকে প্রধান আসামি করা হয়। এছাড়া চার্জশীটে বেগম খালেদা জিয়া, শওকত মাহমুদ, এমকে আনোয়ার, এ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিঞা, সালাহউদ্দিন আহমেদ ও মনিরুল হক চৌধুরীকে হুকুমের আসামি করা হয়। তদন্ত শেষে এ ২টি চার্জশীটে মামলার এজাহারভুক্ত ৬ আসামির নাম বাদ দেয়া হয়েছে। এদের মধ্যে চৌদ্দগ্রামের চান্দিশকরা গ্রামের সাহাব উদ্দিন পাটোয়ারী বন্দুকযুদ্ধে ও জগমোহনপুর গ্রামের সোহেল সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। চার্জশীট থেকে বাদ পড়া অপর এজাহারনামীয় আসামিরা হচ্ছেÑ চৌদ্দগ্রামের কিংশ্রীপুর গ্রামের জাফর ইকবাল লিটন, কাঁঠালিয়া গ্রামের ইউনুছ, বাতিশা গ্রামের ওমর ফারুক রুবেল ও চট্টগ্রামের পটিয়ার ইব্রাহিম। এ ২টি মামলার চার্জশীটে এজাহারবহির্ভূত বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা সাবেক এমপি মনিরুল হক চৌধুরীসহ স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াতের আরও ২৮ নেতাকর্মীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর আগে একই বছরের ২৫ জানুয়ারি গভীর রাতে চৌদ্দগ্রাম উপজেলা সদরের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের হায়দারপুল এলাকায় একটি কার্ভাডভ্যানে আগুন দেয়ার ঘটনায় চৌদ্দগ্রাম থানার এসআই নুরুজ্জামান হাওলাদার বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। এ মামলায়ও বেগম খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামি করে এবং স্থানীয় বিএনপি-জামায়াতের ৩২ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সোমবার কুমিল্লার একই আদালতে চার্জশীট দাখিল করা হয়। চৌদ্দগ্রাম থানার ওসি মোঃ আবুল ফয়সল জানান, চলন্ত বাস ও ট্রাকে পেট্রোল বোমা মেরে মানুষ হত্যা ও যানবাহন পোড়ানোর ঘটনা সরকার ও জনবিরোধী অন্তর্ঘাতমূলক কাজ। এসব ঘটনায় দায়ের করা মামলার অভিযোগ, সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ তদন্ত ও সাক্ষীদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সোমবার আদালতে চার্জশীট দাখিল করা হয়েছে। কুমিল্লার পুলিশ সুপার মোঃ শাহ আবিদ হোসেন জানান, এ ঘটনাটি রাজনৈতিক কর্মসূচী চলাকালে সংঘটিত হয়েছিল। তবে রাজনৈতিক কর্মকা- এক বিষয় আর মানুষ হত্যা করা অন্য বিষয়। যারা রাজনৈতিক কর্মসূচীর নামে নাশকতা সৃষ্টি করে মানুষ হত্যা করেছে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তদন্তে যাদের নাম এসেছে তাদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশীট দাখিল করা হয়েছে।
×