ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

জনসংখ্যা এবং পুষ্টি খাতে নেয়া হচ্ছে বিশাল কর্মসূচী

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ৭ মার্চ ২০১৭

জনসংখ্যা এবং পুষ্টি খাতে নেয়া হচ্ছে বিশাল কর্মসূচী

আনোয়ার রোজেন ॥ দেশের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকার নতুন কর্মসূচী নিচ্ছে সরকার। স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা এবং পুষ্টি সেক্টর উন্নয়ন কর্মসূচীর (এইচপিএনএসডিপি) আওতায় এ বিপুল অর্থ ব্যয় করা হবে। এইচপিএনএসডিপি কর্মসূচীর তৃতীয় পর্যায়ের মেয়াদ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। তৃতীয় পর্যায় বাস্তবায়নে মোট ব্যয় হয়েছে প্রায় ৫৭ হাজার কোটি টাকা। এ হিসেবে চতুর্থ পর্যায়ে টাকার অঙ্কে কর্মসূচীর আকার দুই গুণেরও বেশি বাড়ানো হচ্ছে। সদ্য শেষ হওয়া এ কর্মসূচীর সুবাদে স্বাস্থ্য খাতের বেশ কয়েকটি সূচকে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) অর্জন করা গেছে। তবে নারী ও শিশুর অপুষ্টি, খর্বাকৃতি, ওজনহীনতার মতো সূচকগুলোতে কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। তাই এসব লক্ষ্য পূরণের পাশাপাশি এসডিজি অর্জন ও আগামীতে স্বাস্থ্য খাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে এতো বড় আকারের কর্মসূচী নেয়া হচ্ছে। ২০২২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত এইচপিএনএসডিপি কর্মসূচীর চতুর্থ পর্যায় বাস্তবায়ন করা হবে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। সূত্র জানায়, প্রস্তাবিত এ কর্মসূচী বাস্তবায়নে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় করা হবে প্রায় ৯৭ হাজার ২০৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাজস্ব খাতে ব্যয় হবে প্রায় ৭২ হাজার কোটি টাকা। আর বাকি প্রায় ২৫ হাজার ২০৪ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে উন্নয়ন খাতে। কর্মসূচী বাস্তবায়নে প্রকল্প সহায়তা হিসেবে বিদেশী উৎস থেকে ১৯ হাজার ২৭২ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হবে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর, পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর, সেবা পরিদফতর, ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর ও নিপোর্ট এ কর্মসূচী বাস্তবায়ন করবে। কর্মসূচীর শুরু থেকে বিশ্বব্যাংকসহ ১৪ দাতা দেশ ও সংস্থা অর্থ সহায়তা দিচ্ছে। প্রথমে এ খাতে ৩৫ কোটি ৯০ লাখ ডলার ঋণ দেয়ার ঘোষণা দেয় বিশ্বব্যাংক। পরে এ প্রকল্পে আরও ১৫ কোটি ডলার সহায়তা দিতে ঋণ চুক্তি করে সংস্থাটি। সব মিলে এতে সংস্থাটির সহায়তা দাঁড়ায় ৫০ কোটি ৯০ লাখ ডলারে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, কর্মসূচীর চতুর্থ পর্যায় বাস্তবায়নেও অর্থ সহায়তা দিতে বিশ্বব্যাংক প্রাথমিকভাবে তাদের সম্মতি জানিয়েছে। এ পর্যায়ে সহায়তার পরিমাণ হবে ৩০ কোটি ডলার। বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, মোট ২১টি সুনির্দিষ্ট শর্ত পূরণ সাপেক্ষে এ কর্মসূচিতে নতুন ৩০ কোটি ডলার দেবে সংস্থাটি। এর মধ্যে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নয়ন লক্ষ্য পূরণে দেয়া হয়েছে ১২ শর্ত। এ ব্যাপারে সংস্থাটির তরফে বলা হচ্ছে, নবজাতক ও শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যু, প্রজনন হার নিয়ন্ত্রণে সাম্প্রতিক সময়ে সন্তোষজনক অগ্রগতি হয়েছে। তবে শিশু ও মায়ের পুষ্টির উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। শতকরা হিসাবের পাশাপাশি প্রকৃত সংখ্যায়ও বাংলাদেশে অপুষ্টির শিকার নারী ও শিশুর সংখ্যা এখনও বেশি। এছাড়া শিশুদের খর্বাকৃতি ও ওজনহীনতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনও দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ দেশগুলোর একটি। তাছাড়া স্বাস্থ্য খাতে অসমতাও রয়েছে প্রচুর। প্রস্তাবিত কর্মসূচী বাস্তবায়নে এসব বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। সূত্র জানায়, স্বাস্থ্য খাতে ১৯৯৮ সাল থেকে খাতভিত্তিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ২০০৩ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত এইচপিএনএসডিপি কর্মসূচীর দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রায় ১৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, ধারবাহিকভাবে তিন পর্বে এইচপিএনএসডিপি বাস্তবায়নের সুবাদে নবজাতক ও শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যু, প্রজনন হার নিয়ন্ত্রণে সাম্প্রতিক সময়ে ১০টি সূচকে বাংলাদেশের অসাধারণ উন্নতি হয়েছে বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির সাম্প্রতিক এক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৭ সালে প্রতি হাজারে ৬৫ শিশু মারা যেত ৫ বছর বয়সের মধ্যে। ২০১৪ সালে এ সংখ্যা নেমে এসেছে প্রতি হাজারে ৪৬ জনে। এ হিসাবে শিশুমৃত্যুর হার কমেছে ২৯ শতাংশ। ১৯৯০ সালে দেশে নারীপ্রতি শিশুর জন্মদানের সংখ্যা ছিল গড়ে ৩ দশমিক ৩। সম্প্রতি নারীপ্রতি শিশুর জন্মদানের এ সংখ্যা নেমে এসেছে ২ দশমিক ৩-এ। ২০০৯ সালে ৪৩ শতাংশ শিশু শুধু মায়ের বুকের দুধ পান করত। ২০১৪ সালে এ হার উঠেছে ৫৫ শতাংশে। একই সময় জন্মের আগেই দক্ষ স্বাস্থ্য কর্মীর সেবা পাওয়া শিশুর সংখ্যা ৫৩ শতাংশ থেকে উঠেছে ৬৪ শতাংশে। প্রয়োজনের তুলনায় কম ওজনের শিশুর সংখ্যা ৪১ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৩৩ শতাংশে। বিশ্বব্যাংক বলছে, স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা এবং পুষ্টি সেক্টর উন্নয়ন কর্মসূচীর (এইচপিএনএসডিপি) সুবাদে এ অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে। এইচপিএনএসডিপির আওতায় ২০১৪ সাল থেকে দেশে ১৩ হাজারের বেশি কমিউনিটি ক্লিনিক চালু রয়েছে। কর্মসূচীর আওতায় সচেতনতামূলক পদক্ষেপের কারণে প্রসবকালে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য কর্মীর সেবা নেয়ার হার ২১ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশে। জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবহারের প্রবণতা ৫৫ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬২ শতাংশে। হামের টিকা গ্রহণের প্রবণতা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৬ শতাংশে। ২৩ মাসের মধ্যে সবগুলো মৌলিক টিকা গ্রহণের হার এখন ৮৪ শতাংশ। এসব অগগ্রতির কারণে সাম্প্রতিক সময়ে দেশের মানুষের গড় আয়ুও বেড়েছে। প্রতিবেদনটিতে স্বাস্থ্য খাতের উন্নতির জন্য নেয়া সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের প্রশংসার পাশাপাশি চ্যালেঞ্জের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বিশ্বব্যাংকের তরফে বলা হয়েছে, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এমডিজি) আওতায় ৫ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে বাংলাদেশ ২০১০ সালে জাতিসংঘের এমডিজি এ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে। এরপরও বাংলাদেশের অনেক মানুষ মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এর ফলে প্রতিদিন দেশের অর্থনীতির বিপুল পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে। তবে একই সঙ্গে তৃণমূল পর্যায়ে নারী, শিশু ও দরিদ্রদের উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে এইচপিএনএসডিপি ভাল ভূমিকা রাখছে। প্রকল্পের আওতাধীন উপজেলা হাসপাতালগুলোতে নিশ্চিন্ত ও নিরাপদ সেবা পাচ্ছেন গর্ভবতীরা। উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাংক ছাড়াও ডিএফটিএডি, ডিএফআইডি, জাইকা, ইকেএন, জিআইজেড, কেএফডব্লিও, কেওআইসিএ, এসআইডিএ, ইউএসএআইডি, আইডিএ, ডব্লিওএইচও, ইউএনআইসিইএফ, ইউএনএফপি ও ইউএনএআইডিএস ছাড়াও মোট ১৪টি দাতা দেশ ও সংস্থা কর্মসূচীর বিভিন্ন পর্যায়ে সহায়তা দিয়েছে।
×