ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বেসরকারী চাকরিতে নারীর হার আরও কম ;###;মাস্টার্স করে ঘর সামলাচ্ছি, এখন শুনতে হয় সারাদিন ঘরে বসে কী কর? শিক্ষিত হয়েও স্বাবলম্বী হতে পারলাম নাÑ গৃহবধূ তাসলিমা তাবাসসুমা ;###;প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষায় ৫০ শতাংশ নারী বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ৩৩ শতাংশ

সরকারী চাকরিতে অনুমোদিত পদ প্রায় ১৫ লাখ ॥ ৪ ভাগের ১ ভাগ নারী

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ৭ মার্চ ২০১৭

সরকারী চাকরিতে অনুমোদিত পদ প্রায় ১৫ লাখ ॥ ৪ ভাগের ১ ভাগ নারী

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এ্যাকাউন্টিংয়ে মাস্টার্স করার পর এক বছর একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেছি। কিন্তু পরের বছর বিয়ে হয়ে গেলে সংসার সামলাতে গিয়ে আর চাকরিটা করা হয়নি। নিজের ক্যারিয়ারের চিন্তা না করে পরিবারের চিন্তা করেছি। মা হওয়ার পর সংসার ও বাচ্চাকে নিয়ে আরও ব্যস্ততা বেড়ে যায়। তখন তো চাকরি করার কথা ভাবতেও পারতাম না। সংসারের প্রতি ভালবাসায় বিভোর হয়ে নিজের পায়ে কুড়াল মেরেছি। এখন আমার মেয়ের বয়স বারো বছর। মেয়েকে স্কুলে আনা-নেয়া, গান শেখা, ছবি আঁকা সবকিছুতে ছায়ার মতো পাশে থাকতে হয়। সবসময় ভেবেছি আমি যেমন নিজের ক্যারিয়ারকে বিসর্জন দিলাম, আমার সন্তানের ভবিষ্যত যেন এমন না হয়। কিন্তু আমার সন্তানও আমাকে নিয়ে গর্ব করে না। স্বামী কিংবা সন্তানের মতে, ‘সারাদিন তো তুমি ঘরেই থাকো’। সংসারের সব দায়িত্ব পালনের পরও পরিবারের সদস্যদের কাছে শুনতে হয়, ‘সারাক্ষণ ঘরে বসে কী করো’। নিজের উপার্জনের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সব চাহিদা পূরণে আরেকজনের ওপর নির্ভর করে চলছি। আমার সার্টিফিকেটগুলোর কোন মূল্য এখন আর নেই। এখন সবদিক থেকে আমার অর্জন শূন্য। কারণ, অর্থ উপার্জনের ওপরই এখন পরিবারের সদস্যদের এই মূল্যায়ন নির্ভর করছে।’ একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেও আজ গৃহিণী হিসেবেই নিজের পরিচয় জানান তাসলিমা তাবাসসুম। পরিবারের জন্য নিজের এই আত্মত্যাগের মূল্যায়ন সে তার সংসার জীবনে পাইনি বরং অর্থ উপার্জন না করায় সবার কাছে নিজের মূল্যায়ন কমেছে বলে আক্ষেপ প্রকাশ করে জনকণ্ঠকে জানান তিনি। তাসলিমার মতো বাংলাদেশের অনেক নারীরা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও পরিবারে আত্মনিয়োগ করছে। এতে করে নারীর উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। প্রতিবছরই উচ্চশিক্ষিত হয়ে কর্মক্ষেত্রে যোগদান করলেও কিছুদিনের মধ্যেই কর্মক্ষেত্র থেকে ঝরে পড়ছে অনেক নারী। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রাথমিকে দেশে যত শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে, তার মধ্যে ৫০ শতাংশ ছাত্রী। মাধ্যমিক স্তরে ছাত্রীর সংখ্যা ৫৩ শতাংশ আর কলেজ পর্যায়ে মোট ছাত্রীর সংখ্যা ৪৭ শতাংশ। এতে দেখা যাচ্ছে, কলেজ পর্যন্ত নারীর অংশগ্রহণ ভাল। কিন্তু উচ্চশিক্ষা ও পেশাগত শিক্ষার স্তরে গিয়ে নারীর সংখ্যা অনেক কমে যাচ্ছে। ব্যানবেইসের সর্বশেষ হিসাবে চিকিৎসা, আইনসহ পেশাগত শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ এখন ৩৮ শতাংশ। আর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এখন যত শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন, তার ৩৩ শতাংশ নারী। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে উচ্চশিক্ষায় সরকারী-বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত প্রায় ২৮ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে ১২ লাখ নারী রয়েছে। তবে পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিবছর এসব স্তরেও নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। কিন্তু শিক্ষাজীবন শেষ করে চাকরিতে প্রবেশের সময় নারীর অংশগ্রহণ অনেক কমে যাচ্ছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, দেশে সরকারী চাকরিতে অনুমোদিত পদ আছে ১৪ লাখ ৭১ হাজার ৩৬টি। এর মধ্যে নারী চাকরিজীবী হলেন ২ লাখ ৮৮ হাজার ৮০৪ জন। শতাংশের হিসাবে মোট চাকরির ২৪ দশমিক ১৮ শতাংশ নারী। বেসরকারী কর্মক্ষেত্রেও নারীর সংখ্যা কম। তাই শিক্ষিত নারীদের একটি বড় অংশ শুধু গৃহিণী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। পরিবারে আদর-যতœ থাকলেও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে তাদের মতামতের গুরুত্ব অনেকটাই কম। গৃহিণী আফরোজা আক্তার তার স্বামী ও দুই সন্তানকে নিয়ে মোহাম্মদপুরের একটি বাসায় থাকেন। সরকারী তিতুমীর কলেজ থেকে অর্থনীতিতে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও আজ তিনি গৃহিণী। সংসারের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে চাকরি করতে পারেননি তিনি। অর্থনৈতিকভাবে তিনি অন্যের ওপর নির্ভরশীল। তিনি বলেন, ‘অনেক ইচ্ছে ছিল নিজে স্বাবলম্বী হব। কিন্তু আজ কাল পরশু করে আর চাকরি করা হয়নি। সন্তানকে লালন-পালন করায় একমাত্র ব্রত হিসেবে বেছে নিয়েছি। আজ অনেক মেয়েরাই চ্যালেঞ্জিং পেশা বেছে নিচ্ছে। আমাদের মতো ঘরকুনো মেয়েদের জন্যই নারীর উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নারীর উন্নয়ন দু’পা এগিয়ে গেলে এক পা পিছিয়ে পড়ছে। তাই এখন আর নারীদের ঘরে বসে গৃহিণী সেজে থাকার সময় নেই। নিজের মূল্যায়ন নিজেকেই অর্জন করতে হবে এবং তা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে।’ এ বিষয়ে মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি জনকণ্ঠকে বলেন, নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ এখন অনেকটাই নিশ্চিত হয়েছে। কর্মক্ষেত্রের যে জায়গাগুলোতে চ্যালেঞ্জ ছিল সেগুলো নারীরা এখন কাটিয়ে উঠেছেন। সমাজে এমন কোন ক্ষেত্র বাদ নেই যেখানে নারীরা সফলতা অর্জন করেননি। সংখ্যায় কম হলেও প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের নারীরা নিজেদের প্রমাণ করেছে। যেহেতু সর্বক্ষেত্রেই নারীরা চলে গিয়েছেন, এখন সংখ্যার দিক দিয়ে এগিয়ে যাওয়া সহজ হবে। তিনি বলেন, নানা কারণে মেয়েরা শিক্ষিত হয়েও কর্মসংস্থানে আসতে পারেন না। সেসব শিক্ষিত গৃহিণীর জন্য মন্ত্রণালয়ের সহযোগী প্রতিষ্ঠান জয়িতা ফাউন্ডেশন আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। দেখা যায়, গৃহিণীরা ঘরে মমতা দিয়ে অনেক কাজ করছেন। কিন্তু সেগুলো অর্থ দিয়ে বিচার করা হয় না। জয়িতা তাদের সেই মেধা মূল্যায়নের সুযোগ তৈরি করেছে। ব্যবসায়ে আগ্রহী নারীদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা জয়িতা থেকে দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে নারীদের পিছিয়ে থাকার বড় কারণ হলো বাল্যবিয়ে ও সামাজিক নিরাপত্তার অভাব বলে মনে করেন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির (বিএনডব্লিএলএ) নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী। জাতিসংঘ শিশু তহবিলের তথ্য দিয়ে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, দেশে এখনও ১৮ বছরের আগে ৬৬ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে উচ্চশিক্ষার আগেই ঝরে পড়ছে তারা। আবার উচ্চশিক্ষা শেষ করেও পারিবারিক ও সামাজিক বাধায় অনেক নারী চাকরি করেন না বা ইচ্ছা থাকলেও করতে পারেন না। শিক্ষিত হলেও যদি আত্মসম্মান ও মর্যাদাবোধ তৈরি না হয় তাহলে নারীদের এই অবস্থার পরিবর্তন হবে না। কারণ, পরিবার মেয়েদের শিক্ষিত করছে কিন্তু সেই সঙ্গে জন্মের পর থেকেই তাকে জানানো হচ্ছে তুমি মেয়ে। আগে ঘর সামলানোই মেয়েদের অন্যতম কাজ। এ জন্য অনেক শিক্ষিত নারীরা ঘর সামলানোর বাহানায় নিজেকে কর্মক্ষেত্রে নিয়োগ করছে না। শিক্ষিত হয়েও যদি দেশের নারীরা কর্মবিমুখ হয়ে থাকে তবে তারা মূর্খতার পরিচয় দিচ্ছে বলে আক্ষেপ প্রকাশ করেন তিনি। নারী মুক্তির আন্দোলন যুগ যুগ ধরে। নিজের অধিকার নিজেরই আদায় করে নিতে হবে নারীর। বর্তমান সরকার নারীর উন্নয়নে বদ্ধপরিকর। সবার আগের তাদের নিজের এবং সমাজের মানসিকতায় পরিবর্তন করতে হবে। নারীর সাফল্য ও অর্জনকে ধরে রাখতে সরকারের সঙ্গে সামাজিকভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। তাই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ‘গৃহিণী’ হিসেবে নিজেকে অবলা মনে না করে নিজের অধিকার আদায় ও নিজের মূল্যায়ন নিজেকেই অর্জন করার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে নারীদের।’
×