ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বাঙ্গনে বাংলার নারী

প্রকাশিত: ০৫:১৭, ৭ মার্চ ২০১৭

বিশ্বাঙ্গনে বাংলার নারী

জীবন আশ্চর্যময়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জীবন লক্ষ্যের অভিমুখ এবং দর্শন দুই-ই অতি নিশ্চয়তার সঙ্গে পাল্টায়। নিজের অবস্থানের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী প্রজন্মের দিকে তাকালে এই পরিবর্তন খুব স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে, বিশেষ করে নারীর জগতে। কারণ, কিছু একটা করতে হবে, কিছু হতে হবে, এই প্রেরণা পুরুষের বহুকালের। সভ্যতা অনাদি অতীত থেকে এই চেতনারই সঞ্চার করেছে, পুরুষকে হতে হবে সফল ও কর্মঠ। নারীকেও হতে হয় সফল ও কর্মঠ, কিন্তু র্দূভাগ্য জনক ভাবে তার ঠিকানা ছিল ঘরবন্দিপুর। তার জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সমগ্র পরিক্রমাই ছিল পরিবার নির্ধারিত কর্তব্য পালন এবং পুরুষ মুখাপেক্ষী। নারী ভাল স্ত্রী হবে, ভাল মা হবে, সংসারে শ্রমদান করবে, সে হবে নতমুখী ও সহনশীল। তবে ধীরে ধীরে নারীর প্রতি এই ধারণার পরিবর্তন হয়েছে এবং নারীরা আজ বিশ্ব জয় করছেন।বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশের নারীরা। আসুন জেনে নেই সমসাময়িক নারীদের বিশ্বঙ্গনে সফলতার কথা। টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিকী জন্ম ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৮২ সালে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানার কন্যা টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিকী। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেবার পার্টি এবং কো-অপারেটিপ পার্টির রাজনীতিবিদ। তিনি ২০১৫ সালে সাধারণ নির্বাচনে লন্ডনের হ্যামস্টেড এ্যান্ড কিলবার্ন আসন থেকে পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এর পূর্বে তিনি রিজেন্ট পার্কের কাউন্সিলর এবং ২০১০ সালে ক্যামডেন কাউন্সিলের কালচার এ্যান্ড কমিউনিটির সদস্য ছিলেন। প্রতিবছর লন্ডনের ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড ব্রিটেনের বিভিন্ন সেক্টরের প্রভাবশালীদের নিয়ে ১ হাজার জনের একটি তালিকা প্রকাশ করে। ওই তালিকায় প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের ক্যাটাগরিতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসনের মতো ব্যক্তিদের পাশে স্থান পেয়েছেন টিউলিপ সিদ্দিক। এছাড়াও তিনি নারী ও সমতাবিষয়ক যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টারি সিলেক্ট কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। টিউলিপের স্বামী ক্রিস পার্সি একজন ব্রিটিশ। ২০১৩ সালে রিজেন্ট পার্ক এলাকার কাউন্সিলর থাকার সময় যুক্তরাজ্যের এই নাগরিককে বিয়ে করেন টিউলিপ। দেবযানী ঘোষ দেবযানী ঘোষ জন্ম ১৯৮৮ সালে ৩০ অক্টোবর বাবা দীপক কুমার ঘোষ এবং মা ইন্দিরা ঘোষ পেশায় দুজনই শিক্ষক। দুই বোনের মধ্যে তিনি বড়। ছোট বোন দেবশ্রী ঘোষ চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রী নিয়েছেন। ছোট বেলার থেকেই দেবযানী খুব মেধাবী ছিলেন। বই পড়ার পোকা ছিল মাথার ভেতর নতুন কোন বই পেলেই সবার আগে পড়তেন তিনি। আর সময় পেলেই বসে পড়তেন ড্রয়িং করতে। চট্টগ্রাম পাবলিক স্কুল এ্যান্ড কলেজ থেকে বেরিয়ে ভর্তি হন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তড়িৎ ও ইলেক্ট্রনিকস প্রকৌশলে স্নাতক হওয়ার পর দেবযানী কিছুদিন শিক্ষকতা করেন চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটিতে। এরপর চলে যান জার্মানি। এখন পিএইচডি করছেন ইউনিভার্সিটি অব উলমে। বর্তমান শতকে বিমান নির্মাণে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির আবিষ্কার নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলছে। সবারই একি লক্ষ্য যুদ্ধকৌশলে পারদর্শী, প্রতিপক্ষের রাডার ফাঁকি দেয়া, ভারি অস্ত্র বহনে সক্ষমতার দিকে। বিশ্বে প্রতিদিন অন্তত কয়েক হাজার বিমান চলাচল করছে এক গন্তব্য থেকে অন্য গন্তব্যে। ফলে বিপুলসংখ্যক বিমান প্রতিনিয়ত জ্বালানি পুড়িয়ে নিঃসরণ করছে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কার্বন। যা বিপর্যয় ডেকে আনছে বিশ্ব জলবায়ুর জন্য। আর সে ভাবনা থেকেই পরিবেশবান্ধব বিমান নির্মাণের উপায় খুঁজছে নির্মাতারা। সে প্রচেষ্টার সাফল্য হিসেবে এইচওয়াই-৪ হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম কার্বন নিঃসরণমুক্ত বিমান। যেটি চলে জ্বালানি কোষ ও ব্যাটারির সাহায্যে। এই বিমানের শব্দও কম। এই বিমান প্রকল্পের বৈজ্ঞানিক নেতৃত্বে আছে জার্মান এ্যারোস্পেস সেন্টার (ডিএলআর)। প্রধান গবেষণা অংশীদার ইউনিভার্সিটি অব উলম। ইউনিভার্সিটি অব উলমের গবেষণা দলে পিএইচডি গবেষক হিসেবে কাজ করছেন চট্টগ্রামের মেয়ে দেবযানী ঘোষ। ফারহানা রহমান সফটওয়্যার খাতে নিজস্ব মেধাকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখার উদ্দেশ্যে ২০০৩ সালে ফারহানা রহমান নিজ উদ্যোগে গড়ে তোলেন ইউওয়াই সফটওয়্যার কোম্পানি। সে সময় সফটওয়্যারে নারী উদ্যোক্তা ছিলেন হাতেগোনা কয়েকজন। অথচ সন্তানের দেখাশোনার পরও এমন এক চ্যালেঞ্জিং পেশায় সকল বৈরিতাকে হার মানিয়ে সামনে এগিয়েছেন ফারহানা। মূলত সফটওয়্যার ডেভেলপ, আউটসোর্সিং ওয়েবসহ বিভিন্ন কাজে তার প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে দেশে বিদেশে বাংলাদেশের অবস্থানকে সুদৃঢ় করেছে। ফারহানা রাহমান ২০০৩ সাল থেকে ছোট পরিসরে কাজ শুরু করেন। ২০০৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে অফিস নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। ফারহানা রহমান এর ইউওয়াই সিস্টেমস লিমিটেড এরই মধ্যে গুণগতমানের স্বীকৃতি হিসেবে অর্জন করেছে আইএসও ৯০০১-২০০৮ সনদ। ছোটবেলা থেকেই তার নিজে কিছু করার চেষ্টা ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খাদ্য এবং পুষ্টি বিজ্ঞান থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করার পর নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান চালু করে দেন। শুরুতেই তিনি গ্রাহকদের বিশ্বাস অর্জন করার চেষ্টা করেছিলেন। সাফল্য পেতে তিনি অনেক ছেলে কর্মীদের চেয়ে বেশি পরিশ্রম করেছেন। ফারহানার আগ্রহে সবার আগে ছিল আইটি সেক্টর। ২০০৩ সালে আপলোড ইয়োর সেলফ সিস্টেম নামে নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান চালু করেছেন। এর আগে গ্রাফিক্স এবং ওয়েব ডিজাইন নিয়ে পড়াশোনাও করেছিলেন। তার তৈরি করা প্রতিষ্ঠানটি সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ওয়েব সাইটের গ্রাফিক্স ডিজাইন, আইওএস এবং এ্যান্ড্রয়েডের জন্য এ্যাপি কেশন তৈরি করে থাকে। শুধু তাই নয় তাদের কাজের ক্ষেত্র দেশে নয় বরং দেশের বাইরে। সওগাত নাজবিন খান সওগাত নাজবিন খান। সম্প্রতি তিনি নির্বাচিত হন জাতি সংঘের তরুণ নেতা। সারা বিশ্ব থেকে ১৭ জন তরুণ নেতা জাতি সংঘের সাধারণ পরিষদের ৭১তম অধিবেশনে অংশ নেয়ার সুযোগ পান। তাদেরই একজন আমাদের ময়মনসিংহের প্রতিভাময়ী নাজবিন খান। অন্য ১৬ জনের মতো তিনিও নিজ দেশে কাজ করে যাচ্ছেন জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য বা এসডিজি অর্জনে। বাবার সরকারী চাকরিজীবী। তাই কয়েকটি বিদ্যালয়ে পড়তে হয় নাজবিনকে। মেধাবী বলে ভর্তির সময় এক ক্লাস ওপরে নাম লেখান। পড়েন রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেন এই প্রতিষ্ঠান থেকেই। তড়িৎ ও ইলেক্ট্রনিকস প্রকৌশলে স্নাতক হয়েছেন ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ বা আইইউবি থেকে। অতঃপর পড়াশোনা করেন পরিবেশবান্ধব জ্বালানি বিষয়ে, ভারতে। নাজবিন ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি শেষ করে ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি থেকে অনার্স সম্পন্ন করেন। এরপর ইউনেস্কোর স্কলারশিপে ভারতের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি দূষণমুক্ত জ্বালানি (গ্রিন এনার্জি) বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি ময়মনসিংহে ‘এইচ এ ডিজিটাল স্কুল এ্যান্ড কলেজ’ নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গেড়ে তুলেন, যেখানে আর্থিকভাবে অসচ্ছল ছেলে-মেয়েদের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পড়ানো হয়। প্রতিষ্ঠানটি গ্রামীণ হতদরিদ্র পরিবারের ৩৩৬ জন নিবন্ধিত শিক্ষার্থীকে নতুন নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছে।
×